চীনে হুই মুসলমানদের সঙ্গে

Chainaশাকুর মজিদ: পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল দেশ চীনের অন্যতম সংখ্যালঘু হলো মুসলমান সম্প্রদায়। ধর্মীয় লোকাচারে তারা অনেকটা অন্যান্য দেশের মুসলমানদের মতো হলেও সেখানে গড়ে উঠেছে নিজস্ব সংস্কৃতি। চায়না টেলিভিশন সিসিটিভির আমন্ত্রণে চীন ঘুরে এসে সেখানকার মুসলমানদের নিয়ে লিখেছেন শাকুর মজিদ
বেইজিং-সাংহাইতে যত চৈনিক দেখেছিলাম, তারা ছিল হান জাতির। কিন্তু এই ইউন্নানে এসে একেক জায়গায় একেক জাতির চৈনিক দেখছি। লিজিয়াংয়ে দেখে এসেছি ‘নাশি’ জাতির চৈনিক, এ দালিতে এসে পেলাম ‘বাই’। শুনেছি, বেশ কিছু মুসলমান সম্প্রদায় এ দালিতে আছে। তাদের দেখা কেমনে পাব?
এমন কথা জুংকে জানাতেই বলল, ‘এখানে কাছাকাছি একটা গ্রাম আছে, হুই জাতির চীনারা এখানে বাস করে। তারা প্রায় সবাই মুসলমান। তুমি চাইলে আমরা এই গ্রামটা দেখে আসতে পারি। যেই কথা সেই কাজ। আমরা হুই-অধ্যুষিত একটা গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করি। হাদিসে পড়েছি, আমাদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর উম্মতদের জ্ঞানার্জনের জন্য সুদূর চীন দেশে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আরব থেকে চীন অনেক কষ্টের যাত্রা। তা-ও তাঁর সায় ছিল এ নিয়ে। তাঁর নিশ্চয়ই জানা ছিল যে হেকমতে চীন অনেক গুণী একটা জাতি।
ঠিক সে কারণেই কি না জানি না, সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস নামের মহানবীর এক সাহাবি ইসলামের দাওয়াত নিয়ে প্রথম চীনে আসেন ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে। তাং সম্রাট ইয়াং উই পছন্দ করেন এই সাহাবির বয়ে আনা বার্তা। তিনি দেখলেন যে ইসলামের বার্তা সে সময়কার সনাতনী কনফুসিয়াসের মতবাদের সঙ্গে অনেকটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ। রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় শিয়ান শহরে একটি মসজিদ বানানো হয়। চীনের প্রথম এই মসজিদটি বানানো হয় চীনা সনাতন পদ্ধতির বৌদ্ধ প্যাগোডার কায়দায়। সেই থেকেই এ ধরনের মসজিদ নির্মাণের চল শুরু হলো চীনে। শিয়ান প্রদেশে মসজিদটি বানানোর পর থেকে আরব দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ বেড়ে যায় চীনের। আরও অনেক মুসলমানের আগমন ঘটে। রাজতন্ত্রের জাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ চৈনিকেরা তখন দলে দলে ভিড়তে থাকে মুসলমানদের কাতারে। শুরু হয় নতুন ইসলামি উপনিবেশ।
