সমকামিতার আড়ালে
মাহামুদুর রহমান মাসুদ, পিরোজপুর থেকে: খবরটি চাঞ্চল্যকর। পিরোজপুর থেকে পালিয়ে ঢাকায় এসে দুই ‘সমকামী’ তরুণীর বিয়ে। যে খবর তোলপাড় সৃষ্টি করে চারদিকে। কিন্তু কথিত দুই সমকামী তরুণীকে মোহাম্মদপুর থেকে র্যাব গ্রেপ্তার করার পরই ঘটনা মোড় নেয় ভিন্ন দিকে। আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসতে শুরু করে সত্য। র্যাব-২ দুই তরুণীকে গ্রেপ্তারের পর সোপর্দ করে পিরোজপুর থানায়। সেখানে বসেই জানা যায় ঘটনার অন্তরালের ঘটনা। ঘটনার মূল নায়িকা অভিযুক্ত সানজিদা আক্তারের বিরুদ্ধে গত ২০শে জুলাই নারী পাচার ও অপহরণ আইনে একটি মামলা করেন অপহৃত শিলার পিতা কৃষ্ণ কান্ত শীল। গত বছর একই অভিযোগে থানা ও কোর্টে সানজিদার বিরুদ্ধে মামলা করেন চাঁদনী নামের এক মেধাবী ছাত্রীর ভাই রেজাউল করিম মাসুদ। সানজিদা ও শিলাকে থানায় আনার সময় মাসুদ বলেন, সানজিদা আমার বোন চাঁদনীকে অপহরণ করেছিল। আমি বিদেশে থাকতাম, বোনকে উদ্ধারের জন্য দেশে ফিরে আসি। মামলার পর পুলিশের সহযোগিতায় আমার বোনকে বরিশাল থেকে উদ্ধার করি। বিদেশ থাকাকালে বোনকে অনেক স্বর্ণালঙ্কার পাঠিয়েছি। এর পুরোটাই ওই সানজিদা হতিয়ে নেয়। চাঁদনী ৫ম ও ৮ম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া সত্ত্বেও ওর কারণে আমার বোনের লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। একথা বলে তিনি সকলের সামনে কান্নায় ভেঙে পরেন। এ সময় অঝোর ধারায় কাঁদছিলেন কৃষ্ণকান্ত শীলও। আরও এক মেয়ের পিতা এ সময় সানজিদার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেন। সব অভিযোগ বিশ্লেষণে জানা যায়, সানজিদা মেয়েদের ভালবাসার ফাঁদে পেলে মানসিকভাবে অসুস্থ করে ফেলে। এরপর হাতিয়ে নেয় ওই সব পরিবারের টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার। শিলা অপহরণের পর সানজিদা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শিলার মা-বাবা ও বোনের কাছে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এরপর দেড় লাখ টাকায় সমঝোতার নামে গ্রেপ্তারের ফাঁদ পাতে পুলিশ। শিলার পিতা সেজে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই বাদল কৃষ্ণ মুক্তিপণের দেড় লাখ টাকা নিয়ে র্যাবের সহায়তায় অভিযুক্ত সানজিদাসহ শিলাকে ঢাকার মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদীয়া হাউজিংয়ের ৫ নম্বর রোডের ১১ নম্বর ময়না ভিলায় ‘সুখের ঠিকানা’ নামক বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পিরোজপুর নিয়ে আসেন। এদিকে ঘটনার মূল হোতা সানজিদা আক্তার সম্পর্কে এলাকাবাসী দিয়েছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তার বাড়ি পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া হলেও গত সাত-আট বছর সে পিরোজপুরের বিভিন্ন এলাকায় বাসা ভাড়া করে থেকে মেয়েদের অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে এ জাতীয় কাজ ছাড়াও নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিল। অনেকে বলছেন, সানজিদা নারী পাচারকারী দলের সদস্য। এছাড়া আরও জানা যায়, সে কিছুদিন পর পর ঠিকানা পরিবর্তন করে। তাছাড়া সে বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবনের সঙ্গেও যুক্ত। দশম শ্রেণীর ছাত্রী শিলা রানীর মা কনক রানী জানান, গত দুই মাস আগে সে আমার বাসার পাশেই একটি রুম ভাড়া নেয়। এরপর থেকে ঘনিষ্ঠ ভাবে আমার মেয়ের সঙ্গে মিশতে শুরু করে। আমাকে সে বলে, শিলা অনেক বড় হবে। আমাকে বিনা টাকায় তাকে পড়ানোর সুযোগ দেন। যেহেতু আমার মেয়ে শিশু সে-ও একটি মেয়ে, তাই আমি সুযোগ দেই, কিন্তু ওই মেয়ে যে এমন কাজ করতে পারে আমি তা ভাবিনি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সানজিদার পরিবার থাকে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায়। তার পিতা চাঁদপুরে চাকরি করেন। এ প্রসঙ্গে তার পিতা সোবাহান বিএসসি জানান, মেয়েকে শাসন করেছি। তবে কোন ভাবেই তাকে ঠিক করতে না পেরে ওকে ওর নিয়তির হাতে ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের সঙ্গে ওর কোন যোগাযোগ নেই। মহিলা কলেজের হলে থাকাকালে একই অভিযোগে তাকে হল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
ঢাকায় গ্রেপ্তারের পর এ বিষয়ে সানজিদা র্যাবকে জানায়, আমরা একে অপরকে দীর্ঘদিন ধরে ভালবাসি। ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে আমরা ঢাকায় এসেছি। হিন্দুশাস্ত্র মতে সোমবার সন্ধ্যায় ওই বাসায় সিঁদুর পরিয়ে আমি শিলাকে বিয়ে করেছি। শিলাও জানায়, একটা ছেলে যদি একটা মেয়েকে ভালবাসতে পারে, তবে একটা মেয়ে কেন আরেকটা মেয়েকে ভালবাসতে পারবে না? কিন্তু পিরোজপুর নিয়ে আসার পর তারা দু’জনই নতুন কথা বলতে শুরু করে। তারা বলে শুধু মাত্র বন্ধুত্বের কারণেই আমরা ঢাকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। এ সময় সানজিদা তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে। সানজিদা জানায়, কোন মেয়েও আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারবে না। শিলাও আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করবে না। আমি তাকে অপহরণ করিনি। ও নিজের ইচ্ছায় আমার কাছে প্রথমে বরিশাল গেছে, পরে সেখান থেকে ওকে নিয়ে ঢাকায় বেড়াতে যাই। পিরোজপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা জানান, প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে সমকামিতার আড়ালে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের বিষয় জড়িত। পুরোপুরি তদন্ত শেষে মূল রহস্য উন্মোচিত হবে। সানজিদার বিরুদ্ধে আগেও মামলা হয়েছে। তবে অপহৃত মেয়েরা সানজিদার পক্ষে অবস্থান নেয়ায় তার বিপক্ষে শক্তিশালী কোন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি। শিলা অপহরণ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বাদল কৃষ্ণ সরকার জানান, মামলা দায়েরের পর মুক্তিপণের টাকা দেয়ার কথা বলে এবং মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে অভিযুক্ত সানজিদার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে র্যাবের সহযোগিতায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়। সানজিদা পিরোজপুর সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের বাংলা অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী, শিলা পিরোজপুর করিমুন্নেসা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্রী।