৩৭ বছরে সরকারের ব্যাংক ঋণ ৫২ হাজার কোটি টাকা, মহাজোটের ৫ বছরে ৬০ হাজার কোটি
স্বাধীনতার পর ৩৭ বছরে সরকারগুলো ব্যাংকিং খাত থেকে যা ঋণ নিয়েছে গত ৫ বছরে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ঋণ নিয়েছে তার চেয়েও বেশি। আগের ৩৭ বছরে সরকারগুলো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৫২ হাজার ৮২৪ দশমিক শূন্য ৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে গত ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৭৬৬ দশমিক ১৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই ৫ বছরে মহাজোট সরকার একাই ঋণ নিয়েছে ৬০ হাজার ৯৪২ দশমিক ১২ কোটি টাকা।সরকারের এ ঋণ ব্যাংকিং খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, এভাবে চললে ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাতে খুবই অসুবিধা হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে অষ্টম সংসদের নির্বাচিত সরকার পর্যন্ত, তত্ত্বাবধায়ক এবং সামরিক সরকার সব মিলিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থা যত ঋণ নিয়েছে, নবম সংসদের সরকার একাই তার চেয়ে অনেক বেশি ঋণ নিয়েছে।
জানা গেছে, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাড়ে ৩ বছর, খন্দকার মোশতাকের ৩ মাস, জিয়াউর রহমানের সাড়ে ৫ বছর, বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের পৌনে ১ বছর, এরশাদের ৯ বছর, শেখ হাসিনার ইতোপূর্বের ৫ বছর, খালেদা জিয়ার ১০ বছর, ফখরুদ্দিন আহমেদের ২ বছর (২০০৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত) এবং মাঝের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর সময়সহ সব মিলিয়ে ৩৭ বছরে ব্যাংক ঋণের স্থিতি ছিলো ৫২ হাজার ৮২৪ দশমিক শূন্য ৫ কোটি টাকা। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত গত ৫ বছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে দাঁড়ায় দ্বিগুণেরও বেশি। এ পর্যন্ত ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৭৬৬ দশমিক ১৭ কোটি টাকা।
প্রতি বছরের জুন পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী দেখা গেছে, ২০০৯ সালের জুন পর্যন্ত সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়েছে ৫৮ হাজার ১৮৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০০৮ সালের এ সময়ে ঋণের পরিমাণ ছিলো ৪৭ হাজার কোটি টাকা। ২০১০ সালের জুনে দাঁড়ায় ৬৪ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। ২০১১ সালের জুনে ৭৩ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। ২০১২ সালের জুনে ৯৩ হাজার ৬৪৮ কোটি টাকা এবং ২০১৩ সালের এ সময়ে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৯ হাজার ১৯৬ হাজার ৩২ কোটি টাকা।
সূত্রটি জানায়, ২০১৩ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ ছয় মাসে সরকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছে ১১ হাজার ২৬৮ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। অন্যদিকে, আলোচ্য এ সময়ে সরকার কর্তৃক ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে মাত্র ৬৪৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, মহাজোট সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের আগের সরকার ২০০৮ সালের ৪ জুন থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইস্যুকৃত ৫, ১০, ১৫ এবং ২০ বছর মেয়াদী বিজিটি বন্ডের ৬ হাজার ৬১০ কোটি ১৭ লাখ টাকা, ৯ জুন থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত পরিশোধিত ৩ বছর মেয়াদী বিজিটি বন্ডের উপর ৫১৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ৩০ জুন তারিখে পরিশোধিত ২৫ বছর মেয়াদী বিশেষ ট্রেজারি বন্ড এর ১৬ কোটি ৩৯ লাখ টাকা সমন্বয় করে এ ঋণ নেয়।
এদিকে, ২০১৩ সালের ছয় মাসের হিসেবে দেখা গেছে, এ বছরের ৩ জুলাই থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ইস্যুকৃত ২, ৫, ১০, ১৫ এবং ২০ বছর মেয়াদী বিজিটি বন্ডের ৮ হাজার ৫২৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা, একই বছরের ১৬ জুলাই থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিশোধিত পাঁচ বছর মেয়াদি বিজিটি বন্ডের ওপর ১ হাজার ১৬৩ কোটি ৭ লাখ টাকা, ২ জুলাই পরিশোধিত ২৫ বছর মেয়াদী বিশেষ ট্রেজারি বন্ডের (জুট) ২ কোটি ৭৪ লাখ টাকা সমন্বয় করে সরকার এ ঋণ নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দীন আহমেদ শীর্ষ কাগজকে বলেন, রাজস্ব আয় ঘাটতি থাকায় সরকার ব্যাংক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এভাবে ঋণ গ্রহণ যদি চলতে থাকে এবং পরিশোধ যদি না করে তাহলে ভবিষ্যতে ব্যাংকিং খাত খুবই অসুবিধার মধ্যে পড়বে।
প্রাইভেট সেক্টর হুমকির মধ্যে পড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটার কারণে ব্যাংক মুনাফায়ুও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ব্যাংকিং খাত বাঁচাতে হলে সরকারকে এ অর্থ দ্রুত ফেরত দিতে হবে এবং ঋণ গ্রহণের মাত্রা কমাতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আকবার আলী খান বলেন, সরকারের ব্যাংক ঋণ কিছুটা বেড়েছে ঠিক। তবে এটা সহনশীলতার মধ্যে রয়েছে। ঘাটতির হার এখনো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ এস এম বুলবুল বলেন, সরকারের ব্যাংক ঋণের মূল কারণ উন্নয়ন খাতে খরচের জন্য ব্যবহার করা। তবে এটা বাড়ানো ঠিক নয়। সম্প্রতি যেভাবে দেশে আন্দোলন হয়েছে, তাতে করে দেশে সকল উৎপাদন কমে গেছে। সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমে গেছে। সরকারকে এ কারণে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।
তবে তিনি আশা করেন আগামী মার্চ মাসের প্রতিবেদনে সরকারের ব্যাংক ঋণ অনেক কমে আসবে।
এদিকে একাধিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, বিদেশ থেকে সাহায্য-সহযোগিতা কমে গেছে। এ কারণে সরকার বেসরকারি খাত থেকে ঋণ গ্রহণ করছে। এতে করে ব্যাংকগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নেয়ার কারণে তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলেও তাতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কেননা বেসরকারি খাতে ঋণ চাহিদা কম থাকায় সরকারের চাহিদার পুরোটাই এখন সরবরাহ করছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। যা অলস অর্থ ব্যাংকে ফেলে রাখার চেয়ে উত্তম।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মু. মাহফুজুর রহমান বলেন, এ সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ নিয়েছে বলে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কারণ যত বেশি ঋণ নেবে, ততো দেশে উন্নয়ন ঘটবে।
উল্লেখ্য, বিয়াল্লিশ বছরে বিভিন্ন দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে বাংলাদেশ ৫ হাজার ৯৩০ কোটি মার্কিন ডলার পেয়েছে। এর মধ্যে ঋণ হিসেবে পাওয়া গেছে ৩ হাজার ৪৬৫ কোটি মার্কিন ডলার। অনুদান ২ হাজার ৪৬৫ কোটি মার্কিন ডলার। সাপ্তাহিক শীর্ষ কাগজের সৌজন্যে