সব মিউচ্যুয়াল ফান্ড বোনাস লভ্যাংশ দিতে পারবে
নানা নাটকীয়তার পর অবশেষে সব মিউচ্যুয়াল ফান্ডের জন্য বোনাস ঘোষণার সুযোগ দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। কমিশনের ৪৮৭ তম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কমিশনের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা গেছে।
তবে বোনাস লভ্যাংশ প্রদানের জন্য ট্রাস্টির অনুমোদন লাগবে। অর্থাৎ ৩৭টি ফান্ডের এসেট ম্যানেজার কোম্পানি ট্রাস্টির অনুমোদন সাপেক্ষে বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারবে। বাকি ৬টি’র (নতুন ২টিসহ) প্রসপেক্টাসে বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণার সুযোগ থাকায় সেগুলোর ট্রাস্টির অনুমোদন প্রয়োজন হবে না।
মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিধিমালায় এ সংক্রান্ত সংশোধনে কমিশনের ৪৮৭ তম (আজকের) সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়,
“৬৬। লভ্যাংশ বিতরণ ও উহার সীমা।- প্রত্যেক মিউচ্যুয়াল ফান্ড উহার বার্ষিক হিসাব সমাপ্ত হইবার পর প্রতিটি স্কীমের বিপরীতে উক্ত স্কীমের ইউনিট মালিকগণের মধ্যে এই বিধিমালার আলোকে ও ট্রাষ্টির মতামত সাপেক্ষে নগদ লভ্যাংশ অথবা রি-ইনভেস্টমেন্ট অথবা উভয় অপশন বিতরণের ঘোষণা করিবে যাহার পরিমান উক্ত স্কীমের বার্ষিক লাভের শতকরা ৭০ শতাংশ এর কম হইবে না। উল্লেখ্য, কমিশন কর্তৃক নিবন্ধকৃত সকল মেয়াদী মিউচ্যুয়াল ফান্ড এর ক্ষেত্রে অত্র বিধি/বিধান প্রযোজ্য হইবেঃ
তবে শর্ত থাকে যে, যেই সকল বর্ধিষ্ণু বিনিয়োগ স্কীমের প্রকৃতি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে শুরুতেই বিনিয়োগকারীদের সম্পূর্নরূপে জানানো হইয়াছিল উহাদের ক্ষেত্রে উক্ত লভ্যাংশ প্রদানের হার বার্ষিক লাভের অন্তত: পঞ্চাশ শতাংশ (৫০ শতাংশ) এর কম হইবে নাঃ
আরও শর্ত থাকে যে, উক্ত লভ্যাংশ সিদ্ধান্ত গ্রহণের পয়তাল্লিশ দিনের মধ্যে ইউনিট মালিকগনের নিকট বিতরণপূর্বক এতদসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে কমিশন, ট্রাস্টি ও হেফাজতকারীর নিকট দাখিল করিতে হইবে।’’
এর আগে গত ৮ জানুয়ারি বিএসইসি কর্তৃক প্রকাশিত চূড়ান্ত সংশোধনীতে ডিভিডেন্ড সংক্রান্ত বিধি- ৬৬ নিম্নোক্তভাবে সংশোধিত হয়:-
“৬৬। লভ্যাংশ বিতরণ ও উহার সীমা।- প্রত্যেক মিউচ্যুয়াল ফান্ড উহার বার্ষিক হিসাব সমাপ্ত হইবার পর প্রত্যেকটি স্কীমের বিপরীতে উক্ত স্কীমের ইউনিট মালিকগণের মধ্যে এই বিধিমালার আলোকে ও ট্রাষ্টির মতামত সাপেক্ষে প্রসপেক্টাস (prospectus) অথবা অফার ডকুমেন্ট (Offer Document) এ বর্ণিত লভ্যাংশ সংক্রান্ত ঘোষণা মোতাবেক নগদ লভ্যাংশ অথবা রি-ইনভেষ্টমেন্ট শেয়ার অথবা উভয় অপশন বিতরণের ঘোষণা করিবে যাহার পরিমাণ উক্ত স্কীমের বার্ষিক লাভের শতকরা ৭০ ভাগের কম হইবে না;
তবে শর্ত থাকে যে, যে সকল বর্ধিষ্ণু বিনিয়োগ স্কীমের প্রকৃতি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে শুরুতেই বিনিয়োগকারীদের সম্পূর্ণরূপে জানানো হইয়াছিল উহাদের ক্ষেত্রে উক্ত লভ্যাংশ প্রদানের হার বার্ষিক লাভের অন্তত: শতকরা পঞ্চাশ ভাগের কম হইবে না।”
“Reinvestment”(পুনঃবিনিয়োগ) এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে ‘নতুন ইউনিট ইস্যুর মাধ্যমে পুনঃবিনিয়োগের জন্য মুনাফার বন্টন’। Reinvestment বা পুনঃবিনিয়োগের জন্য নতুন ইউনিট ইস্যু করার অর্থ হলো ‘বোনাস ইউনিট ঘোষণা’।
