হজরতজী মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াছ (রহ.) তাবলিগ জামাতের পথিকৃত্

মুফতি মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ:
ইসলামী দাওয়াতের মূল প্রেরণা হচ্ছে কল্যাণকামিতা। দাওয়াত অর্থ আহ্বান। আর ইসলামী দাওয়াতের সার কথা হলো কল্যাণের দিকে আহ্বান। কল্যাণ ও অগ্রগামিতার এই সাধনায় আত্মনিয়োগ করার আদেশ দিয়ে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে—‘ইয়া আয়্যহাল্লাযীনা আমানু আমিনু’ হে ঈমানদারগণ, সত্যিকার অর্থে ঈমান আনয়ন কর…। (নিসা: ১৩৬)। শুধু নাম ও জাতীয়তার পরিচয় থেকে উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্বাস ও কর্মে, চিন্তা এবং চেতনায়, সংস্কৃতি ও জীবন ধারায় পূর্ণাঙ্গ মুমিন হওয়ার এটা অমোঘ নির্দেশ। এই কোরআনী নির্দেশ বহন করে দায়ী—ইল্লাল্লাহগণ আল্লাহর বান্দাদের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন এবং এই পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন। মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস ও কর্মের সংশোধনে এই দাওয়াত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।
এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, ওলী-বুজুর্গ ও দ্বীনের দায়ীদের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে এ অঞ্চলের মানুষ দ্বীন ও ঈমানের সম্পদ লাভ করেছে। আর তাঁদের নির্মোহ আদর্শিক জীবনযাপন অসংখ্য মানুষের জীবন ও কর্মে আমূল পরিবর্তন এনেছে। হিজরি অষ্টম শতাব্দীর বিখ্যাত জীবনীকার সাইয়েদ মুহাম্মাদ ইবনে মুবারক আলাভী (মৃত্যু : ৭৭০ হি:) তত্কালীন ভারতবর্ষের অবস্থা এবং হজরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.)-এর অবদান প্রসঙ্গে লেখেন, ‘গোটা ভারতবর্ষে কুফর, শিরক ও মূর্তি পূজার আখড়া ছিল। একদিকে দাম্ভিক লোকদের মুখে ‘আমিই বড় খোদা’র ঘোষণা উচ্চারিত হচ্ছিল অন্যদিকে ইট-পাথর, বৃক্ষ-লতা, গাভী-গোবর ইত্যাদি বস্তুকে তারা উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছিল।… এ পরিস্থিতিতে এ ভূখণ্ডে তার আগমন ঘটে এবং তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ইসলামের নূর বিকশিত হতে থাকে।’ (তারিখে দাওয়াত ওয়া আযিমত ৩/২৮-২৯)
মোট কথা, বুযুর্গানে দ্বীনের নিঃস্বার্থ কর্ম প্রচেষ্টার ফলে এ ভূখণ্ডে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে এবং মানুষের চারিত্রিক উন্নতি সাধিত হয়েছে। সমাজ সংস্কারের এই ধারায় কখনো ছেদ ঘটেনি। প্রতি যুগে দায়ী-ইলাল্লাহগণ সমাজ-সংস্কারের এ দায়িত্ব সুচারুরূপে আঞ্জাম দিয়েছেন। এ সিলসিলার বুযুর্গানে দ্বীনের কর্ম ও অবদান সম্পর্কে আলোচনার এক পর্যায়ে হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদাবী (রহ.) লেখেন, ‘আমাদের এই যুগে তাঁদের মাধ্যমে দ্বীনের সংরক্ষণ ও সমাজ-সংস্কারের কাজ ব্যাপকভাবে হয়েছে। দারুল উলুম দেওবন্দ, মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুর-এর ইলমে দ্বীন প্রচার-প্রসারের মেহনত, মাওলানা থানভী (রহ.)-এর রচনাবলী ও মাওয়ায়েজ এবং সর্বশেষে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ-এর দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে এই সিলসিলার ফুয়ুয ও বারাকাত সারা বিশ্বে প্রচারিত হয়েছে।’ (তারিখে দাওয়াত ওয়া আযীমত ৩/৪৮-৪৯)
