ভিজিট ভিসায় জামানত নিয়ে হোম অফিসে কথা হবে
সৈয়দ আনাস পাশা: শুধু নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের জন্য ব্রিটিশ ভ্রমণ ভিসায় ৩ হাজার পাউন্ড জামানত বাধ্যতামূলক করার পরিকল্পনা বৈষম্যমূলক বলে মন্তব্য করেছেন ব্রিটেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মিজারুল কায়েস। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর হাইকমিশনারদের সঙ্গে পরামর্শ করে বিষয়টি নিয়ে ব্রিটিশ হোম অফিসের সঙ্গে আলোচনার একটি পরিকল্পনা করছেন তিনি। সোমবার ব্রিটিশ রাজনীতিকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠক শেষে হাইকমিশন ভবনে এ প্রতিবেদককে তিনি এ কথা জানান।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়া হোম অফিসের দায়িত্বে নিয়োজিত হাউস অব লর্ডসের একজন সদস্যের কাছেও বিষয়টি তুলেছেন বলে জানান মিজারুল কায়েস।
তিনি বলেন, “যেসব দেশের নাগরিকদের জন্য ব্রিটিশ হোম অফিস ভিজিট ভিসায় জামানত আরোপ করতে যাচ্ছে, সেসব দেশের হাইকমিশনারদের সঙ্গে পরামর্শ করে বিষয়টি নিয়ে হোম অফিসে আলোচনা করা যায় কিনা তা নিয়েও চিন্তা-ভাবনা করছি।”
মিজারুল কায়েস বলেন, “কেবল নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের জন্য জামানত আরোপ শুধু সংশ্লিষ্টদের চোখেই নয়, সবার কাছেই বৈষম্যমূলক মনে হওয়া স্বাভাবিক।”
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, “এই আইনটি কার্যকর করার আগে হোম অফিস বিষয়টি আবারও বিবেচনা করবে এমনটাই আমরা আশা করছি।”
সংশ্লিষ্ট দেশের কমিউনিটি সংগঠনগুলোরও এ বিষয়ে হোম অফিসের সঙ্গে লবি করা উচিত বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশের হাই কমিশনার।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশসহ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নাইজেরিয়া, ঘানা ও কেনিয়ার নাগরিকদের জন্যে আগামী নভেম্বর থেকে ভিজিট ভিসায় ৩ হাজার পাউন্ড জামানত প্রথা প্রবর্তনের পরিকল্পনা করছে ব্রিটিশ হোম অফিস। ব্রিটেনের মূলধারার মিডিয়াগুলোতে এ খবর প্রকাশ হলে শুরু হয় সমালোচনা। সংশ্লিষ্ট দেশের কমিউনিটিগুলোতে এ নিয়ে দেখা দেয় অসন্তোষ।
ফ্যামিলি ভিসায়ও কড়াকড়ি আরোপের পর ভ্রমণ ভিসায় জামানতের এই উদ্যোগ মরার ওপর খাঁড়ার ঘা বলেই মন্তব্য করেন বিভিন্ন কমিউনিটি সংগঠনের নেতারা।
এদিকে, নভেম্বর থেকে ভিজিট ভিসায় ৩ হাজার জামানত চালুর খবরে তীব্র প্রতিবাদ জানায় অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কর্মরত ব্রিটেনের সর্ববৃহৎ সংগঠন জয়েন্ট কাউন্সিল ফর দ্যাওয়েলফেয়ার অব ইমিগ্রেন্টস(জেসিডব্লিউআই) ও বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন।
ভ্রমণ ভিসায় জামানত আরোপের পরিকল্পনার খবরে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সংগঠন দু’টি জানায়, এটি একটি বৈষম্যমূলক নিয়ম, অমানবিকও বটে। বাংলাদেশ বা ভারতের মতো দেশের একজন নাগরিকের জন্য ৩ হাজার পাউন্ড অনেক অর্থ। সরকারের এসব বৈষম্যমূলক নতুন নতুন ইমিগ্রেশন পলিসির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ জানানোর জন্যও সংখ্যালঘু কমিউনিটি সংগঠনগুলোর প্রতি আহবান জানায় তারা।
মূলত অস্ট্রেলীয় আদলে পরীক্ষামূলকভাবে এই ‘বন্ড’ চালু হচ্ছে- হোম অফিস সূত্রে এমনটাই জানা গেছে। আরো জানা গেছে, এই পরীক্ষামূলক ব্যবস্থায় সাফল্য এলে তা ধীরে ধীরে কার্যকর করা হবে অন্যান্য দেশের ক্ষেত্রেও।