পুরো চীনে প্রায় নয় লাখের মতো হুই গোষ্ঠীর বাস। তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চীনজুড়েই। তবে উত্তর-পশ্চিম চীনেই হুই জাতির বসবাস বেশি। হুই গোষ্ঠীর প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্ম ইসলাম। ধারণা করা হয়, সিল্ক রুটের কল্যাণে যখন আরবদের সঙ্গে চীনাদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সে সময় হুই গোষ্ঠীর লোকজন ইসলামের সাম্য আর শান্তির বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে।মঙ্গোলীয় সেনাপতি কুবলাই খান যখন চীন জয় করতে আসেন, তখন তাঁর অনেক সৈনিক এ দালি অঞ্চলের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যুদ্ধ জয় করে কুবলাই খান চলে যান বেইজিং, তাঁর অনেক মুসলিম সৈনিক থেকে যায় এই দালি অঞ্চলে। তাঁদেরই বংশধরেরা এখন এ দালির বিভিন্ন গ্রামে বসবাস করছে। গ্রামের ভেতরে ঢুকতেই একধরনের উৎসব উৎসব ভাব দেখা যায়। পুরোটা রাস্তা সুতলির সঙ্গে আঠা দিয়ে লাগানো রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো। গ্রামটির নাম খো লি জং। লক্ষ করি, এখানকার ঘরবাড়িগুলো একটু অন্য রকম। না সনাতনী, না অতি-আধুনিক। দুটোরই একটা মিলমিশ আছে এখানে। চীনা ঐতিহ্যিক রীতির ঘরবাড়ি কিন্তু এর নির্মাণসামগ্রী আধুনিক। বাড়ির ফটকে ও দেয়ালে আরবি হরফে লেখা সাইনবোর্ড এবং বিভিন্ন আলংকারিক কাজ। দেখে স্পষ্টই বোঝা যায়, এগুলো মুসলমানদের বাড়ি।
হঠাৎ কী মনে হলো, আমি একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লাম। আমার মুখের ভাষা কেউ বোঝে না। কিন্তু আকার-ইঙ্গিতে যা বোঝালাম, তাতে মনে হলো কেউ আমাকে নিষেধ করবে না। নিচতলায় বড় একটা ড্রয়িংরুম। এখানে বসেই পরিবারের লোকজন আড্ডা দিচ্ছে। ঘরের ভেতরেও গৃহকর্তা টুপি পরে আছেন। তাঁর ঘরে নানা রকমের নকশাদার কাজ। আছে কাবা শরিফ ও ড্রাগনের ছবিও। কী মিশ্রণ!
রাস্তায় যেসব নারী দেখেছি, তাঁদের পোশাকের বৈচিত্র্য থাকলেও প্রায় সবারই হিজাব আছে। এখানে অনেক নারীই পুরুষের মতো মাথায় টুপি পরেছেন। আদল ও আলংকারিক কাজে পুরুষের টুপির সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য নেই। রাস্তার অনেক সাইনবোর্ডেই চীনা হরফের পাশাপাশি আরবি হরফের ব্যবহার আছে।
এসব ঘুরেফিরে দেখতে দেখতে বাজারের মতো একটা এলাকায় চলে আসি। এখানে অস্থায়ী দোকানে বিভিন্ন সওদার পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। এসব ব্যবসায়ীর মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। প্রৌঢ় বা বৃদ্ধরা যেমন, তরুণ-তরুণীরা মোটেও সে রকম নন। বেশির ভাগ তরুণীই জিনসের প্যান্টের সঙ্গে টপস পরেছেন, কিন্তু মাথায় স্কার্ফ।
তবে ফুটপাতের ওপর কিছু দোকানের পসরা দেখে বুঝতে বাকি নেই যে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর কল্যাণে এখানে আজকের জন্যই এই বাজারের আয়োজন। একটি দোকানে দেখলাম বিকোচ্ছে হালুয়া। বিভিন্ন রঙের সেই হালুয়া। আছে মোরব্বা ও খোরমা খেজুরও। খেজুর চীনের খাবার নয়। যেহেতু হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন, সে কারণে মিষ্টিমুখ করতেই হয়তো এসব খেজুরের আমদানি হয়েছে এখানে।
