ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশের অর্থনীতি
১৮ দলীয় বিরোধী জোটের ৪র্থ দফার অবরোধ চলছে। এর মধ্যে দেশের অধিকাংশ জেলায় প্রায় প্রতিদিনই হরতাল চলছে। আর প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইন-শৃঙ্খলা সুষ্ঠু রাখতে ও জনগণের জান-মাল রক্ষার্থে যৌথ বাহিনীর অভিযান, গুলি, গ্রেফতার, মামলা, সাদা পোশাকধারীদের গুম চলছে। ইতোমধ্যে দেশের রপ্তানিমুখী শিল্প প্রায় ৩০% বন্ধ হয়ে গেছে। আর আমদানিতো প্রায় বন্ধ।
ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে অর্থনীতি। ধ্বংসের মুখে মানুষের জীবিকা। অচল হয়ে পড়ছে অর্থনীতি। গত দুই দশকের অর্থনীতির অর্জনগুলো ভেস্তে যেতে বসেছে। সরবরাহব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কমে গেছে উৎপাদন। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে। জীবন হাতে নিয়ে প্রতিদিন কাজে নামছেন স্বল্প আয়ের অসংখ্য মানুষ।
স্বাধীনতার পর দেশে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলন হলেও এখনকার মতো নৃশংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞ আর কখনো দেখা যায়নি। অর্থনীতির প্রতিটি খাতই বিপদে আছে। রপ্তানি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে, কমছে আমদানি, বিনিয়োগ নেই, ব্যাংক অলস অর্থের পাহাড় নিয়ে বসে আছে, প্রবাসী-আয় কমছে, বাড়ছে খেলাপি ঋণ। বড় ধরনের সংকটে পড়েছে পর্যটনশিল্প। রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব প্রথমবারের মতো শীতকালীন মেলা স্থগিত করে দিয়েছে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, ঢাকাভিত্তিক ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠান ঢাকা চেম্বার এবং পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর হিসাবে প্রতিদিন হরতালে ক্ষতি দেড় হাজার কোটি টাকা। নভেম্বর থেকে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ২৩ দিনই অবরোধ ও হরতাল হয়েছে। এই হিসাবে গত দেড় মাসে অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। আর দেশের রপ্তানির সবচেয়ে বড় শিল্প পোশাক খাতের মালিকেরা বলছেন, তাঁদেরই ক্ষতি তিন হাজার ২২০ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত ৪২ বছরে অর্থনীতিকে এতটা বিপর্যস্ত হতে আর কখনো দেখা যায়নি। টানা অবরোধ ও ধ্বংসাত্মক ঘটনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায়ই বন্ধ থাকছে। শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ও সরবরাহ কমে যাওয়ায় উৎপাদন কমেছে। কৃষিতেও উপকরণ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। অর্থনীতিতে সবদিকে এতটা অচলাবস্থা আর কখনো দেখা যায়নি।
উদ্যোক্তারা বলছেন, এই অবস্থা আর কিছুদিন চলতে থাকলে যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হবে, তা থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। বিশ্ববাজার হাতছাড়া হবে। কেননা, হরতাল-অবরোধে সড়ক, বন্দর ও গুদাম থেকে পণ্য সরবরাহ কার্যত বন্ধ হয়ে পড়েছে। সরবরাহ বন্ধ থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যও এখন স্থবির। অথচ বন্দরে ও বেসরকারি ডিপোতে পড়ে থাকা পণ্যের মাশুল গুনতে হবে ব্যবসায়ীদের। ব্যাংকঋণের টাকাও পরিশোধ করতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে ফেলার এমন দৃষ্টান্ত আগে কখনো দেখেননি বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি কাজী আকরামউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘দেশের দিকে কেউ তাকায় না, সবাই দলীয় স্বার্থ থেকেই কাজ করে। আর এর মধ্যে পড়ে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পণ্য-মানুষ কোনো কিছুই এগোতে পারছে না। এই অবস্থায় ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ব্যবসা করতে পারছেন না। তাঁরা এখন ভীত হয়ে পড়েছেন। মানুষ রাজনীতিবিদদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। আমরা আমাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে চাই। সরকারকে এর নিরাপত্তা দিতে হবে।’ গত দুই-তিন মাসে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গত সপ্তাহে বাংলাদেশ রিপোর্ট প্রকাশ করে বলেছে, হরতাল ও অবরোধের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে।সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটেছে। এতে এবার (২০১৩-১৪ অর্থবছরে) বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে হবে সাড়ে ৫ শতাংশ। গত অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমে গেলে প্রায় এক দশক ধরে ৬ শতাংশের ওপর গড় প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে রেকর্ড ছিল, তাও আর থাকছে না। বাংলাদেশে এর আগে সাড়ে ৫ শতাংশের কম মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০০২-০৩ অর্থবছরে, ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। আর এর মাধ্যমে নির্বাচনী বছরে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার রেকর্ডও অক্ষুণ্ন রাখছে বাংলাদেশ।