এ প্রসঙ্গে ব্রিটিস হোম সেক্রেটারি টেরেসা মে বলেন, “ভ্রমণকারী নির্ধারিত সময়ের বেশি ব্রিটেনে থাকতে আগ্রহী হবে না, এমন একটি দীর্ঘমেয়াদী জামানত সিস্টেম চালু করার পরিকল্পনা করছি আমরা। এতে কোন বিদেশি নাগরিক সরকারি সেবা নিলে যে খরচ হয়, সেই খরচও তুলে আনা সম্ভব হবে বলে আমরা মনে করছি।”
জেসিডব্লিউআই এর চিফ এক্সিকিউটিভ হাবিব রহমান বাংলানিউজকে বলেন, “এটি শুধু বৈষম্যমূলক নয়, অমানবিকও বটে।”
তিনি বলেন, “বাংলাদেশসহ সাতটি দেশকে ঝুকিপূর্ণ অভিযুক্ত করে শুধু এসব দেশের ভ্রমণ পিপাসুদের উপর জামানত প্রথা চালুর হোম অফিসের পরিকল্পনা মোটেই বিবেচনাপ্রসূত নয় বলেই আমরা মনে করি।”
জেসিডব্লিউআই চিফ এক্সিকিউটিভ বলেন, “এর আগে ফ্যামিলি ভিসায়ও যে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে তারও ভিক্টিম হয়েছে এসব দেশের নাগরিক। একজন বাংলাদেশি ইমিগ্র্যান্টসের যেখানে ১০ হাজার পাউন্ড বার্ষিক বেতনের চাকরি জোটানোই অসম্ভব, সেখানে স্ত্রী বা স্বামী আনতে বার্ষিক আয় নির্ধারণ করা হয় ১৮ হাজার ৬শ’ পাউন্ড। ফলে অনেক দম্পতিই ব্রিটেন ও বাংলাদেশে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছেন।”
তিনি বলেন, “৩ হাজার পাউন্ড বাংলাদেশ বা ভারতের মতো দেশের একজন নাগরিকের জন্যে অনেক অর্থ। ভ্রমণের পুরোপুরি খরচ যোগানোর পাশাপাশি এখন এই ৩ হাজার পাউন্ড অতিরিক্ত অর্থও তাদের জোগাড় করতে হবে। শুধু ৭টি দেশের ভ্রমণ পিপাসুদের জন্যে এই নিয়ম অবশ্যই অমানবিক বলে আমরা মনে করি।”
সরকারের এসব বৈষম্যমূলক নতুন নতুন ইমিগ্রেশন পলিসির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করতে সংখ্যালঘু কমিউনিটি সংগঠনগুলোর প্রতি আহবান জানান হাবিব রহমান।
ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম বলেন, “ব্রিটেনের অভিবাসী কমিউনিটি দেশটির অর্থনীতিতে যে কতটুকু অবদান রাখছে তা সবাই জানে। ব্রিটিশ অর্থনীতিতে বাংলাদেশ, ভারতসহ ব্রিটিশ হোম অফিসের ভাষায় ‘ঝুকিপূর্ণ’ ৭টি দেশের জনগণের অবদানও বিভিন্ন সময় উঠে এসেছে সরকারেরই বিভিন্ন রিপোর্টে।”
তিনি বলেন, “আমাদের সংষ্কৃতিগত ঐতিহ্যের কারণে বৃহত্তর পরিবারের সবাইকে নিয়ে আমরা আমাদেরসন্তানদের বিয়ে-শাদির অনুষ্ঠানের ইচ্ছে মনে পোষণ করি। সম্প্রতি ফ্যামিলি ভিসার কড়াকড়ির কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও নিজেদের ছেলেমেয়েদের আমরা এখন দেশে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করতে পারি না। নিজের একজন আত্মীয়ও যে আমাদের দেখতে আসবেন, ভ্রমণ ভিসায় জামানত প্রথা চালুর মাধ্যমে ব্রিটিশ হোম অফিস এই সুযোগও বন্ধ করে দিচ্ছে।”
নুরুল ইসলাম বলেন, “এটি এথনিক কমিউনিটির প্রতি সরকারের একটি বৈষম্যমূলক আচরণ বলেই আমরা মনে করি। এ বিষয়ে প্রতিবাদী হওয়ার জন্যে সবার প্রতি আহবান জানাই।”
উল্লেখ্য, গত বছর ফ্যামিলি ভিসার ক্ষেত্রে স্বামী বা স্ত্রী আনতে হলে স্পন্সরের নুন্যতম ১৮ হাজার ৬০০ পাউন্ডের বার্ষিক আয় থাকতে হবে, এমন নিয়ম চালু করে হোম অফিস। যদি কোন দম্পতির এক সন্তান থাকে তবে এই অংক ২২ হাজার ৪শ’ পাউন্ডে দাঁড়াবে। পরবর্তী প্রতি সন্তানের ক্ষেত্রে ২ হাজার ৪শ’ পাউন্ড করে যুক্ত হবে মূল আয় ১৮ হাজার ৬শ’ পাউন্ডের সঙ্গে।