লন্ডনে সৈয়দ মোস্তফা কামাল স্মরণে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত
সৈয়দ মোস্তফা কামাল। প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতি আজীবন ছিলেন অনুসন্ধ্সিু। আবার রম্যকথন দিয়ে তার মনিষার অন্য একটি দিকও তরুণ বয়সেই সমাদৃত হয়েছিল বাঙালি পাঠক সমাজে। কলেজ জীবনেই লিখে ফেলেন ‘রঙেরবিবি’ নামক গ্রন্থ। আবুল মনসুর আহমদ, আবুল ফজল, শাহেদ আলী গঙদের নজর কাড়েন। গবেষক গোলাম আকবর উল্লেখ করেন, কেন্দ্রে থাকলে সৈয়দ মোস্তফা কামাল অনেক খ্যাতি পেতেন। কিন্তু কে জানে কেন্দ্র হয়তো তাকে টানেনি। টেনেছে গ্রাম বাংলা, মফসসল। চিন্তায় মরমি ও সুফি। ঐতিহ্যে সর্বভারতীয় এই শিকড়সন্ধানী লেখক সৈয়দ মোস্তফা কামালের প্রয়ানে গত ১৩ জানুয়ারি, সোমবার মন্টিফিউরি সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় এক স্মরণসভা। আয়োজন করে ফ্রেণ্ডস অব সৈয়দ মোস্তফা কামাল। উল্লেখ, সৈয়দ মোস্তফা কামালের এ যাবত প্রকাশিত রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬৩। এর মধ্যে গবেষণা ২২টি, নবী জীবনী ২টি, জীবনী ১টি, নাটক ২টি, রম্যরচনা ২টি, পুঁতিকাব্য ৩টি, আত“জৈবনিক ২টি, বিবিধ ৮টি এবং সম্পাদনা ২৩টি। পুরস্কার, সম্মাননা, সংবর্ধনা ও স্বীকৃতি ৩৮টি। তাকে উ্সর্গিত গ্রন্থ ১৫টি। তিনি ছিলেন জালালাবাদ লোক সাহিত্য পরিষদ এর সভাপতি, সিলেট লেখক ক্লাব এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
ড. রেনু ল্ফুার সভাপতিত্বে ও সুরমার সম্পাদক কবি আহমদ ময়েজের পরিচালিনায় অনুষ্ঠিত সভায় সৈয়দ মোস্তফা কামালের লেখা ও তার জীবন সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন কবি ও কলামিস্ট ফরীদ আহমদ রেজা, সাংবাদিক ইসহাক কাজল, সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বাসন, কমিউনিটি নেতা আবু তাহের চৌধুরী। স্মৃতিচারনে অংশ নেন সাংবাদিক মতিয়ার রহমান চৌধুরী, কবি তাবেদার রসুল বকুল, ঝর্ণা চৌধুরী, পলাশ সেবা ট্রাস্টের চেয়ার শেখ ফারুক, সাংবাদিক আকবর হোসেন, লেখক ও গবেষক আবদুল আওয়াল হেলাল, সালেহ আহমদ খান, সৈয়দ মোস্তফা কামালের ছেলে সৈয়দ মোস্তফা মোমিন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে কোরআন থেকে তেলওয়াত করেন আবদুল মুমিন ক্যারল। সৈয়দ মোস্তফা কামালের সংক্ষিপ্ত জীবনপরিচিতি তুলে ধরেন গবেষক ফারুক আহমদ। নিবেদিত কবিতা পাঠ করেন কবি ও সাংবাদিক আবদুল কাইয়ূম।
আমার স্মৃতি অনেক দীর্ঘম্ব – উল্লেখ করে কবি ও সাংবাদিক ফরীদ আহমদ রেজা বলেন, ১৩/১৪ বছর বয়স থেকে তার লেখা ও নামের সঙ্গে পরিচিত।
তিনি বলেন, সিলেটের প্রতি তার ভালোবাসা ছিল অধিক এটা এ জন্য নয় যে ছিলেন তিনি সিলেটী। মূলতচ্ঞ লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে আনতে গিয়ে তিনি একটি অঞ্চলকে কেন্দ্র করেই কাজ শুরু করেন।
