রোহিঙ্গা মুসলমানরা বিশ্বের অন্যতম নির্যাতিত জনগোষ্ঠী : জাতিসংঘ
যদি একটি দেশের নাম পাল্টে দেয়া হয় তাহলে কী ঘটে? তাতে কি সে অতীতকে মুছে ফেলা যায়, যা পছন্দ নয়? যে পরিবর্তন ঘটলো তা কি নতুন করে শুরুর ইঙ্গিত? সে দেশের মানুষ কি তাদের স্মৃতি থেকে পুরনোকে মুছে ফেলে নতুনকে গ্রহণ করবে? দেশের নাম পরিবর্তন করে মিয়ানমার রাখার মধ্য দিয়ে বার্মার সামরিক কর্তৃপক্ষ সম্ভবত ঔপনিবেশিক অতীতকে মুছে ফেলারই চেষ্টা করছে। সে দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের নির্মূলের অব্যাহত ঘটনাও হয়তো তারই অংশ।
মিয়ানমার পঞ্চাশ বছর সামরিক শাসনে ছিল এবং এখনো তা একটি পুরোপুরি সামরিক রাষ্ট্র। নির্মূলীকরণ, গণহত্যা, বৈষম্য এবং ফ্যাসিবাদ শীর্ষক শব্দগুলো এ দেশটির সাথে সমার্থক। একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, রোহিঙ্গাদের সাথে তারা যা করছে তাকে যুদ্ধ বললে খুবই কম বলা হয়, এটা গণহত্যা।
জাতিসংঘের মতে, বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বসবাসকারী রোহিঙ্গা মুসলমানরা বিশ্বের অন্যতম নির্যাতিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। শত শত বছর ধরে রাখাইন প্রদেশ তাদের মাতৃভূমি। ভাষার দিক দিয়েও তারা বর্মীদের থেকে আলাদা। কিন্তু মিয়ানমার সরকার বলে, সম্প্রতি তারা বাংলাদেশ থেকে এখানে অভিবাসী হয়েছে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই সরকার তাদের নাগরিক অধিকার দেয় না। এর ফল হয়েছে ভয়ংকর-
*মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের কোনো সামাজিক মর্যাদা নেই। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তাদের বিয়ে করতে হয়। তারা দুটির বেশি সন্তান নিতে পারে না।
*রোহিঙ্গাদের ভ্রমণের অনুমতি দেয়া হয় না। এমনকি এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে হলেও তাদের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। ঘুষ ছাড়া সে অনুমতি মেলে না। এর ফলে তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না। তারা কোনো কাজ করতে পারে না, বাজারে যেতে পারে না এবং কোনো স্বাস্থ্যসেবাও পায় না।
* রোহিঙ্গা মুসলমানরা কোনো সরকারি হাসপাতালে যেতে পারে না এবং তারা সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোনো সুবিধা পায় না। তাদের বেশিরভাগ রোগের চিকিৎসা হয় না। ওষুধের ব্যয় অত্যধিক।
বিশ্বের একটি দরিদ্রতম অংশের অধিবাসী রোহিঙ্গারা দুঃসহ অবস্থার মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। ২০১২ সালের সহিংসতার পর তাদের অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে। এ সময় শত শত রোহিঙ্গা নিহত ও অসংখ্য দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। বহু পরিবার সর্বস্ব হারিয়ে কপর্দকশূন্য অবস্থায় শুধু প্রাণ বাঁচাতে সাগরে চলাচলের অনুপযোগী নৌকায় করে পলায়ন করে। বাংলাদেশ তাদের প্রবেশ রোধ করতে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়, আর থাইল্যান্ড তাদের আশ্রয় না দিয়ে সাগরে ঠেলে দেয়। এসব নিরুপায় লোকদের অতি সামান্যই পুনরায় কূলে ফিরে আসতে পেরেছে। বাকিরা চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্মূলে নানা রকম পন্থা অবলম্বনের পাশাপাশি বর্বর গুন্ডা বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছে। তারা কোনো জিনিসপত্র নিতে না দিয়ে একেবারে নিঃস্ব, রিক্ত করে বিতাড়িত করছে তাদের। এভাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাস্তুচ্যুত করে তারা ওই এলাকাকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত গ্যাস লাইন স্থাপনের ক্ষেত্র তৈরি করছে। এ গ্যাস পাইপ লাইনের নাম শোয়ে গ্যাস পাইপ লাইন। কিছু বিশ্লেষক ইতোমধ্যে এর নামকরণ করেছেন ‘মৃত্যু পাইপ লাইন’। ইউরোপীয় ইউনিয়নের হিউম্যানিটারিয়ান এইড অ্যান্ড সিভিল প্রটেকশন ডিপার্টমেন্টের মহাপরিচালক ক্লাউস সরেনসন রাখাইন প্রদেশের অবস্থাকে ইউরোপে হিটলারের আমলে স্থাপিত ইহুদি বন্দিশিবিরের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, আমরা জানি সেগুলোতে ইহুদিদের আটকে রাখা হতো। রাখাইনদের অবস্থা সে রকমই। মিয়ানমারের মুসলমানদের ওপর অব্যাহতভাবে নির্যাতন চলছে। প্রশ্ন হচ্ছে গোটা বিশ্ব কি তাদের ব্যাপারে চোখ বন্ধ করেই রাখবে? হিটলারের আমলে ইহুদিদের ভাগ্যে যে মহাবিপর্যয় ঘটেছিল একালে মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গাদের ভাগ্যেও কি তাই ঘটবে? বিশ্ব কি তাই-ই ঘটতে দেবে?
সূত্র : আরব নিউজ