আল্লাহর পথের রাহবার মহান ও পবিত্র ব্যক্তিত্ব হযরতজী মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াছ (রহ.) শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ)-এর বংশ ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত তত্কালীন সময়ের সর্বজন শ্রদ্ধেয় বুযুর্গ ও আলেম মাওলানা ইসমাঈল (রহ.)-এর ঔরসজাত সন্তান। ১৩০৩ হিজরীতে জন্মলাভকারী হযরতজী ইলিয়াছ (রহ.) মাতুলালয় কান্দালায় এবং পিতার সান্নিধ্যে নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.) মাজারের সন্নিকটে বস্তি নিজামুদ্দীনে তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়। হযরতজী (রহ.) মাতা ছিলেন কুরআনুল কারীমের হাফেজা। মক্তব্যে কোরআন শিক্ষা গ্রহণ করে পারিবারিক রীতি অনুযায়ী হযরতজী কোরআন হিফজ করেন। ১৩১৪/১৫ হিজরীতে পিতার অনুমতিক্রমে মেজভাই মাওলানা ইয়াহইয়া হযরতজীকে গঙ্গোহে হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গোহীর কাছে নিয়ে যান। সে সময় তিনি ছিলেন ১০/১১ বছরের বালক। ১৩২৩ হিজরীতে মাওলানা গঙ্গোহীর (রহ.) ইন্তেকালের সময় তাঁর বয়স ছিল ২০ বছর। প্রায় দশ বছর পর্যন্ত হযরতজী যুগশ্রেষ্ঠ আলেম, বুযুর্গ হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গঙ্গোহী (রহ.)-এর সান্নিধ্যে অতিবাহিত করেন। গঙ্গোহী (রহ.) অল্পবয়সী কাউকে শিষ্য না করলেও মাওলানা ইলিয়াছের চরিত্র মাধুরীতে মুগ্ধ হয়ে তিনি বাইআতের মাধ্যমে তাকে শিষ্যরূপে গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে তিনি হযরত ছাহারানপুরী (দ.) শাহ আব্দুর রহিম রায়পুরী (রহ.), হযরত মানবী (রহ.) প্রমুখের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগ বৃদ্ধি করেন এবং এই সময় শায়খুলহিন্দ মাহমুদুল হাসান (রহ.) হাতে জিহাদের বাইআত গ্রহণ করেন। বয়স কম হলেও সমকালীন বুযুর্গদের স্নেহ ও শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠেন হযরতজী (রহ.)। ১৩২৬ হিজরীতে হযরতজী হাদিসের উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে দারুল উলুম দেওবন্দ গমন করে শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রহ.)-এর কাছে বুখারী শরীফ ও তিরমিজী শরীফের শিক্ষা লাভ করেন এবং এরপর বড় ভাই মাওলানা ইয়াহইয়ার নিকটও হাদিসের শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে মাওলানা ছাহারনপুরী (রহ)-এর সঙ্গে আধ্যাত্বিক সম্পর্ক স্থাপন করেন।
দাওয়াত ও তাবলীগ : ১৩৪৪ হিজরি। হযরতজী দ্বিতীয় হজব্রত পালন শেষে মদিনা শরীফ গমন করলেন। প্রত্যাবর্তনের সময় হওয়ার পরও তিনি কিছুতে মদিনা শরীফ ছেড়ে চলে আসতে চাইছিলেন না। তার মাঝে বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হলো, সঙ্গীরাও তাকে ছেড়ে আসলেন না। মদিনা শরীফ থেকে তাঁর মাধ্যমে বড় কাজ নেয়ার ইঙ্গিত দেয়া হয়। তিনি অস্থির হয়ে একজন আবেদের স্মরণাপন্ন হলেন। তিনি হযরতজীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আপনি অস্থির হবেন না, যিনি কাজ নেয়ার তিনিই এর ব্যবস্থা করবেন। হজ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর হযরতজী (রহ) তাবলীগী দাওয়াত তথা গাশ্ত আরম্ভ করেন। অন্যদেরও ইসলামের বিধিবিধান শিক্ষা ও প্রচারের আহ্বান জানান। এমন সময় ‘নূহ’ নামক স্থানে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সে সম্মেলনে তিনি ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মানুষের মাঝে ইসলামের মূলনীতি প্রচার করার দাওয়াত প্রদান করেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রস্তুতির জন্য অনুরাগীগণ এক মাস সময় নেন। এক মাসের মধ্যে একটি জামাত তৈরি হয়ে গেল। এই জামাত আট দিনে পূর্ব নির্ধারিত একটি গ্রামে দাওয়াতী কাজ করলেন। পুনরায় সিদ্ধান্ত হলো পরবর্তী এক সপ্তাহ কাজ করে, জামাত গোরগাঁও জেলার সোহিনী নামক স্থানে জু’মার নামাজ আদায় করবে। পরবর্তী কর্মসূচি সেখানেই প্রণয়ন করা হবে।