তিনি বলেন, রম্য রচনার দিক দিয়ে সৈয়দ মোস্তফা কামাল ছিলেন বাংলা সাহিত্যের গৌরব সৈয়দ মুজতবা আলীর উত্তরসুরী। তাঁর প্রথম গ্রন্থ রঙের বিবি যখন প্রকাশিত হয় তখন তিনি এমসি কলেজের ছাত্র। সে গ্রন্থ পাঠ করে তাঁকে স্বাগতচ্ঞ জানান তদানীন্তন বাংলা সাহিত্যের দুইদিকপাল – আবুল ফজল ও আবুল মনসুর আহমদ এবং অভিনন্দিত করেন গণমানুষের কবি দিলওয়ার। তিনি বাংলাদেশের শেকড়ের সন্ধান করেছেন সিলেটের গ্রামগঞ্জ ঘুরে ঘুরে। তাঁকে আমাদের অবশ্যই স্মরণ করতে হবে।
তিনি বলেন, তবে মানুষ সৈয়দ মোস্তফা কামালই আমার কাছে সবচে বড় এবং আমি তাকে ভালোবাসি। সাংবাদিক ইসহাক কাজল ৬০/৭০ দশকের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, ঐসময়টা ছিল খুবই একটি উর্বরকাল। সিলেটরে ভূমিও এই সময়ে উজ্জ্বল কিছু মানুষকে ধারন করেছিল। বহুমত ও পথ এসে একই সুতে গেঁথেছিল। কবি দিলওয়ার, কবি আফজাল চৌধুরীর মতো বড় মাপের লেখকদের দৃষ্টি কেড়েছিলেন সৈয়দ মোস্তফা কামাল। তিনিও নিজেকে সেই মনিষায় ঋদ্ধ করেছিলেন। একটা সময় ছিল যখন লেখকদের মননে কোনো কৃপনতা ছিল না। ঐ অঞ্চলে লেখা প্রকাশের মাধ্যম ছিল যুগভেরী। কোনো বিভাজনই সেখানে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো অন্তরায় হয়নি।
তিনি বলেন, রঙের বিবির লেখক সৈয়দ মোস্তফা কামাল ছিলেন সাদা মনের মানুষ। মানুষকে তিনি ভালোবাসতেন আর সেই মানুষ নিয়েই ছিল প্রধান আকর্ষণ। গবেষক ফারুক আহমদ তার লেখায় উল্লেখ করেন, কথা সাহিত্যিক আকাদ্দাস সিরাজুল ইসলাম আইয়ূব খানকে পাদুকা নিক্ষেপকারী হিসেবে সৈয়দ মোস্তফা কামালের নামোল্লেখ করলেও আসলে কে সেই পাদুকা নিক্ষেপ করেছিলেন আজ পর্যন্ত তা রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে। অনেকে মনে করেন ঢাকাদক্ষিণের মোস্তাফা কামাল মস্তই সে পাদুকা নিক্ষেপকারী। কেউ মনে করেন বালাগঞ্জের শাহ আজিজুর রহমান আবার কেউবা মনে করেন হবিগঞ্জের মসাজানের ছেলে সৈয়দ মোস্তফা কামাল। সে যাই হোক। ঘটনাটির জন্য সিলেট সরকারী কলেজের রাজনীতি সচেতন ছাত্রদের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। এমনকি ১৯৬৬ সালের ১৬ আগস্ট কলেজ থেকেও তাদের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করা হলে লেখাপড়ায় খানিকটা ভাটা পড়ে। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে সিলেট সরকারি কলেজ থেকেই তিনি ১৯৭২ সালে বিএ এবং ১৯৭৫ সালে কুমিল্লা টিচার্স ট্রেইনিং কলেজ থেকে বিএড পাশ করেন সৈয়দ মোস্তফা কামাল।
ফারুক আহমদ তার লেখায় এও উল্লেখ করেন, কিছু দিন তিনি হবিগঞ্জ সরকারি হাইস্কুলে শিক্ষকতার মহান পেশায় জড়িত ছিলেন। হবিগঞ্জ সরকারি হাইস্কুলের শিক্ষকতাকালীন (১৬৭-৮১) শিক্ষা বিভাগ থেকে ডেপুটেশনে ধর্মমন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৯৮২ সালে সহকারি পরিচালক হিসেবে ইসলামিক ফাউণ্ডেশন সিলেট জেলা শাখার দায়িত্ব লাভ করেন এবং একই সাথে উপ-পরিচালকেরও দায়িত্ব পালন করেন। কলেজ জীবন থেকেই রম্যলেখক বা রস সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করলেও সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও ছিল তার অবাধ বিচরণ। ১৯৮২ সালের পর থেকে সিলেট সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার অবস্থান ছিল অনেকটা ধ্রুবতারার মতো।
