বাংলাদেশ নিয়ে বৃটিশ পার্লামেন্টে তুমুল বিতর্ক
এনাম চৌধুরী: বাংলাদেশের অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহনযোগ্য নয় মর্মে সর্ব সম্মত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বৃটিশ পার্লামেন্টের হাউজ অব কমন্স। বৃহস্পতিবার বৃটিশ পার্লামেন্টের হাউজ অব কমন্সে দীর্ঘ সাড়ে ৩ ঘন্টার বিতর্ক শেষে স্পিকার ভোটে দেন। তখন হ্যা ভোটে বিষয়টি সর্ব সম্মত পাস হয়। বৃটিশ পার্লামেন্টের ইতিহাসে বাংলাদেশকে নিয়ে এত দীর্ঘ আলোচনা অতীতে হয়নি বলে জানা গেছে। এই আলোচনার সময় ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন নিয়ে রসিকতা করেন সংসদ সদস্যরা।
স্পিকার সিদ্ধান্ত ভোটে দেয়ার আগে ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিস মিনিস্টার ডেভিট লেডিংটন বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন প্রশ্নবোধক। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচনে ১৮দলীয় জোট অংশ নেয়নি। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে হলে সকলের কাছে গ্রহনযোগ্য একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। গণতন্ত্রের অন্যতম উপাদান হচ্ছে সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকা। এখন বাংলাদেশের সংসদে কোন বিরোধী দল নেই।
স্পিকার সিদ্ধান্ত ভোটে দেয়ার আগে দীর্ঘ আলোচনায় বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মানবাধিকার পরিস্থিতি, বিচার ব্যবস্থা, মিডিয়ার স্বাধীনতা, বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলোর নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার, হয়রানি, র্যাবের ক্রস ফায়ার, যোদ্ধাপরাধের বিচারসহ বিভিন্ন বিষয়ে উঠে আসে।
দিনের কার্যসূচির অন্তর্ভুক্ত বিষয় হিসাবে সাড়ে ১১টায় প্রস্তাবের উপর আলোচনা শুরু হয়। হাউস অব কমন্সের সদস্য সাইমন ডান্সজাক বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি প্রস্তাব জমা দেন। এতে ২০ জন সংসদ সদস্য আলোচনায় অংশ নেন। আলোচনায় অংশগ্রহনকারী প্রত্যেকেই ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, এটাকে গণতান্ত্রিক সরকার বলা যায় না। এটা কোন নির্বাচন নয়।
আলোচনার সূত্রপাত করেন বাংলাদেশ বিষয়ক অল পার্টি পার্লামেন্ট বিষয়ক চেয়ারম্যান অ্যান মেইন। তিনি আলোচনার সূত্রপাত করে বলেন, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচন জনগনের কোন অংশ গ্রহন ছিল না। এই নির্বাচনে কোন স্বচ্ছতাও ছিল না। এতে জনগনের ইচ্ছার কোন প্রতিফলন ঘটেনি। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা তাদের ইচ্ছামত একটি নির্বাচন করে নিয়েছে। ১/১১ এর জরুরী আইনের সরকারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে অ্যান মেইন বলেন, আমি আশা করবো শেখ হাসিনা দ্রুত একটি স্বচ্ছ নির্বাচনের বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন। তিনি বলেন, ২০০৬ সালে শেখ হাসিনাও তাঁর পছন্দের তত্ত্বাবধায়ক সরকার না হওয়ায় নির্বাচন বয়কট করেছিল। তিনি বলেন, অতীত থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা কোন শিক্ষা নেয়নি।
অ্যান মেইন গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে পৃথক আলোচনা করেছি। তখনো তাদের সমঝোতার ভিত্তিতে একটি গ্রহনযোগ্য এবং সকলের অংশ গ্রহন মূলক নির্বাচনের তাগিদ দেয়া হয়। তিনি বাংলাদেশে সংখ্যা লঘু সম্প্রাদায়ের উপর হামলার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে বলেন, কোন সরকারই সংখ্যা লঘুদের নিরপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি।
রোশনারা আলী আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, বাংলাদেশের দুই নেত্রীকে আলোচনায় বসে সমঝোতায় পৌছাতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারী অনুষ্ঠিত নির্বাচন কোন অবস্থায়ই গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। এটা কোন স্বচ্ছ নির্বাচনও হয়নি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে গত ফেব্রুয়ারী থেকে রাজনৈতিক বিরোধের কারনে ৩ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। তিনি বলেন, বৃটিশের পক্ষ থেকে অনেক বড় বিনিয়োগ রয়েছে বাংলাদেশে। এখানে অবস্থানরত বাংলাদেশী বংশদ্ভুত নাগরিকদের আত্মীয় স্বজনরাও রয়েছে। এখন অবস্থানরত বাংলাদেশী বংশদ্ভুতরাও স্বজনদের নিয়ে আতঙ্কিত।
রিচার্ড ফোলার বলেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সব দায় দায়িত্ব হচ্ছে সরকারি দলেন। হাজার হাজার বিরোধী দলের নেতা-কর্মী বন্দি। বাকী যারা কারাগারের বাইরে রয়েছেন তারা বাড়িতে থাকতে পারে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাসে এই প্রথম কোন বিরোধী দল বিহনী সংসদ। এটা কোন গণতন্ত্র হতে পারে না। ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ইচ্ছামত একটি নির্বাচন করে সব আসন দখল করে নিয়েছেন। বিরোধী দলীয় নেতাকে গৃহবন্দি করে অনুষ্ঠিত নির্বাচন কারো কাছে গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। এটা হচ্ছে গণন্ত্রের একটা হাস্যকর বিষয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ গণতন্ত্র প্রিয়। কিন্তু সরকারে যারা থাকেন তারা মানুষকে ধোকা দিয়ে ক্ষমতায় আকড়ে থাকতে চায়। তিনি বলেন, বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতা ইলিয়াছ আলী সহ অনেক নেতাকে গুম করা হয়েছে। মিডিয়ার স্বাধীনতা নেই।
