‘হক আদায় করতে পারিনি ক্ষমা করে দিও’

Mullahআহমেদ জামাল
‘সাংগঠনিক কাজে বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকায় তোমার হক সঠিকভাবে আদায় করতে পারিনি, তোমাকে সময় দিতে পারিনি, ক্ষমা করে দিও।’ মঙ্গলবার রাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে স্ত্রী সানোয়ারা জাহানের কাছ থেকে এভাবেই শেষ বিদায় নিয়েছিলেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা। পুত্র হাসান জামিলসহ পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আমি তোমাদের অভিভাবক ছিলাম। এ সরকার যদি আমাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, তাহলে সেটা হবে আমার শাহাদাতের মৃত্যু। আমার শাহাদাতের পর মহান রাব্বুল আলামীন তোমাদের অভিভাবক হবেন। তিনিই উত্তম অভিভাবক। সুতরাং তোমাদের দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। ইসলামী আন্দোলনকে বিজয়ী করার মাধ্যমে আমার হত্যার প্রতিশোধ নিও।
রাত ৮টায় স্বজনদের ওই সাক্ষাতের আগে তিনি জানতেন না কারা কর্তৃপক্ষ তার ফাঁসির দণ্ড কার্যকরের শেষ প্রান্তে পৌঁছেছে। পরিবারের সদস্যদের কাছেই প্রথম তিনি এ সংবাদ শোনেন। কাদের মোল্লার  ছেলে হাসান জামিলসহ পরিবারের সদস্যরা এসব কথা জানিয়েছেন। মঙ্গলবার বিকালে কারা কর্তৃপক্ষের জরুরি চিঠি পাওয়ার পর রাত ৮টায় আবদুল কাদের মোল্লার সঙ্গে ঢাকা  কেন্দ্রীয় কারাগারে সাক্ষাতের জন্য যান স্ত্রী সানোয়ারা জাহান, ছেলে হাসান জামিল ও ৩  মেয়েসহ পরিবারের ২৩ সদস্য। রাতেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে- সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না আবদুল কাদের মোল্লা। তখন পর্যন্ত তার শারীরিক পরীক্ষার আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন করা হয়নি। তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাতের পরে জানতে পারেন, কারা কর্তৃপক্ষ সাক্ষাতের জন্য তাদের ডেকে এনেছে। এ সময় আবদুল কাদের মোল্লা পরিবারের সদস্যদের সামনেই এক কারারক্ষীকে জিজ্ঞাসা করেন কয়টা নাগাদ ফাঁসি হতে পারে। তবে কারারক্ষী তাৎক্ষণিক বলতে পারেনি।
হাসান জামিল জানান, আব্বা রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। এ সময় সেখানে হঠাৎ আমাদের আসার খবর পান। খাওয়া শেষে তিনি আমাদের সামনে আসেন। কারা কর্র্তৃপক্ষের চিঠির কথা শুনেই তিনি বুঝতে পারেন শিগগিরই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে। তবে এতে তার মাঝে কোন রকম পরিবর্তন দেখা যায়নি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত স্বাভাবিক। কথাবার্তা বলেছেন স্বাভাবিকভাবেই। বাচ্চাদের আদর করেছেন।
নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে তিনি তার পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে বলেন, শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার অপরাধেই আমাকে হত্যা করা হচ্ছে। শাহাদাতের মৃত্যু সকলের নসিবে হয় না। আল্লাহতায়ালা যাকে শহীদী মৃত্যু  দেন সে সৌভাগ্যবান। আমি শহীদী মৃত্যুর অধিকারী হলে তা হবে আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। আমার প্রতিটি রক্তকণিকা ইসলামী আন্দোলনকে বেগবান করবে ও জালেমের ধ্বংস ডেকে আনবে।
জামায়াতের এই নেতা বলেন, আমি নিজের জন্য চিন্তিত নই। আমি দেশের ভবিষ্যৎ ও ইসলামী আন্দোলন নিয়ে চিন্তিত। আমি আমার জানামতে  কোন অন্যায় করিনি। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামী আন্দোলনের জন্য আমি আমার জীবন উৎসর্গ করেছি। আমি অন্যায়ের কাছে কখনও মাথা নত করিনি, করবো না। দুনিয়ার কোন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রাণ ভিক্ষা চাওয়ার প্রশ্নই আসে না। জীবনের মালিক আল্লাহ। কিভাবে আমার মৃত্যু হবে তা আল্লাহই নির্ধারণ করবেন। কোন ব্যক্তির সিদ্ধান্তে আমার মৃত্যু কার্যকর হবে না। আল্লাহর ফয়সালা অনুযায়ীই আমার মৃত্যুর সময় ও তা কার্যকর হবে। সুতরাং আমি আল্লাহর ফয়সালা সন্তুষ্টচিত্তে  মেনে নেবো।
পরিবারের সদস্যদের তিনি আরও বলেন, তোমরা ধৈর্যের পরিচয় দেবে। একমাত্র ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমেই আল্লাহতায়ালার ঘোষিত পুরস্কার পাওয়া সম্ভব। দুনিয়া নয়, আখেরাতের মুক্তিই আমার কাম্য। আমি দেশবাসীর কাছে আমার শাহাদত কবুলিয়াতের জন্য দোয়া চাই। দেশবাসীর কাছে আমার সালাম  পৌঁছে দিও।
হাসান জামিল জানান, ৩০ থেকে ৩৫ মিনিট পরিবারের সদস্যদের সামনে অবস্থান করেন কাদের মোল্লা।  বিদায় বেলায় স্ত্রীর সঙ্গে শেষ কথা বলেন তিনি, ‘ধৈর্য ধরো, আল্লাহর ওপর ভরসা রেখো। তোমার হক যথাযথভাবে আদায় করতে পারিনি বলে ক্ষমা করে দিও।’ প্রতি উত্তরে আম্মা বলেছেন- ‘দীর্ঘদিন কারাবন্দি থাকায় আপনার সেবা করতে পারিনি। বিদায়বেলায়ও পাশে থাকতে পারছি না। জীবন চলার পথে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কোন অন্যায় হয়ে থাকলে মাফ করে দিবেন।’ এ সময় খানিকটা আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হলেও কাদের মোল্লা ছিলেন দৃঢ়, অবিচল। ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে তিনি সবার কাছ থেকে বিদায় নেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button