কমিউনিটি নেতা আবু তাহের চৌধুরী তার স্মৃতিচারন পর্বে সৈয়দ মোস্তফা কামালের উদ্দেশ্যে সুরাহ ফাতেহা পাঠ করে বলেন, তার মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত। আমরা কী দেবো তাকে, সবই তো তিনি দিয়ে গেছেন। গোটা দেশবাসীকে তিনি যা দিয়ে গেছেন সেই ঋণ সারা জীবনেও শোধ হবে না।
সৈয়দ মোস্তফা কামালের সাথে তার পরিচয়ের সূত্র ধরে সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বাসন বলেন, সময়টা তখন ১৯৭৭ সালের সামরিক আইন। ঐ সময়ে যাদেরকে আমরা দেখেছি তারা ছিলেন তীক্ষ বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ কিন্তু সরল। ছিল প্রগতির চিন্তা। ঐতিহ্যের প্রতি ছিল টান। এবং সব মতের-পথের মানুষদের তারা টানতেন। তাদের সান্নিধ্যে গেলে বিভাজন ভেঙে যেতো, কেন্দ্রীভূত করে তুলতো সবাইকে। মনির উদ্দিন চৌধুরী, সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন খান, মনিষা লেখক নূরুল হক, সৈয়দ মোস্তফা কামাল – এরা এ অঞ্চলের আইকন। রাজনীতিতে অনেক আছেন কিন্তু এই মানুষগুলো সবাইকে চুম্বকের মতো টানতেন। তাদের পাণ্ডিত্যকে আমি শ্রদ্ধা করি। তারা প্রত্যেকেই একেকটা প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছিলেন। আমি সন্দিহান এই জায়গা আর পূর্ণ হবে কিনা – কারণ আমরা যেভাবে ক্রমশচ্ঞ বিভাজনের দিকে যাচ্চিছ সে জন্যই সন্দেহটা দানা বাধছে।
স্মৃতি চারনে সাংবাদিক মতিয়ার চৌধুরী বলেন, প্রথম দর্শনেই তিনি আমাকে আপন করে নিয়েছিলেন। জবানউল্লাহর জবানবন্দীর লেখক মোস্তফা ভাই বলতেন, ষ্ক্রবাঙ্গাল রাজনীতির কী অবস্থারে।ম্ব মোস্তফা ভাই ইসলামী ফাউণ্ডেশন সবার জন্য খুলে দিয়েছিলেন। অঞ্চলে অঞ্চলে গ্রন্থ প্রেরণ এবং সেই অঞ্চলে একটি পাঠাগার স্থাপনই ছিল তার মিশনের অংশ। তার এই গ্রন্থ আন্দোলন – অর্থাৎ এর মাধ্যমে মানুষের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলাই ছিল প্রধান লক্ষ্য। এমন মানুষ আর আমরা পাবোনা, তারা আর আসবেনও না।
কবি তাবেদার রসুল বকুল বলেন, তিনি আমাদের শ্রদ্ধাভাজন। খুব স্নেহ করতেন। সকল ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি নতুনেরে কদর করতেন। সময় দিতেন। সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন।
খুব ছোট বেলায় পারিবারিকভাবে পরিচিত ঝর্না চৌধুরী তার স্মৃতি চারনে বলেন, ৬০/৭০ দশক আমাদের বাড়িতে পারিবারিকভাবেই ছিলেন। আমরা আপন চাচা বলেই তাকে জানতাম। অনেক বড় হয়ে জেনেছি তিনি আবধ্বার বন্ধু। তার ছেলে যখন মারা যায় তখন আমারও একটি ভাইয়ের ইন্তেকাল হয়। ভাগ্যের এমনই সমন্বয় যে আমাদের বেদনাকে একই রেখার উপর দাঁড় করিয়ে দেয়।