জানা যায়, বাজারের নিরাপত্তা বলয় হিসাবে খ্যাত মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলোর অবস্থা ধীরে ধীরে নাজুক হয়ে পড়ায় বিনিয়োগকারীদের দাবির মুখে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ খাতের উন্নয়নে নজর দেয়। এ লক্ষ্যে প্রায় ২ বছর আগে মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিধিমালা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর এ বিষয়ে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণের পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে ‘মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিধিমালা-২০০১ (সংশোধনী)’ এর খসড়া জনমত যাচাইয়ের জন্য বিএসইসি’র ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। জনমত যাচাই এবং বিভিন্ন পর্যায়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি চূড়ান্ত সংশোধনী প্রকাশ করে বিএসইসি। চূড়ান্ত বিধিমালায় মিউচ্যুয়াল ফান্ডের স্টক ডিভিডেন্ডের বিষয়ে যে সংশোধনী আনা হয় তা বিনিয়োগকারীদের হতাশ করে। কারণ, বিনিয়োগকারীদের দীর্ঘ দিনের দাবি, সবগুলো ফান্ড যেন স্টক ডিভিডেন্ড দিতে পারে সে ব্যবস্থা করা। কিন্তু চূড়ান্ত সংশোধনী অনুযায়ী তালিকাভুক্ত পূর্বের ৪১টি ফান্ডের মধ্যে মাত্র ৪টি স্টক ডিভিডেন্ড দিতে পারবে। এগুলো হলো- এইমস ফার্স্ট, গ্রামীন-১, গ্রামীন-২ ও রিলায়েন্স ওয়ান। ফলে এ খাতের উন্নয়নে বিএসইসি সফলতার স্বাক্ষর রাখতে পারেনি বলে বিনিয়োগকারীরা মনে করেন।
একই খাতে কেন দ্বৈতনীতি এ বিষয়ে বিনিয়োগকারীরা ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বিনিয়োগকারীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যাপারে একাধিবার শেয়ারনিউজে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় সব মিউচ্যুয়াল ফান্ড বোনাস ঘোষণা করতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে বিদ্যমান আইন যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয়া হয়। কারণ, যে ৪টি ফান্ড বোনাস ঘোষণার সুযোগ পায় সেগুলো তালিকাভুক্তির সময় প্রসপেক্টাসে বিষয়টি উল্লেখ করে। কিন্তু অন্য ফান্ডগুলো প্রসপেক্টাসে বোনাস ঘোষণার বিষয়ে কিছু উল্লেখ করেনি। ফলে এ বিষয়ে আইনী জটিলতা নিরসনে বিএসইসি এটর্নী জেনারেলের দ্বারস্ত হয়। কিন্তু এরপর শুরু হয় কালক্ষেপণ।
এদিকে মিউচ্যুয়াল ফান্ড ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় জুন’১৩ সময়ে সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য লভ্যাংশ ঘোষণার ক্ষেত্রে বিপাকে পড়েছে। তাই এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত দেয়ার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে দাবি তোলেন বিনিয়োগকারী ও এ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের ৪৮৭তম সভায় সব মিউচ্যুয়াল ফান্ডকে বোনাস ঘোষণার সুযোগ প্রদানের অনুমোদন দেয় বিএসইসি।
প্রসঙ্গত, গত ৭ এপ্রিল সংশোধিত মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিধিমালার আওতায় পুর্নবিনিয়োগের শর্তে সব মিউচ্যুয়াল ফান্ড বোনাস ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারবে কি-না, এ বিষয়ে আইনী মতামত চেয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা এটর্নী জেনারেলের কার্যালয় এবং সংস্থার আইনজীবি মরহুম ড. এম জহিরের কাছে মতামত চেয়ে চিঠি প্রেরণ করে।
জবাবে মরহুম ড. এম জহিরের আইনি মতামতে উল্লেখ করা হয়- মেয়াদী ফান্ডগুলোর প্রসপেক্টাসে মেয়াদোত্তীর্ণের সময় নির্ধারিত থাকলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক ট্রাস্টি ডিডের সংশ্লিষ্ট শর্ত সংশোধন সাপেক্ষে ফান্ডগুলোকে বে-মেয়াদী ফান্ডে রূপান্তরের সুযোগ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও প্রসপেক্টাসে ফান্ডগুলোর নিজেদের ইউনিট ক্রয়-বিক্রয়ের ঘোষণা না থাকলেও ফান্ডগুলোকে নিজেদের ইউনিট ক্রয়-বিক্রয় করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। একইভাবে ট্রাস্টি ডিডের সংশ্লিষ্ট শর্তের সংশোধন সাপেক্ষে ফান্ডগুলোকে বোনাস ইউনিট ঘোষণার সুযোগ দেয়া যেতে পারে।