গবেষণাতেও দেখা যাচ্ছে, ১৯৯০-এর পর থেকে প্রতি নির্বাচনী বছরেই দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। যেমন, গত ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, অথচ আগের অর্থবছরেই ছিল ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। আবার ১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরটি ছিল নির্বাচনী বছর। ওই সময়ে জিডিপির প্রবৃদ্ধি আগের অর্থবছরের ৪ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে কমে হয় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। একইভাবে ২০০১-০২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয় ৪ দশমিক ৪ শতাংশ, আর এর আগের বছর ছিল ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আবার ২০০৭-০৮ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ২ শতাংশ হলেও পরের অর্থবছরটি ছিল নির্বাচনী বছর। সে সময়ে প্রবৃদ্ধি কমে হয় ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। এখন আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখা দিচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোতে একধরনের রাজনৈতিক নির্বাচনী চক্র দেখা যায়। নির্বাচনী বছরে সরকার ভোটারদের আকৃষ্ট করতে সরকারি ব্যয় বাড়ায়, করহার কমায়, সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতি গ্রহণ করে, সুদহার হ্রাস পায়। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়, সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ে। এসব পদক্ষেপের কারণে প্রবৃদ্ধিও বাড়ে। আবার একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতিও দেখা দেয়। ফলে নতুন সরকার এসে সংশোধনমূলক পদক্ষেপ নেয়, তাতে শুরুর দিকে আবার প্রবৃদ্ধি খানিকটা কমে। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে উল্টোটা। এখানে বরং নির্বাচনী বছরে প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে।
জাহিদ হোসেন আরও বলেন, বাংলাদেশে ১৯৯০-এর পর থেকে সরকার পরিবর্তনের পদ্ধতি নিয়ে পাঁচ বছর পর পর সংঘাত দেখা দিচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। তবে এবারের মতো সংঘাত ও অনিশ্চয়তা আর কখনো দেখা যায়নি। ফলে অর্থনীতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কৃষি ও শিল্প উৎপাদন প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
বিনিয়োগ মন্দা : দেশে বিনিয়োগ মন্দা চলছিল অনেক দিন ধরেই। মাঝখানে কিছুটা গতি এসেছিল। বিশেষ করে, বস্ত্র ও পোশাক খাতে বড় বিনিয়োগ হয়েছিল। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) হিসাবে গত জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে দুই হাজার ২০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, সেই বিনিয়োগ এখন তাঁদের গলার ফাঁস হয়ে গেছে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করা যাচ্ছে না। আবার উৎপাদনও বন্ধ করা যাচ্ছে না।
বিটিএমএর হিসাবে, প্রতি মাসে ১২ হাজার ট্রাক লাগে শুধু বস্ত্র খাতের তুলা ও সুতা পরিবহনে। অথচ এখন ট্রাকের মালিকেরা ভাড়ায় যেতে চান না। সরকার রপ্তানি পণ্য বোঝাই ট্রাক বন্দর পর্যন্ত যেতে পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা করলেও তাকে ঝুঁকিমুক্ত মনে করেন না ট্রাকমালিকেরা। গেলেও ১৫ হাজার টাকার ট্রাক ভাড়া এখন এক লাখ টাকা হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে বিটিএমএর সভাপতি জাহাঙ্গীর আলামিন বলেন, ‘তুলা আনা যাচ্ছে না। উৎপাদিত সুতাও এখন তৈরি পোশাক কারখানায় পৌঁছানো যাচ্ছে না। কীভাবে এর সমাধান হবে জানা নেই।’
বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় অনেক শিল্পেই ব্যাংকঋণ আটকে পড়েছে। সেপ্টেম্বর ২০১২ প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ চার হাজার কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৫৭ হাজার কোটি টাকা। নতুন ঋণ বিতরণ প্রায় নেই বললেই চলে। এই অবস্থায় বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কায় ব্যাংককে সুদ, ঋণ ব্লক করাসহ বিভিন্ন ছাড় দিতে হবে। তাতে সেবা খাতেও বড় প্রভাব পড়বে।