সেবা ট্রাস্টের চেয়ার শেখ ফারুক বলেন, মরহুম মনির উদ্দিন চৌধুরীর মাধ্যমে মুসলিম সাহিত্য সংসদে তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে। তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। অনুপ্রাণিত হয়েছি। সর্বমোট তিনটি গ্রন্থ পলাশ সেবা ট্রাস্ট থেকে প্রকাশিত হয়েছে। সব কম্বটি গ্রন্থের পেছনেই ছিল তার আন্তরিক সহযোগিতা। লেখক ও গবেষক মাওলানা আবদুল আওয়াল হেলাল বলেন, যদিও আমার বয়স অনেক কম। তথাপি সান্নিধ্য ছিল বন্ধুসুলভ। তিনি সব সময় দিকনির্দেশনা দিতেন। এ পর্যন্ত আমার ৭টি গ্রন্থ বের হয়েছে। একটি গ্রন্থ ছাড়া সকল গ্রন্থের উপরই তিনি সতস্ফূর্তভাবে আলোচনা লিখেছেন। নবীনের প্রতি তার এই আন্তরিকতা অবিস্মরণীয়। সৈয়দ মোস্তফা কামালের ছেলে বিলেত প্রবাসী সৈয়দ মোস্তফা মনির তার বাবা সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েন।
তিনি বলেন, আমি জানতাম আমার অনেক বন্ধু রয়েছেন। তারা প্রত্যেকই একজন একজন আলাদা চিন্তার মানুষ। বাবার সাথে তাদের সম্পর্ক অনেক গভীরে। আমি গর্ববোধ করি, এমন একজন পিতার সন্তান হওয়ায় আমি এতো এতো আলোকিত মানুষ পেয়েছি। আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। দেশে থাকাকালিন বাবার সংস্পর্শে অনেক গুনীজনকে পেয়েছি। এই প্রবাসেও যে তার এতো বন্ধু – সত্যি আমি মুগ্ধ। দোয়া করবেন, আমি যেন তার পথে হাঁটতে পারি। আরো বক্তব্য রাখেন ছড়াকার শিহাবুজ্জামান কামাল ও সাংবাদিক আকবর হোসেন।
উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক এনাম চৌধুরী, আদুল গফুর চৌধুরী, সৈয়দ জিল্লুল হক, ফটো সাংবাদিক নোমান আহমদ, টেলিভিশন উপস্থাক ফোয়াদ, মওলানা জালালউদ্দিন কালারুকী, আশফাক, সৈয়দ আহরাজ মিয়া, সৈয়দ আরমান আলী প্রমুখ।
স্মরণসভা মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়। এর পূর্বে স্মরণসভার সভাপতি ড. রেনু ল্ফুা তার বক্তব্যে সবাইকে প্রথম ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তিনি সৈয়দ মোস্তফা কামালের সঙ্গে পরিচয়ের সময়কাল উল্লেখ করে বলেন, আক্সার বক্সের ছাপাঘর। সেখানে আড্ডা হতো। নবীনপ্রবীনদের আড্ডা। সেই অল্প বয়সে সেই আড্ডাকে বুঝিনি। এখন বুঝি, সেটা আসলে আড্ডা ছিল না। ছিল ওয়ার্কশপ। মোস্তফা ভাই আমাদের কাছে তখন ষ্ক্ররঙের বিবিরি সৈয়দ সাহেবম্ব হিসেবে খ্যাত। তিনি জীবদ্দশায় ৬৩টি গ্রন্থ লিখেছেন। আর তাকে নিয়ে লেখা হয়েছে ৩৬টি গ্রন্থ। সব শেষে তিনি সবাইকে কৃতজ্ঞা জানান এই বলে যে, আপানারা এই গুনীমানুষের স্মরণসভায় এসেছেন এর জন্য আপনাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
সমস্ত অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয় পলাশ সেবা ট্রাস্টের সৌজন্যে।