ফিনল্যান্ড : উচ্চশিক্ষার এক স্বর্গরাজ্য
ড. মাহরুফ চৌধুরী:
উত্তর ইউরোপের নরডিক দেশগুলোর একটি হলো ফিনল্যান্ড। ইউরোপ মহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে বিভিন্ন কারণেই এ দেশটি বিখ্যাত। তবে সাধারণ বাংলাদেশী অনেকের কাছেই নকিয়ার জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত এ দেশ। ফিনিস ভাষায় ফিনল্যান্ডকে বলা হয় ‘সুওমি’ (ঝঁড়সর)। ‘সুওমি’ শব্দের অর্থ ‘হ্রদ ও দ্বীপভূমির দেশ’। ফিনল্যান্ড হচ্ছে ‘হ্রদ’ আর ‘দ্বীপ’-এর দেশ। হ্রদের সংখ্যা ৬০ হাজার আর দ্বীপের সংখ্যা ৬ হাজার ৫০০। সবচেয়ে বড় হ্রদের নাম ‘সায়মা’। সায়মার আয়তন ৪ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার। বেশিরভাগ হ্রদের আয়তন ২৫ বর্গকিলোমিটারের বেশি নয়। বেশিরভাগ এলাকা সমতল হলেও বেশ কিছু পাহাড়ও রয়েছে এদেশে।
আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে ফিনল্যান্ড ৬৫তম আর ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে অষ্টম। মোট আয়তন ৩ লাখ ৩৮ হাজার ১৪৫ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালের হিসাব অনুযায়ী জনসংখ্যা ৫৩ লাখ ২ হাজার ৭৭৮ জন। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের মধ্যে দেশটি ১১১ নম্বরে রয়েছে। ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী ফিনল্যান্ডে প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব মাত্র ১৬, যেখানে বাংলাদেশে প্রায় ১ হাজার ১৪৩ জন বসবাস করে। ফিনল্যান্ডের পশ্চিমে সুইডেন, পূর্ব ও দক্ষিণে রাশিয়া, উত্তরে নরওয়ে এবং দক্ষিণের অংশবিশেষ ফিনল্যান্ড উপসাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত। মাথাপিছু আয় ৩৪ হাজার ৮১৯ মার্কিন ডলার হলেও এদেশের জাতীয় আয় জনসংখ্যার চেয়েও দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে।
ঐতিহাসিকভাবে এদেশের লোকেরা সপ্তম শতাব্দীতে রাশিয়ার ভোলগা নদীর অববাহিকা থেকে এ অঞ্চলে এসেছিল। এক সময় ফিনল্যান্ড ছিল সুইডেনের অংশ। সে কারণে এদেশে এখনও সুইডিশ ভাষা ও সংস্কৃতির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৭ শতাংশ এখনও সুইডিশ বংশোদ্ভূত ও সুইডিশ ভাষায় কথা বলে। ১৮০৯ সাল থেকে ১৯১৭ সালের শেষভাগ পর্যন্ত ফিনল্যান্ড রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ফিনল্যান্ড নিজেকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। তাই দেশটির স্থাপত্যে রাশিয়ান প্রকৌশলের ছাপ সুস্পষ্ট।
পৃথিবীর যে ক’টি দেশের ভূ-ভাগ নিয়মিতভাবে বেড়ে চলেছে, তার মধ্যে ফিনল্যান্ড একটি; যার ভূমি প্রতি বছর প্রায় ৭ বর্গকিলোমিটারের মতো বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলেন, বরফ যুগের পরের সময় থেকে প্রতিনিয়ত ফিনল্যান্ডের উপরিভাগের বরফের স্তর হালকা হয়ে আসছে, যার ফলে জেগে উঠছে ভূ-ভাগ। এদেশের মোট জমির মাত্র ৭ শতাংশে চাষাবাদ হয়ে থাকে। দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল বার্লি, যব এবং গম হলেও সারা দেশে আলু ও সুগার বিট জন্মে। আর রয়েছে হাঁস-মুরগি, গরু-বাছুর, ভেড়া ও শূকরের খামার। তাছাড়া দেশে প্রায় ৪ লাখ ১৪ হাজার পোষা বলগা হরিণ রয়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে যেখানে জনবসতি কম, সেখানে ভালুক, নেকড়ে, বনবিড়াল এবং মেরুশিয়াল দেখতে পাওয়া যায়।