তাবলীগ জামাতের প্রথম জুমা সোহিনীতে আদায় করা হলো। পরবর্তী সপ্তাহেও যথারীতি কাজ করার পর ‘তাউর’ নামক স্থানে জু’মার নামাজ আদায় করা হলো। ফিরোজপুর তহশীলের আঙ্গিনায় আদায় করা হয় তৃতীয় জুমা। প্রতিটি জুমায় অংশগ্রহণ করে হযরতজী পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণ করে দিতেন। ‘মেওয়াত’ এলাকায় এভাবে বেশ কিছুদিন পর্যন্ত এই দ্বীনী কাজ অব্যাহত থাকে। এইসব জামাতের প্রতিটি সম্মেলনে উলামাদের ডেকে ওয়াজ নসিহতের ব্যবস্থা করা হতো। কয়েক বছর দাওয়াত ও তাবলীগের প্রাথমিক কাজ এভাবে চলতে থাকে।
১৩৫১ হিজরীতে তৃতীয়বার হজব্রত পালন শেষে স্বীয় কর্মপন্থা সম্পর্কে সুদৃঢ় প্রত্যয় ও আশাবাদ নিয়ে হযরতজী (রহ.) স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ফলে কাজের গতি বৃদ্ধি পায়। হযরতজীর (রহ) মত ছিল কাজের সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো মানুষের অন্তরে দ্বীন ও ঈমান শিক্ষার জন্য প্রকৃত আগ্রহ সৃষ্টি করা এবং আখিরাতের মুক্তি লাভের উদ্দেশ্যে অকাতরে জানমাল ত্যাগ স্বীকার করার ন্যায় উন্নত চরিত্র ও মানসিকতা সৃষ্টি।
হিন্দুস্থানে দ্বীনের প্রসার কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ইসলামের প্রাণকেন্দ্র মক্কাশরীফে গমন করে এর তত্পরতা আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তদানুযায়ী তিনি ১৩৫৬ হি. কয়েকজন বিশিষ্ট সঙ্গীসহ মক্কা শরীফ গমন করেন। এদিকে দিল্লি ও মেওয়াতের কাজ সুচারুরূপে আজাম দেয়ার জন্য বিশ্বস্ত কয়েকজনকে দায়িত্ব প্রদান করেন। মক্কা শরীফ, জেদ্দা, হজর, মিনা, মদিনা শরীফের কুরা, ও হুদাসহ বিভিন্ন স্থানে জামাত বন্দি হয়ে দাওয়াতের কাজ করতে থাকেন। বিভিন্ন দেশের আলেম উলামা ও দ্বীনদার ধর্মপ্রাণ মানুষকে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে উদ্বুদ্ধ করেন।
এবার ভারত প্রত্যাবর্তনের পর হযরতজী (রহ.) মেওয়াত এলাকায় দাওয়াতের কাজ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করলেন। বৃদ্ধি করলেন সফর ও গাশ্ত। নব উদ্দীপনা ও উত্সাহে জামাত বের হয়ে ইউপির বিভিন্ন শহর ও গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। মেওয়াতের ন্যায় দিল্লিতেও মোবাল্লিগ-এর সমাবেশ বৃদ্ধি পেতে থাকল। জামাত তৈরি করে বিভিন্ন মহল্লায় সাপ্তাহিক গাশতের সূচনা হলো। এভাবে ক্রমান্বয়ে সম্প্রসারিত হতে থাকে তাবলীগের কাজ। তাবলীগী আন্দোলনে নিয়োজিত নিবেদিত প্রাণ কর্মীরা নিজেদের কর্মতত্পরতা পর্যালোচনার জন্য জুমার রাতে নিজামুদ্দিনে উপস্থিত হয়ে নিজেদের কর্মতত্পরতা পর্যালোচনা করে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করতেন। এই সমাবেশে সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকতেন হযরতজী (রহ.)। এভাবে প্রায় প্রতি মাসে মেওয়াতের কোনো স্থানে এবং বছরে একবার নূহের মাদরাসায় ইজতেমা অনুষ্ঠিত হতো। ১৩৬০ হিজরীর ৮,৯ ও ১০ জিলকদ মোতাবেক ১৯৪১ সালের ২৮, ২৯ ও ৩০ নভেম্বর গোরগাঁও জেলার ‘নূহ’ নামক স্থানে স্মরণকালের বৃহত্তম ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। এর সূত্র ধরে আজ ঢাকার অদূরে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমাবেশ বিশ্ব ইজতেমা।
ইন্তেকাল : ১২ জুলাই বুধবার দিবাগত রাতে এই বিশ্বজয়ী দ্বীনের আহ্বায়ক, ফেরেশতাতুল্য পূতপবিত্র মনীষী হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াছ (রহ.) শেষ রাতে তাহাজ্জুদের সময় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্নাইলাইহি রাজিউন। আল্লাহ দ্বীনের এই মহান মুবাল্লিগকে চিরস্থায়ী জান্নাতের অফুরন্ত নেয়ামত দান করুন।
লেখক : শিক্ষক ও ইসলামী রাজনীতিক

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button