মসজিদটির সামনে আমি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। এর আগে আমরা ক্যাংশান মন্দির চত্বরে বৌদ্ধ ও তাওবাদীদের ধর্মীয় উপাসনালয় দেখেছি, প্যাগোডা দেখেছি। এখন এই মসজিদকেও দেখছি অনেকটা সে রকম আকারের। চীনের প্রথম মসজিদটি যে রীতিতে প্যাগোডার রূপকে বিবর্তিত করে বানানো হয়েছিল, এই মসজিদের রূপও তা-ই।
তার মানে, চীনারা ধর্ম গ্রহণের সময়ও তাদের ঐতিহ্যিক ধারা থেকে সরে আসেনি।
চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মসজিদগুলোয় বৌদ্ধ প্যাগোডার স্থাপত্যরীতি দেখা যায়। যদিও এসব মসজিদে ইসলামি ক্যালিগ্রাফি আর অলংকরণ থাকে। যে কারণে এসব মসজিদ অনেকটা মন্দিরের ডিজাইনকে স্মরণ করিয়ে দেয়। দালির এই খো লি জং মসজিদেও বৌদ্ধমন্দিরের নকশার অনুকরণে প্যাগোডার ছাঁচে মসজিদের মিনার। সেখানেই মাইক লাগানো। মিনারের ওপরে যেমন মাইক লাগানো থাকে আজানের জন্য, এখানেও তা-ই। মসজিদের ভেতরে ও বাইরে চীনা ও আরবি ভাষায় ধর্মীয় বাণী লেখা।
ঢুকে পড়ি মসজিদের ভেতরে। মসজিদের যেসব উপাদান যেমন: মিম্বর, মিহরাব, মূল নামাজের জায়গা, মিনার, দুই দিকে আইওয়ান আর মাঝখানে শান থাকে, এখানেও তার সব উপাদান আছে। কিন্তু বাইরের রূপটা পুরোপুরি চৈনিক। ভেতরে হলঘরের মতো নামাজ পড়ার জায়গা। এই মসজিদের নারী-পুরুষ একসঙ্গে নামাজ পড়েন। মসজিদের শান এলাকাটিতে জোহরের নামাজ শেষে সবাই মিলে বসেছেন শিরনি খেতে। টেবিলে টেবিলে রাখা আছে নানা পদের তরকারি। যে যাঁর পছন্দমতো খাবার নিয়ে খাচ্ছেন।
এখানে ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা বৃথা। কিন্তু হঠাৎ করে দেখি, দুজন বুড়ো-বুড়ি আমার দিকে চেয়ে আছেন। তাঁদের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি, চোখে জিজ্ঞাসার চিহ্ন। চোখের ভাষা এমন যে, জানতে চাইছেন আমি কে!
বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে, আমিও মুসলিম। আর পায় কে! এবার আমাকে প্রায় বাধ্য করা হলো খাবার টেবিলে বসে পড়তে।
অন্য রেস্টুরেন্টে এর আগে খেতে গিয়ে বারবার জিজ্ঞেস করেছি, সাপ-ব্যাঙ-কুকুর এসব কিন্তু আমরা খাই না। এসব যেন না দেওয়া হয়। এখানে সেসব জিজ্ঞাসেরও কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বসে পড়ি। বাটির মধ্যে ভাত নেই। গোশতের হাঁড়ি থেকে গরুর গোশত ওঠাই। সরুয়া দিয়ে রেঁধেছে, মসলাপাতি কম, নেই বললেই চলে। চীনা রীতির রান্না।
হঠাৎ দেখি, সফরসঙ্গী খ ম হারুন ভাই এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে। বললেন, ‘আরে আপনি এখানে! আপনাকে কত খুঁজছি, ওরা তাড়া দিচ্ছে, দালির পর্যটনমন্ত্রী আমাদের সঙ্গে আজ লাঞ্চ করবেন। ওনার দাওয়াত।’
আমি বলি, ওসব বাদ দেন, হারুন ভাই। বিসমিল্লাহ বলে বসে পড়েন। হারুন ভাই বসবেন না। তিনি দাঁড়ানোই থাকবেন। আমি একটা বাটিতে কিছু ভাত আর কয়েক টুকরা গরুর মাংস তুলে নিলাম। হারুন ভাই কাঠি দিয়ে খাওয়া শুরু করেন।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button