যেভাবে থেমে গেল নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড
ফখরুজ্জামান চৌধুরী
যে সাম্রাজ্যের গোড়া পত্তন হয়েছিল দ্বীপ-মহাদেশ অস্ট্রেলিয়ায়, কালক্রমে তার বিস্তার ঘটে এশিয়া, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এক জীবনে এতো অর্জন খুব কম লোকের ভাগ্যেই ঘটে থাকে। তাকে একদা দেশছাড়া করার সংকল্পের কথা ঘোষণা করেছিলেন যে আরেক অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া মুঘল, কিছুকাল পাদপ্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল উপস্থিতির পর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গেলেন তিনি। স্যার কেরি ফ্রান্সিস বুলমোর প্যাকার বয়সে ছোট ছিলেন কিথ রূপার্ট মারডকের (১১ মার্চ, ১৯৩১-)। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান প্রথম মিডিয়া মুঘল হিসেবে তার নামই উচ্চারিত হতো সর্বত্র। নানা রকম চমক সৃষ্টিতে তার জুড়ি মেলা ছিল ভার!
স্যার ফ্রাংক প্যাকার ও গ্রেটেল বুলমোর দম্পতির প্রথম সন্তান জীবনাচরণে ছিলেন বেহিসেবি। বিতর্ক জন্ম দিতেই তিনি ভালবাসতেন। অস্ট্রেলিয়ার আয়কর বিভাগের সঙ্গে প্রতিনিয়ত ঝগড়া- বিতর্কে জড়ানো ছিল যেন তার কাছে আনন্দময় খেলা! জনপ্রিয় স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল নাইন (৯)-এর জন্য ক্রিকেট খেলা প্রচারের স্বত্ব দাবি করে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট কর্তৃপক্ষের কাছে নেতিবাচক জবাব পেয়ে এতোটাই রুষ্ট হলেন যে, বিশ শতকের সত্তরের দশকে বিশ্বের নামীদামি ক্রিকেটারদেরকে নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ক্রিকেট সংস্থাসমূহের অস্তিত্ব ধরেই টান দিয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালে তিনি চালু করলেন ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট-যাতে অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিলেন ভারত ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য দেশের সেরা ক্রিকেটাররা। আর খেলোয়াড়দেরকে বিদ্রোহ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন একদা ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের অধিনায়ক টনি গ্রেগ।
কেরি শুধু চেয়েছিলেন তার চ্যানেল-৯ ক্রিকেট ম্যাচ প্রচার স্বত্ব লাভ করুক। ১৯৭৬ সালের চূড়ান্ত বৈঠক থেকে যখন তাকে না করেছিল অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট কর্তৃপক্ষ, ক্ষুব্ধ কেরি সভায় দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে বলেছিলেন, ‘আমাদের সবার মধ্যেই রয়েছে বারবনিতার কিঞ্চিৎ সত্তা। ভদ্র মহোদয়গণ, দয়া করে বলবেন কি, এতো দামে বিক্রি হবেন?’
পরবর্তী ঘটনা ইতিহাস, কেরি প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রাতিষ্ঠানিক ক্রিকেট মুখ থুবড়ে পড়ে। পরবর্তীকালে কেরির সঙ্গে সমঝোতা করে এবং খেলোয়াড়দের স্বার্থ রক্ষা করে চুক্তির বলে বর্তমান ক্রিকেট হাল পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাপী ক্রিকেটাররা কেরিকে স্মরণ করেন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে।
আর দ্বিতীয় অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া মুঘল রূপার্ট মারডকের জন্ম মেলবোর্নে। স্যার কিথ মারডক ও এলিজাবেথ জয়-এর একমাত্র সন্তান বেড়ে উঠেছেন ধনী সংবাদপত্র ব্যবসায়ী পরিবারে। সন্তানকে পারিবারিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত করার আগে যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করার জন্য ভর্তি করে দেন মারডক দম্পতি।
রূপার্টের যখন ২১ বছর, পিতা মারা গেলেন। যুক্তরাজ্য থেকে ফিরে এসে তরুণ বয়সে পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব নিতে হলো তাকে। সেটা ১৯৫৩ সালের কথা। এডেলেইডের একটি সংবাদপত্র দিয়ে শুরু হলো তার মিডিয়া সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন। এরপর অস্ট্রেলিয়ার আরও দু’ একটি রুগ্ণ সংবাদপত্রের মালিকানা কিনে নিলো তার কোম্পানি নিউজ লিমিটেড।
১৯৭২ সালে মারডক সিডনির সকাল বেলার ট্যাবলয়েড দি ডেইলি টেলিগ্রাফ কিনে নিলেন স্যার ফ্রাংক প্যাকারের কাছ থেকে। পরবর্তীকালে স্যার ফ্রাংক এই বিক্রয় কাজের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন। অন্যদিকে এই বেচাকেনাকে মারডক তার প্রতিপত্তি বৃদ্ধির সূচক হিসেবে বিবেচনা করতেন। তরুণ কেরি প্যাকার এই পত্রিকার মালিকানা বদলকে খুব ভালো চোখে দেখেননি। তিনি নাকি তার অন্তরঙ্গদের এই সময়ে বলেছিলেন, মারডকের জীবনকে তিনি কষ্টকর করে তুলবেন।