র্যাবকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে উল্লেখ করে রিচার্ড ফোলার বলেন, র্যাব ধরে নিয়ে বিনা বিচারে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ক্রস ফায়ারে হত্যা করছে। এতা গণতন্ত্রের জন্য কোন শুভ লক্ষন নয়। র্যাবের ক্রস ফায়ার নিয়ে বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে একটি তদন্তের দাবী জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশে টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে মানবাধিকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে অবিলম্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রস্তাব উত্থাপনকারী সাইমন ডান্সজাক বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে এখন কার্যকর কোন বিরোধী দল নেই। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে কোন নির্বাচনই হয়নি। তারা নিজেরা ভাগাভাগি করে নিয়ে গেছে। বাকী ১৪৭ আসনে নির্বাচনের নামে যা হয়েছে সেটা গণতান্ত্রিক সংজ্ঞায় পড়ে না। এই ভাবে একটি দেশে গণতন্ত্র বেঁচে থাকতে পারে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যা গরীষ্ঠ মানুষ মুসলমান। তারপরও সেখানে বিভিন্ন ধর্মের লোকরা বসবাস করছে। সংখ্যা লঘুদের উপর নির্যাতনের নানা খবর বের হচ্ছে। এর কারন খুজে বের করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে নির্বাচন কালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা জনগনের কাছে গ্রহনযোগ্য। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে অবিলম্বে একটি গ্রহনযোগ্য নির্বাাচনের জন্য চাপ সৃস্টি করা বিটিশ সরকারের দায়িত্ব।
নেইল পেরিস বলেন, এটাকে নির্বাচিত সরকার হিসাবে বতমান সরকারকে মেনে নেয়া যায় না। বিরোধী দলের নেতাকে বাড়িতে আটক রেখে যেই নির্বাচন হয় সেটা গ্রহনযোগ্য নয়। বাংলাদেশে মানবাধিকার সুরক্ষায় বৃটিশ সরকারকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক সরকার রয়েছে বলা যায় না। বাংলাদেশে দ্রুত একটি অংশ গ্রহন মূলক গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রাদায়ের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ দুনিয়ার কোন দেশ এই নির্বাচনকে গ্রহনযোগ্য নির্বাচন বলে স্বীকৃতি দেয়নি।
গেভিন সোকার বলেন, বাংলাদেশের মানুষের পাশে বিশ্ব সম্প্রদায়কে দাড়াতে হবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ এই নির্বাচনে অংশ নেয়নি। গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে হলে বেশিভাগ মানুষের পাশে আন্তর্জাতিক সম্প্রাদায়কে দাড়াতে হবে।
কেরি ম্যাকার্তি বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বৃটিশ কমিউনিটির জন্য অত্যন্ত গর্বের। ২০ ভাগ মানুষও এই নির্বাচনে ভোট দিতে যায়নি। সুতরাং এটাকে গণতান্ত্রিক সরকার বলা যাবে না। গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অবিলম্বে সকলের অংশ গ্রহনের জন্য আরেকটি নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান সব সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। ৫০০-এর বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে ২০১৩ সালে। বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করছে র্যাব। যোদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, এই ট্রাইব্যুনালে যা ঘটছে সহজ ভাষায় সেটা হলো প্রশ্ন বোধক। জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। প্রশ্নবোধক ট্রাইব্যুনালের বিচারে এই ফাঁসি কোন অবস্থায়ই গ্রহনযোগ্য নয়। এই ট্রাইব্যুনালে বিচার ব্যবস্থা চরম পক্ষপাত মূলক। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের জন্য অপরিহর্য্য হচ্ছে স্বাধীন বিচার বিভাগ ও স্বাধীন মিডিয়া। কিন্তু বিচার বিভাগ প্রশ্ন বোধক। মিডিয়ার স্বাধীনতা নেই। বিরোধী রাজনৈতিক নেতা ও মিডিয়ার সাংবাদিকরা অপহরণ এবং গুম হচ্ছেন।
আলোচনায় আরো জিম ফিস পেট্রিক, জেরিমি করভিন, মার্টিন, বব ব্ল্যাক ম্যানসহ ২০ জন সংসদ সদস্য অংশ নেন।
এই আলোচনা চলাকালে যুক্তরাজ্যে নিয়োজিত বাংলাদেশের হাই কমিশনার মিজারুল কায়েস সহ কয়েকজন কর্মকর্তা, যুক্তরাজ্য বিএনপির নেতৃবৃন্দ দর্শক গ্যালারিত উপস্থিত ছিলেন। এদের মধ্যে দর্শক গ্যালারিতে ব্যারিস্টার এম এ সালাম, মোশাহিদ হোসাইন, আবদুল হামিদ চৌধুরী, কয়সর এম আহমদ, মামুনুর রাশিদ মামুন, ব্যারিস্টার তমিজ উদ্দিন, ব্যারিস্টার আবু সায়েম, প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন, অ্যাডভোকেট তাহের রায়হান চৌধুরী পাবেল, ড. মুজিবুর রহমান, কামাল আহমদ, জসিম উদ্দিন সেলিম, রাজিব আহমদ, মিলহানুর রহমান প্রমূখ।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সম্পাদক, দি সান রাইজ টুডে ডট কম