এটর্নী জেনারেলের কার্যালয় থেকে এ রকম ইতিবাচক মন্তব্য আসায় বিনিয়োগকারীরা এ খাতের প্রতি নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠেন। দ্রুত ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে যাচ্ছে এমন ধারণা থেকে অনেকে বিভিন্ন ফান্ডের ইউনিট ক্রয় করে ফাঁপড়ে পড়েন। কারণ, এরপর থেকে শুরু হয় কালক্ষেপণ। এমন পরিস্থিতিতে কতিপয় সিন্ডিকেট চক্র সাধারণ বিনিয়োগকারীদের একাধিকবার ঠকিয়ে ফায়দা হাসিল করে। তবে অবশেষে এ জটিলতার অবসান হওয়ায় স্বস্তিতে রয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।
যে ৩৭টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের প্রসপেক্টাসে বোনাস ঘোষণার সুযোগ ছিল না সেগুলোর ডিভিডেন্ড পলিসি নিম্নরূপ:
তালিকাভুক্ত ৩৭টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের প্রসপেক্টাস বা অফার ডকুমেন্টেরFund Highlights এরDividend অংশে ঘোষণা করা হয়েছে ‘‘Minimum 70% income of the Fund will be distributed as dividend in Bangladeshi Taka at the end of each accounting year.” অর্থাৎ ৩৭টি মিউচ্যুয়াল ফান্ডের প্রসপেক্টাসে বা অফার ডকুমেন্টে “প্রতি বছর শেষে আয়ের কমপক্ষে ৭০ শতাংশ ডিভিডেন্ড বাংলাদেশি টাকায় বিতরণ করা হবে” কথাটি উল্লেখ রয়েছে। প্রসপেক্টাসে বা অফার ডকুমেন্টে ডিভিডেন্ডের ধরণ ‘বাংলাদেশি টাকায়’ নির্দিষ্ট করে উল্লেখ থাকায় এই ৩৭টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড রি-ইনভেষ্টমেন্ট বা বোনাস ইউনিট ঘোষণা করতে পারবে না।
অপরদিকে, পূর্বে যে ৪টি মিউচ্যুয়াল ফান্ড রি-ইনভেষ্টমেন্ট শেয়ার ঘোষণা করতে পারত সেগুলোর ডিভিডেন্ড পলিসি নিম্নরূপ:
‘‘The Fund shall distribute at least 90 percent of the ‘Annual Income’ of the Fund, as dividend, at the end of each accounting year”. অর্থাৎ “প্রতি বছর শেষে বার্ষিক আয়ের কমপক্ষে ৯০ শতাংশ ডিভিডেন্ড হিসাবে বিতরণ করবে।” প্রসপেক্টাসে ডিভিডেন্ডের ধরণ অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকা অথবা রি-ইনভেস্টমেন্ট নির্দিষ্ট করে উল্লেখ না থাকায় সংশোধিত বিধিমালার আওতায় এইমস ও গ্রামীন-১ রি-ইনভেষ্টমেন্ট বা বোনাস ইউনিট কিংবা ক্যাশ ডিভিডেন্ড অথবা উভয় ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারবে।
উল্লেখ্য, এইমস ২০০৭ সালে ২০ শতাংশ বোনাস শেয়ার এবং গ্রামীন-১ ২০১১ সালে ৫০ শতাংশ বোনাস ইউনিট ঘোষণা করেছিল। বিএসইসি ফান্ড ২টির বোনাস ঘোষণা বাতিল করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রসপেক্টাসে ডিভিডেন্ডের ধরণ নির্দিষ্ট না থাকায় বিএসইসিকে শেষ অবধি বোনাস ঘোষণা মেনে নিতে হয়। এছাড়া, এইমস ২০১১ সালে রাইট ইউনিটও ঘোষণা করেছিল। এতেও বিএসইসি আপত্তি তোলে। কিন্তু বিএসইসি এক পর্যায়ে সেই রাইটও অনুমোদন দেয়।
গ্রামীন স্কীম-২ ও রিলায়েন্স ওয়ানের প্রসপেক্টাসে ডিভিডেন্ড পলিসি:
গ্রামীন-২ এবং রিলায়েন্স ওয়ানের প্রসপেক্টাসে উল্লেখ রয়েছে ‘‘Being a Growth Fund in nature, the Scheme shall distribute at least 50% (fifty percent) of the Annual Income of the Scheme, as dividend and entitlements, at the end of each accounting year.” অর্থাৎ “বর্ধিষ্ণু চরিত্রের হওয়ায় এই স্কীমগুলো প্রতি বছর শেষে বার্ষিক আয়ের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ডিভিডেন্ড হিসাবে বিতরণ করবে”। প্রসপেক্টাসে ডিভিডেন্ডের ধরণ নির্দিষ্ট না থাকায় সংশোধিত মিউচ্যুয়াল ফান্ড বিধিমালার আওতায় এই ২টি বর্ধিষ্ণু মিউচ্যুয়াল ফান্ডও রি-ইনভেষ্টমেন্ট শেয়ার বা বোনাস ইউনিট ঘোষণার সুযোগ পায়।