১৯৫০-এর দশকে অস্ট্রেলিয়ায় টিভি নেটওয়ার্কে মারডক তার ব্যবসায়িক সংশ্লিষ্টতার সূচনা করেন। চ্যানেল-৭ নামক এই বাণিজ্যিক চ্যানেলটি কেরি প্যাকারের চ্যানেল-৯ এর সঙ্গে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে থাকে। বিভিন্ন রকম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান, যেমন ‘সেলস অফ সেঞ্চুরি’ প্রচার করেও দর্শক ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় তার চ্যানেলটি। পরবর্তীকালে তিনি তার টিভি চ্যানেলটি বিক্রি করে দেন। নিউজ করপ, অস্ট্রেলিয়ার ব্যবসা শুধু সীমাবদ্ধ থাকলো প্রিন্ট মাধ্যমে।
যুক্তরাষ্ট্রে মারডকের প্রথম টেলিভিশন ব্যবসায়ে বিনিয়োগ হলো ১৯৮৬ সালে যখন ফক্স ব্রডকাস্টিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হলো। ২০০০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান লগ্নিকারক হিসেবে শেয়ার বাজারে তার নাম তালিকাভুক্ত হলো। স্যাটেলাইট টেলিভিশন, চলচ্চিত্র ও ইন্টারনেট ব্যবসায় প্রচুর মূলধন বিনিয়োগ করলেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে রূপার্ট মারডকের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগটি ঘটে প্রভাবশালী ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে। চার্লস ডাও, এডওয়ার্ড জোনস ও চার্লস বার্গট্রেসার ১৮৭৪ সালে যে পত্রিকাটির যাত্রা শুরু করেন তৎকালীন সময়ে অত্যন্ত সাদামাটাভাবে, তা যে একদিন সময়ের বিবর্তনে এবং পরিচালনার দক্ষতার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক বিক্রীত এবং বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকায় পরিণত হবে, তা অনেকেই ভাবতে পারেননি।
২০০৭ সালের মে মাসে রূপার্ট মারডক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিটি শেয়ার তার অভিহিত মূল্যের তিন গুণ বেশি দাম দিয়ে কেনার ঘোষণা দিয়ে নিউ ইয়র্কের স্টক মার্কেটে চমক সৃষ্টি করেন। পত্রিকার তৎকালীন মালিক ব্যানক্রফট পরিবার অনেক দেন-দরবারের পর ৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মালিকানা রূপার্ট মারডকের নিউজ করপ-এর কাছে হস্তান্তর করলেন। বিশ্ব মিডিয়ায় খবরটি প্রচারিত হলো এই শিরোনামে: ‘মারডকের ডাও জোনস-এর মালিকানা অর্জন!’
বিশ্বব্যাপী মিডিয়া জগতে রূপার্ট মারডক তার আধিপত্য বিস্তার করে চললেন অপ্রতিরোধ্য গতিতে। একটা সময়ে তাকেই একমাত্র তার নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনা করতে শুরু করলেন মিডিয়া সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে যে ট্যাবলয়েড নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড-এর কারণে একদা নন্দিত মিডিয়া মুঘল এখন নিন্দিত এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নিজের কৃতকর্মের জবাবদিহি করতে গিয়ে সংক্ষুব্ধ এক ব্যক্তির আক্রমণের শিকার হলেন, সেই রবিবাসরীয় সাপ্তাহিকটির মালিকানা তিনি কিনেছিলেন ১৯৬৮ সালে। শোনা যায়, তার মা এই পত্রিকা কিনতে পুত্রকে বার বার নিষেধ করেন এই বলে যে, এই পত্রিকা তোমার জন্য নয়! এই সাপ্তাহিকীর মালিকানা অর্জনের পর তিনি একে একে কিনে নেন ব্রডশিট পত্রিকা দি সান, দি টাইমস, দি সানডে টাইমস।
শুধু পত্রিকার মালিকানাই অর্জন করলেন না মারডক, ব্রিটিশ রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক হিসেবেও তার আবির্ভাব ঘটলো। ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে রূপার্ট মারডক ব্রিটিশ রাজনীতিতে রক্ষণশীল দলের প্রার্থী মার্গারেট থ্যাচারকে নির্বাচনে সমর্থন করলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি টনি ব্লেয়ারের দল লেবার পার্টিকেও সমর্থন করেন। টনি ব্লেয়ারের সঙ্গে তার নিবিড় সখ্য ব্রিটিশ রাজনীতিতে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়।
রূপার্ট মারডক বুঝতে পারেন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক এবং মাঝে মাঝে তার সঙ্গে জাতীয় সমস্যা নিয়ে বৈঠকের খবর প্রকাশ হওয়ার ফলে তার ও তার ব্যবসা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য তিনি তার মালিকানাধীন দি সান পত্রিকাকে নিয়োজিত করেন ডেভিড ক্যামেরনের রক্ষণশীল দলকে সমর্থন করতে!
