বাংলাদেশের মানবাধিকার সুরক্ষায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসা প্রয়োজন
বাংলাদেশের চলমান মানবাধিকার পরিস্থিতি, হত্যা, সন্ত্রাস, নারী ও শিশুদের নির্যাতন-নিপীড়ন নিয়ে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন ব্রিটিশ-বাংলাদেশী বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। গত ২০ জানুয়ারী সোমবার লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে বক্তারা বাংলাদেশকে গণতন্ত্রহীন দেশ হিসেবে মন্তব্য করে বলেন, যেখানে গণতন্ত্র থাকে না সেখানে নারী-শিশু এবং সাধারণ জনগণ নির্যাতনের শিকার হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার তেতাল্লিশ বছর পর রাজনৈতিক কারনে রাষ্ট্রীয় বাহিনী এবং সরকার সমর্থকরা যে সীমাহীন নিপীড়ন চালাচ্ছে সেটা ভয়ানক। পাখির মতো মানুষ হত্যা করা হচ্ছে অথচ এর কোন প্রতিকার নেই। বক্তারা বলেন, কোন সভ্য দেশে, গণতান্ত্রিক দেশে এরকম পরিস্থিতি কল্পনা করা যায় না। বক্তারা দেশের গণতন্ত্রের উত্তরণে এবং মানবাধিকারের সুরক্ষায় জাতিসংঘ সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসা প্রয়োজন উল্লেখ করে বলেন, পৃথিবীর এমন কোন পার্লামেন্ট নেই যেখানে সরকারী দল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে ! বক্তারা অবিলম্বে দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং নিগৃহ মুক্ত করার আহ্বান জানান।
ব্রিটিশ বাংলাদেশী উইমেন্স ফোরামের উদ্যোগে ‘ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন্স এন্ড চিলড্রেন ইন বাংলাদেশ শীর্ষক সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ব্রিটিশ বাংলাদেশী উইমেন্স ফোরামের চেয়ারপার্সন মমতাজ খান। সেমিনারে ‘গণতন্ত্রহীন দেশ, ভুলণ্ঠিত নাগরিক অধিকার -শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাংবাদিক ও কলামিস্ট দ্যা সানরাইজ টুডে সম্পাদক এনাম চৌধুরী।
তাছলিমা তাজের পরিচালনায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির সাবেক উপদেষ্টা বিশিষ্ট সাংবাদিক মোখলেছুর রহমান। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন রাখেন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ডেপুটি মেয়র ওহিদ আহমদ, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ জমিয়তে উলামা উইরোপের আমীর আল্লামা মুফতি শাহ ছদর উদ্দিন, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের বিশেষ উপদেষ্টা ববি হাজ্জাজ, বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ফিওনা ভেরী, নাগরিক আন্দোলন এর আহ্বায়ক এম এ মালেক, বিশিষ্ট আইনজীবী, সেইভ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার নজরুল ইসলাম, বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আজমল মসরুর, এটিএন বাংলা ইউকের সিই্ও হাফিজ আলম বকস, কমিটি ফর ডেমোক্রেসী এন্ড হিউম্যান রাইটস্ এর চেয়ারম্যান মোশাহিদ হোসাইন, যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়ছর এম আহমেদ, বিশিষ্ট সাংবাদিক যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত আমার দেশ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি ওলি উল্লাহ নোমান। শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন গ্রেটার ময়মনসিংহ সোসাইটি ইউকের চেয়ারম্যান ফেরদৌসী রহমান, যুুক্তরাজ্য বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ চৌধুরী, ব্রিটিশ বাংলাদেশী উইমেন্স ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান অঞ্জনা আলম, শাম্মী হুদা দীঘি, জাসাসের সভাপতি এম এ সালাম।
উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব, সমাজসেবী ও সাপ্তাহিক নতুন দিন এর সিইও আলী সাদেক শিপু, নিউহাম বারার কাউন্সিলর আয়েশা চৌধুরী, নারী ম্যাগাজিন এর সম্পাদক শাহনাজ সুলতানা, সাংবাদিক আব্দুল মুনিম জাহেদী ক্যারল প্রমূখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাষ্ট্রপতির সাবেক উপদেষ্টা বিশিষ্ট সাংবাদিক মোখলেছুর রহমান বাংলাদেশে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশী নির্যাতিত উল্লেখ করে বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে এটা কখনোে আশা করা যায় না। তিনি আরও বলেন, জনগণকে নির্বাচনের বাইরে রেখে ভোটারবিহীন নির্বাচন করে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এসেছে। যে নির্বাচনে পাঁচ পার্সেন্ট ভোটারেরও উপস্থিতি নেই সেই নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার কখনো গণতান্ত্রিক সরকার হতে পারে না। তিনি বলেন, যারা আইনকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে নিজেদের ক্ষমতার দাপট দেখাচ্ছেন একদিন তাদেরও আইনের মুখোমুখী হতে হবে।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ডেপুটি মেয়র অহিদ আহমদ বলেন, যে দেশে মানুষকে তাদের গণতান্ত্রিক, সাংবিধানিক এবং রাজনৈতিক অধিকার স্বাধীনভাবে ভোগ করতে দেওয়া হয় না, সেই দেশের সরকার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হতে পারে না। আর গণতন্ত্রে বিশ্বাসহীন সরকারই স্বৈরতান্ত্রিক সরকার। তিনি বলেন, মানবতার বিরুদ্ধে সরকার যে অপরাধ করছে আমি বিশ্বাস করি তাদের বিচার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভূমিকা পালন করবে। তিনি নারী-শিশুদের জীবন ও ইজ্জতের নিরাপত্তা বিধানে মানবাধিকার সংগঠন সমূহকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
জমিয়তে উলামা ইউরোপের আমীর আল্লামা মুফতি শাহ ছদর উদ্দিন বাংলাদেশ মানবাধিকার এবং আইনের শাসন না থাকায় নারী, শিশু এবং সাধারণ নাগরিকদের অধিকার ভূলণ্ঠিত হচ্ছে উল্লেখ করে বলেন, বাংলাদেশের জনগণ আইনের শাসন ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। আর এজন্য সব সময়ই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন চেয়েছে। কিন্তু দুর্নীতি, সন্ত্রাস, লুটপাটকারীরা গণতন্ত্রহরণ করে দেশের নিরীহ জনগণকে জিম্মী করে তাদের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে ঘৃণ্য অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
নাগরিক আন্দোলন এর আহ্বায়ক এম এ মালেক বলেন, বাংলাদেশকে নিয়ে বহুমুখী ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। প্রতিবেশী একটি দেশ অবৈধভাবে নির্বাচিত সরকারকে সহযোগিতা দিয়ে দেশের নিরীহ জনগণের উপর উস্কে দিয়েছে। শেখ হাসিনা এখন লেন্দুপ জর্দিও ভূমিকায়। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ কখনও স্বাধীন দেশকে সিকীম বানাতে দেবে না।
সেইভ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার নজরুল ইসলাম বলেন, একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠি বা মতের বিরুদ্ধে আইনকে অপপ্রয়োগ করে সরকার নারী ও শিশুদের প্রতি প্রতিহিংসার আচরণ করছে। যে কোন ঘটনার সাথে সাথে প্রতিপক্ষের উপর দোষ চাপিয়ে প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করে দিচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের মানুষ আইনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবে। আর যে দেশে জনগণ আইনের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে সে দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া সম্ভব হয় না
বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আজমল মসরুর তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশে যদি গণতন্ত্র থাকতো তবে পথে, প্রান্তরে এভাবে লাশ পড়ে থাকতো না। অভিযানের নামে মানুষের ঘর-বাড়ী বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হতো না কিংবা আসামীকে না পেয়ে কথিত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানুষের সম্পদ বিনষ্ঠ করতো না। এসব ঘটনা হিংস্র বর্বরতা উল্লেখ করে বলেন, এসব ঘটনা বিচারযোগ্য। যারা এমনটি করছেন এবং যারা মদদ দিয়ে করাচ্ছেন তাদেরও বিচার হবে।
এটিএন বাংলা ইউকের সিই্ও হাফিজ আলম বকস, বাংলাদেশের নারী ও শিশুদের অধিকার সুরক্ষায় সরকারকে অবশ্যই যথাযথ ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, দেশের অর্থনীতিতে নারী সমাজের ভূমিকা ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
কমিটি ফর ডেমোক্রেসী এন্ড হিউম্যান রাইটস্ এর চেয়ারম্যান মোশাহিদ হোসাইন বলেন, বাংলাদেশের অসহায় নারী-শিশু ও নিরীহ জনগণের কান্নায় আকাশ ভারী হয়ে গেছে। সরকারী বাহিনী যুদ্ধ কবলিত দেশের মত নিরস্ত্র জনগণকে গুলি করে হত্যা করছে। গণতন্ত্রের এমন অদ্ভুদ নমুনা একমাত্র বাংলাদেশেই রয়েছে। তিনি দেশের মানুষকে নির্যাতন বন্ধের জন্য ক্ষমতাসীনদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, সাতক্ষীরা যদি ভারতীয় বাহিনী তোমাদের ক্ষমতায় রাখতে বর্বরতা চালাতে পারে তবে জাতিসংঘের বাহিনীও তোমাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে সব ধরনের প্রচেষ্ঠা চালাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। দেশপ্রেমিক শক্তিকে তিনি জুলুমের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আহ্বান জানান।
যুক্তরাজ্য বিএনপির সাধারণ সম্পাদক কয়ছর এম আহমেদ বলেন, পাঁচ পার্সেন্ট ভোট নিয়ে নির্বাচিত সরকার তাদের ভিশন-২০২১ পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেছে। কিন্তু জনগণের উপর নিপীড়নকারী শাসককে এতাদূরে যাওয়ার স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে যাবে। জনগণকে কখনো বন্দুকের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। স্বেচ্ছায় ক্ষমতা না ছাড়লে বিতাড়িত করা হবে।
আমার দেশ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি ওলি উল্লাহ নোমান তার বক্তব্যে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে বলেন, সরকার দুঃশাসনের মাত্রা ত্যাগ করেছে। এভাবে কোন দেশ চলতে পারে না। তিনি নারী ও শিশুদের জীবন রক্ষায় বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা সমূহের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
সভাপতির বক্তব্যে ব্রিটিশ-বাংলাদেশী উইমেন্স ফোরামের চেয়ারপার্সন মমতাজ খান বলেন, বাংলাদেশের নারী-শিশু ও নিরীহ নাগরিকদের জীবন কোন অবস্থায় রয়েছে সেটার প্রমাণ পদে পদে দেখতে পাচ্ছে। যেখানে মানুষকে গুলি করে হত্যা করে, গুম করে দিলে, পিটিয়ে মাড়লে কোন জবাদিহীতা নেই সেখানে কোন আইনের শাসন রয়েছে বলা চলে না। মমতাজ খান দেশের গার্মেন্টস্ ফ্যাক্টরীগুলোর নারী শ্রমিকদের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বলেন, যাদের শ্রমের ফলে দেশ আজ বিশ্বের কাছে পরিচিত সেই তাদের পরিশ্রমিক নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে তামাশা করা হচ্ছে। তিনি শ্রমিকদের যথাযথ মজুরী প্রদানের দাবী জানান। মমতাজ দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা যে দেশে নিজেদের উপার্জিত অর্থ ব্যয় করি সে দেশে যদি আমাদের স্বজনদের জীবনের কোনা নিরাপত্তা না থাকে তবে আমরা বসে থাকতে পারি না। তিনি রাজনৈতিক, সামাজিক, মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং নারী শিশুদের নিরাপত্তা বিধানে কাজ করার আহ্বান জানান।