নির্বাচনী সহিংসতায় সারাদেশে নিহত ২১

Electionউৎসবের আমেজ ছিল না। ছিল না বিরোধী দল। ৫২ ভাগ ভোটারের ভোট নেই। ভোট নেই রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারের। ১৫৩ আসনে নির্বাচন ছিল না। তবে ছিল উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা সর্বত্র। বিদেশী পর্যবেক্ষকরাও ভোট পর্যবেক্ষণ বর্জন করেছিলেন। তাদের উপস্থিতি সাকুল্যে ছিল মাত্র চারজন। তবুও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। রোববার সকাল ৮টায় শুরু হয়ে বিকেল ৪টায় শেষ হয় নির্বাচন। ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি হাতে গোনা। কোনো কোনো কেন্দ্রে একটি ভোটও পড়েনি। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে একই অবস্থা দেখা গেছে।
১৮ দলের সাথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে অন্তত ২১ জন নিহত হয়েছে।
নওগাঁয় একজন বিএনপিকর্মী, ফেনীর সোনাগাজীতে দুজন ছাত্রদল-যুবদলকর্মী, লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে একজন শিবিরকর্মী, রংপুরে দুজন জামায়াতকর্মী, নীলফামারীতে দুজন জামায়াতকর্মী, দিনাজপুরে মোট পাঁচজন, দিনাজপুরের বীরগঞ্জে একজন, ঠাকুরগাঁওয়ে সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারসহ পাঁচজন, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় এক শিবিরকর্মী নিহত হয়েছেন।
দিনাজপুর-১ (বীরগঞ্জ-কাহালুর) আসনের ৭৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৫৫টি কেন্দ্রে অগ্নিসংযোগের পর নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রের নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা পালিয়ে গেছেন বলে জানা গেছে। দুপুরে ঠাকুরগাঁও-১ (সদর) আসনের ১৬২টি কেন্দ্রের সবগুলোর ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়।
আমাদের ঠাকুরগাঁও সংবাদদাতা জানান, ঠাকুরগাঁও ১ আসনে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় চারজন নিহত হয়েছে। তারা সবাই ১৮ দলীয় সমর্থক। এছাড়া একজন সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার নিহত হয়েছেন।
রোববার দুপুরে সদর উপজেলার খোঁচাবাড়ী বাসুদেবপুরে পুলিশের গুলিতে জয়নাল আবেদিন (৩০), হারুন (৪৫) এবং গড়েয়া গোপালপুরে আবু হানিফ (৩২), লুৎফর রহমান (৪৫) নিহত হয়েছেন।
সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট ও গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার একটি কেন্দ্রেও ভোট শুরু হয়নি। দুই উপজেলার ১৮ দলের নেতাকর্মী ও বিুব্ধ জনতা প্রায় সবগুলো ভোটকেন্দ্র দখল করে রেখেছে। বন্ধ রয়েছে রংপুরের ৪২টি কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ। এই জেলায় সকাল ১০টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে মাত্র দশমিক ৩৮ শতাংশ। বগুড়ার গাবতলী মডেল থানায় ১৮ দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী হামলা চালিয়েছে। এসময় কয়েকজন পুলিশ সদস্য পেছনের দরজা দিয়ে উপজেলা পরিষদে গিয়ে আশ্রয় নেন। প্রতিরোধের মুখে এই জেলার প্রায় অর্ধশত কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়েছে। কুমিল্লার মনোহরগঞ্জের চারটি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত রয়েছে। এখানে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে ব্যালট বাক্স ছিনাতাইয়ের চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। উত্তরা থেকে নয়া দিগন্তের এক পাঠক ফোন করে জানিয়েছেন সেখানের বেশির ভাগ কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নেই। কুষ্টিয়ায় ভোটার লাইনে দাঁড়িয়েছেন ভাড়া করা লোক। মাহবুব-উল হানিফ ভোট দিতে এলে এটি করা হয়। হানিফের ভোট শেষে চলে যান তারা। সকাল ৯টা পর্যন্ত ঝিনাইদহের ৩০ কেন্দ্রে ভোট দিয়েছেন মাত্র তিনজন। জামালপুরে স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেন। দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ১১টি ভোটকেন্দ্রে এবং কাহারোল উপজেলায় ৩টি ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ, ব্যালট পেপার ছিনতাই, প্রিজাইডিং অফিসারের তিনটি মোটর সাইকেল ও চারটি বাইসাইকেলে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ দুই উপজেলার ১৪টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ স্থগিত রয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনকে বলছে সংবিধান রক্ষার নির্বাচন। তবে বিরোধী দল রোববারের নির্বাচনকে বলছে একদলীয় শাসন কায়েমের নির্বাচন। বাংলাদেশের এই নির্বাচনে ভারত ও ভুটানের চারজন পর্যবেক্ষক ছাড়া আর কোনো বিদেশী পর্যবেক্ষক নেই। ভারত ছাড়া আর কোনো দেশ সমর্থন দেয়নি এই নির্বাচনে।
বাংলাদেশে সাধারণত নির্বাচন মানেই উৎসব। ভোটকেন্দ্রে দীর্ঘ লাইন। দুই বড় দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মর্যাদার লড়াই। আর থাকে টান টান উত্তেজনা। সেই উত্তেজনা সহিংস নয়, বরং কে হারে কে জেতে তা দেখার অপেক্ষায়।
কিন্তু এবার তার ব্যতিক্রম। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৩৭টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ ১২টি দল এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। আর প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ ২৫টি দল এই নির্বাচন বর্জনের পর প্রতিহতে একই সাথে হরতাল অবরোধ পালন করছে। বিরোধীরা চায় নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। আর সরকারি দল সে দাবিতে কান না দিয়ে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করছে।
এই রাজনৈতিক সংকট সমাধানে অনেক আলোচনা হয়েছে। বিদেশী কূটনীতিকরা চেষ্টা করেছেন, চেষ্টা করেছে জাতিসঙ্ঘ। শেষ পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় দুই দলের মহাসচিব পর্যায়ে আলোচনাও হয়েছে। কিন্তু সমাধান আসেনি। কমেনি সংঘাত, সহিংসতা। গত ২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে শনিবার পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় শতাধিক নিহত হয়েছেন। আর সহিংসতা থেমে নেই। নির্বাচন কেন্দ্রে আগুন দেয়া হচ্ছে। পুড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ব্যালট পেপার। কেন্দ্রগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় পুড়ছে নতুন বছরের বই।
আজকের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনের প্রার্থীরা আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। তাই নির্বাচন হচ্ছে বাকি ১৪৭ আসনে। এতে মোট ভোটার ৪,৩৯,৩৭,৯৩৭ জন। প্রার্থী ৩৯০ জন। মোট ভোটারের ৫২ ভাগের ভোট দেয়ার সুযোগ নেই। এমনকি ভোট দিতে পারছেন না রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ অ্যাডভোকেট, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ। নির্বাচন কমিশন নির্বাচন বিরোধীদের সহিংসতার আশঙ্কায় ১৯ জেলার ৮০টি ভোট কেন্দ্রকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিদেশী পর্যবেক্ষক ছিলেন ৫৮৫ জন। এবার ভারত ও ভুটান থেকে দু’জন করে মোট চার জন পর্যবেক্ষক এসেছেন।
নির্বাচনের আগেই এবার সারা দেশে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। আরো আছে পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমেদ আশা করেন, ভোটাররা শান্তিপূর্ণভাবে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবেন।
বাংলাদেশের নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করেন, রোববারের নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতিই হবে নির্বাচন কমিশনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীর বলেছেন, সহিংসতায় শঙ্কিত না হয়ে জনগণ ভোটকেন্দ্রে গিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দেবে। তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়।
এদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেছেন, রোববারের নির্বাচন হাস্য-কৌতুকে পরিণত হয়েছে। তিনি দাবি করেন, সরকার রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া এবং জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button