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া এক অদভুত সম্পর্কে সম্পর্কিত। এখনো দেশটি বৃটেনের রানীর প্রতিনিধি গভর্নর জেনারেল দ্বারা শাসিত। অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রীয় পরিচয় কমনওয়েলথ অফ অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের গর্বিত অধিবাসীদের মনে আছে, একদা তাদের দেশের দাগি অপরাধীদেরকে নির্বাসনে পাঠানো হয় দ্বীপ দেশটিতে। ক্যাপ্টেন জেমস কুক নামক একজন ইংরেজ নৌ-পরিব্রাজক এন্ডেভার নামক জাহাজে চড়ে সাগর পথে অভিযান চালিয়ে ১৭৬৯ সালে অস্ট্রেলিয়া নামক বিশাল দ্বীপ দেশটি আবিষ্কার করেন এবং ইংরেজদের কর্তৃত্বাধীনে দেশটি দীর্ঘ দুই শতাধিক বছর ধরে আছে।
গত শতকের আশির দশকে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানকালীন দেখেছি, একজন অস্ট্রেলিয়ান হাসতে হাসতে নিজের পরিচয় দেয়, ‘পমিজ বাস্টার্ড’ বলে। পম মানে ইংরেজ আর বাস্টার্ডের বাংলা নাই বা বলা হলো। আর সিডনির হারবার ব্রিজ অতিক্রম করার সময় টোল দিতে গিয়ে মনে মনে এবং কখনো প্রকাশ্যে ইংরেজকে কষে গাল দিতে কতো যে শুনেছি, আজ মনে হলে হাসি পায়। তবু অস্ট্রেলিয়ানরা গণভোটে বর্তমান অবস্থানের পক্ষেই ভোট দেন!
অস্ট্রেলিয়ার একজন মানুষ বৃটেনে গিয়ে মিডিয়া সাম্রাজ্যের মুঘল হবেন, ইংরেজদের পক্ষে বিষয়টি হজম করা সহজ ছিল না। সহ্য তারা করেছেন, দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে রূপার্ট মারডকের সঙ্গে ইংরেজদের ছিল এক ধরনের ভালবাসা-ঘৃণার সম্পর্ক। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো এবার যখন মারডকের মালিকানাধীন নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড ফোনে আড়িপাতার কেলেঙ্কারির দায় মাথায় নিয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরের নানাবিধ প্রতিক্রিয়ায়।
যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের সংস্কৃতি-মিডিয়া-স্পোর্টস কমিটিতে শুনানিতে উপস্থিত রূপার্ট মারডক ও তার ছেলে জেমস মারডক যখন আড়িপাতার বিষয়ে নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন জোনাথন মে-বওয়েনস নামক এক আত্মস্বীকৃত কৌতুকাভিনেতাকে এক প্লেট কেডিং ক্রিম ছুড়ে মারলেন তা ছিল অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া-মুঘলের প্রতি বৃটিশ জনগণের মনোভাবেরই পরিচায়ক! রূপার্ট মারডক শুধু একটি পত্রিকাই বন্ধ করেননি। তিনি ব্রিটিশ সমাজ, রাজনীতি এক কথায় জাতীয় জীবনে বিশাল কম্পনের সৃষ্টিও করেছেন। নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ডের প্রাক্তন সম্পাদক এন্ডি কৌলসনকে গণসংযোগ প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ফলে ব্র্র্র্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এখন নানা প্রশ্নের মুখোমুখি। আর ফোনে আড়িপাতায় সহায়তা করার অভিযোগে অভিযুক্ত লন্ডনের পুলিশ বিভাগ, ইতিমধ্যে লন্ডনের পুলিশ কমিশনার ও উপ-পুলিশ প্রধান পদত্যাগও করেছেন। আর সাংবাদিকতার নীতি নৈতিকতাই তো আজ বিরাট সমস্যায় পড়ে গেছে।
যে নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড কেলেঙ্কারির কারণে রূপার্ট মারডকের মিডিয়া সাম্রাজ্যের ভিত্তি আজ টালমাটাল, তা একদিনে অর্জিত হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার এডেলেইডে মাত্র একটি সংবাদপত্র নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন যে রূপার্ট মারডক গত শতকের পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি, তার সব অর্জন বুঝি আজ এই পত্রিকার কারণে ম্লান হয়ে যায়। তার ব্যবসার প্রসার ঘটে আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ায়। এবং তা ঘটে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে।
ইউরোপে তার ব্যবসার শুরু ১৯৬৮ সালে। এবং তা শুরু হয় নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড-এর মালিকানা কেনার মাধ্যমে।
১৯৮৬ সালে তিনি তার সংবাদপত্র শিল্পে ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতির ছাপা প্রক্রিয়া প্রবর্তন করেন যা তখনকার দিনে ছিলো এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ। এর ফলে অবশ্য তার পত্রিকায় কর্মীর সংখ্যা কমে গেলো। এর কারণে তাকে শ্রমিক-সাংবাদিকদের তুমুল প্রতিবাদের সম্মুখীন হতে হয়। মারডক লন্ডনের ডকল্যান্ড এলাকার ওয়াপিঙে আধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ প্রেস স্থাপন করেন। সেই এলাকায় শ্রমিকরা তুমুল বিক্ষোভ করেন। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীরা অভিযোগ আনেন যে, সরকার রূপার্ট মারডককে সহায়তা করেছেন শ্রমিক আন্দোলন বানচাল করতে।
যুক্তরাষ্ট্রের রূপার্ট মারডকের মিডিয়া সাম্রাজ্য স্থাপনের কাজ শুরু হলো ১৯৭৩ সালে।
এশিয়ায় রূপার্ট মারডকের ব্যবসার শুরু ১৯৯৩ সালে যখন তার প্রতিষ্ঠান হংকংভিত্তিক স্টার টিভি নেটওয়ার্ক-এর স্বত্ব কিনে নেন।
সামপ্রতিককালে ফোন-হ্যাকিংয়ের কারণে ক্রীড়া জগতে হৈচৈ ফেলার মতো ঘটনাটি ঘটায় নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড যখন পাকিস্তান ক্রিকেট টিম ২০১০ সালের ২৭ জুলাই থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইংল্যান্ড সফর করে।
নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড-এর সাংবাদিক মাযহার মাহমুদ।
মাযহার মজিদ নামে এক আরব শেখ এবং জুয়াড়ির ছদ্মবেশে তিন পাকিস্তানি খেলোয়াড়-অধিনায়ক সালমান বাট, উদীয়মান ও প্রতিশ্রুতিবান দুই ফাস্ট বোলার মোহাম্মদ আসিফ ও মোহাম্মদ আমিরকে অর্থের প্রলোভনে আটকে ফেলেন এবং তাদের সঙ্গে তার পুরো আলাপ-আলোচনার টেপে ধারণকৃত রেকর্ড পত্রিকায় সরবরাহ করেন। নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ডে ওই জুয়াড়ির সঙ্গে খেলোয়াড়দের জড়িত থাকার খবর প্রচার করার ফলে তিনজন খেলোয়াড়েরই খেলোয়াড়ি জীবন আজ ধ্বংস হয়ে গেছে।
তবে অনুরূপভাবে আরেক প্রাক্তন পাকিস্তানি ক্রিকেটার ইয়াসির হামিদকে ফাঁসাতে গিয়ে ২০১০ সালের শেষ দিকে যে কাহিনী ফাঁদে নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড, তাতে পত্রিকা নিজেই ফেঁসে যায়। ২০১১ সালে জুন মাসে ইউ কে প্রেস কাউন্সিলের রায়ে সংবাদটি ভুয়া প্রমাণিত হয় এবং কর্তৃপক্ষ সংবাদটির ভিডিও চিত্র তাদের ওয়েবসাইট থেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
এই একটি ঘটনায় পত্রিকার বিশ্বাসযোগ্যতা কিছুটা হলেও তখন ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পরবর্তী ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটতে থাকে, যার ফলে ১৬৮ বছরের ঐতিহ্যবাহী একটি পত্রিকা বন্ধই হয়ে গেল। মানুষের বিশ্বাসে পত্রিকার ব্যাপারে আগেই চিড় ধরেছিল।
যে পত্রিকাটি ১৬৮ বছর ধরে গড়ে উঠেছিল। বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হতে তার মাস দুয়েকের বেশিও সময় লাগলো না!
ফোনে আড়িপাতার প্রথম অভিযোগটি শোনা যায় ২০০৬ সালে। ভাসা ভাসা প্রথমদিকে শোনা গেলেও যখন শোনা গেল রূপার্ট মারডক ব্রিটিশ স্কাই ব্রডকাস্টিং-এর মালিকানা নিতে চেষ্টা করছেন, অভিযোগ আরো তীব্র হলো।
অভিযোগ উঠলো ব্রিটিশ রাজ পরিবারের টেলিফোনে আড়িপাতার। সবচেয়ে বেশি হৈচৈ উঠলো যখন জানা গেল ২০০২ সালে গুম হওয়া তেরো বছরের বালিকা মিলি ডওলারের ফোনেও নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড-এর সাংবাদিক আড়ি পেতেছিলেন। পরবর্তীকালে যখন গুম হওয়া মেয়েটির খুন হওয়ার খবর জানা গেল তখন পত্রিকার বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের মাত্রা আরো বেড়ে গেল। ২০০৫ সালে লন্ডনে আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত বায়ান্ন জনের অন্যতম বাইশ বছর বয়সী ডেভিডের পিতা গ্রাহাম ফোলকেজের পরিবারের সঙ্গে পত্রিকার সাংবাদিকরা যা করেছেন, তা ভুলতে তারা সহজে পারবেন না। লন্ডন পুলিশের কাছ থেকে মি. গ্রাহাম জানতে পারেন, নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড গ্লেন মুঘলফেয়ার নামক একজন বেসরকারি গোয়েন্দা নিয়োগ করেছে তার ফোনে আড়িপাতার জন্য।
এতসব অভিযোগ মাথায় নিয়ে পত্রিকা চালানো যে সম্ভব হবে না তা বুঝতে দেরি হয়নি রূপার্ট মারডকের। ১০ জুলাই (২০১১) পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে ‘থ্যাক ইউ এ্যান্ড’, ‘গুডবাই’-ধন্যবাদ এবং বিদায় লিখে বের হলো দেড় শতাধিক বছরের পুরানো একটি পত্রিকা।
প্রতিপক্ষ ব্যঙ্গ করে লিখলো: নিউজ অফ দি ওয়ার্ল্ড তো নয়, এ যেন ‘এন্ড অফ দি ওয়ার্ল্ড’। পৃথিবীরই শেষ!
আরও রসিকতা করে ছবি ছাপলো দু’টি- একটি মারডকের ছেলেদের (উত্তরাধিকারী: এয়ারস) অন্যটি কন্যার স্নেহে বেড়ে ওঠা পত্রিকার শেষ সম্পাদক রেবেকা ব্রুক্স্-এর মাথাভর্তি তার ঝাঁকড়া চুল। ছবির নিচে লেখা হলো: চুল (হেয়ারস)! ঐবরৎং ও ঐধরৎং-এর উচ্চারণের সমিলতা রসিকতার জন্ম দেয়।
পত্রিকা তো বন্ধ হলো। কিন্তু প্রশ্ন হলো: নিকট ভবিষ্যতে রূপার্ট মারডকের বিশাল অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য অক্ষত থাকবে তো? মারডকের নিউজ করপ-এর সম্পদের তালিকায় রয়েছে:
৭.৬ বিলিয়ন ডলার- চলচ্চিত্রে
৭.০ বিলিয়ন ডলার- কেবল টিভিতে
৬.১ বিলিয়ন ডলার- সংবাদপত্রে
৪.২ বিলিয়ন ডলার- ফক্সটিভি নেটওয়ার্কে
১.৩ বিলিয়ন ডলার- পুস্তক প্রকাশনায়
১.২ বিলিয়ন ডলার- মার্কেটিং-এ
১.৫ বিলিয়ন ডলার- অন্যান্য খাতে।
অশীতিপর রূপার্ট মারডক, তার পুত্র জেমস এবং চীনা বংশোদভূত স্ত্রী ওয়েনডি ডেং সম্মিলিত মেধা ও বুদ্ধি দিয়ে কি করে এই সঙ্কট মোকাবিলা করেন তা-ই এখন দেখার বিষয়।