বনজ সম্পদ ফিনল্যান্ডের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে যেখানে একটি দেশের ২৫ ভাগ এলাকায় বনভূমি থাকা দরকার, সেখানে ফিনল্যান্ডের ৭২ ভাগই হচ্ছে বনভূমি। এদেশের বনাঞ্চলে ১২শ’ প্রজাতির গাছপালা এবং লতাগুল্ম আছে। তাই এদেশের প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ কাঠ। ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে এদেশের বন ও কাঠচেরাই কারখানা সবচেয়ে বিখ্যাত। কাঠের গুঁড়ি চালি বেঁধে নদীপথে ভাসিয়ে উপকূলীয় এলাকার করাত কলগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। কলকারখানায় নানা ধরনের কাঠের পণ্য তৈরি করে বিভিন্ন দেশে রফতানি করা হয়। এসব রফতানি সামগ্রীর মধ্যে আছে কাগজ, মণ্ড, নিউজপ্রিন্ট, বোর্ড, প্লাইউড ইত্যাদি। এ থেকে দেশের মোট রফতানি আয়ের ৪০ শতাংশ আসে যা দিয়ে প্রয়োজনীয় নানা পণ্য আমদানি করা হয়ে থাকে। আমদানি পণ্যের মধ্যে আছে পেট্রোলিয়াম, রাসায়নিক দ্রব্য, যন্ত্রপাতি, গাড়ির যন্ত্রাংশ, লোহা, ইস্পাত, খাদ্য এবং বস্ত্র সামগ্রী।
ফিনল্যান্ড একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র। তাই বেকার, অসুস্থ, অক্ষম এবং বৃদ্ধদের রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেই সার্বিক সহযোগিতা করা হয়। যুদ্ধাহতদের জন্য রাষ্ট্র ক্ষতিপূরণ প্রদান করে। রাষ্ট্রের নাগরিকদের কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। তাছাড়া প্রতিটি পৌর এলাকায় রয়েছে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যার ব্যয় রাষ্ট্রই বহন করে থাকে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদেশিদের তাদের ওষুধপত্র ও চিকিত্সার খরচ বহন করতে হয়। এদেশে প্রতি ১ হাজার জনের জন্য রয়েছে ৬৯৩টি টেলিভিশন এবং ১ হাজার ৬২৬টি রেডিও। সারা দেশে ৫৫টি দৈনিক পত্রিকা ও নিয়মিতভাবে অসংখ্য সাময়িকী প্রকাশিত হয়। এদেশের মানুষ বই পড়তে খুব ভালোবাসে। তাই সারা দেশে দেড় হাজারেরও বেশি লাইব্রেরি রয়েছে। ১৮৬০ সালে প্রতিষ্ঠিত হেলসিঙ্কি লাইব্রেরিতে প্রায় ২১ লাখ বই রয়েছে। হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি হচ্ছে জাতীয় লাইব্রেরি। এখানে বইয়ের সংখ্যা ২৬ লাখ। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি রয়েছে ফিনিসদের বেশ আগ্রহ। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় ৩০০ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দেশের নানা স্থানে।
যদিও ফিনল্যান্ডের আয়তন যুক্তরাজ্যের সমান, আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে এখানে বসবাস করে মাত্র অর্ধকোটি মানুষ। রাষ্ট্রীয়ভাবে ফিনিশ ও সুইডিশ ভাষা এদেশের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু এখানে রাশিয়ান ও আরবি বহাল তবিয়তে স্থান করে নিয়েছে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যবসায়িক ও একাডেমিক যোগাযোগের কারণে জাপানি ভাষাভাষী লোকের সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়। তাই বেশিরভাগ ফিনিশ নাগরিকই কমপক্ষে তিনটি ভাষায় কথা বলতে সক্ষম। কারণ ইংরেজিও এখানে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে নিজের স্থান করে নিয়েছে। এ দেশ জার্মানি কিংবা ইতালির মতো নয়, এখানে সর্বত্রই ইংরেজির প্রচলন আছে। তাই ফিনিশ কিংবা সুইডিশ না জেনেও আপনি দিব্যি আপনার দৈনন্দিন কাজকর্ম সেরে নিতে পারবেন।
এখানকার বাংলাদেশী কমিউনিটি দেশটির জনসংখ্যা অনুযায়ী বেশ বড়ই বলতে হবে। তারা বিভিন্ন জন বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত, আর কেউ কেউ ব্যবসায়িক সাফল্যের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত এদেশে। তবে মূলত অধিকাংশ বাংলাদেশীই এদেশে এসেছে পড়াশোনা করতে। তারপর আস্তে আস্তে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে বিভিন্ন পেশায়। আর কেউ কেউ আস্তে আস্তে নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে তুলছে। অনেকেই তাদের পড়াশোনা শেষ করেনি, বিশেষ করে যারা স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করতে এসেছিল। তাই ফিনিশ সরকার বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য স্নাতক কোর্সগুলোতে ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ ঢাকায় চালু করেছিল তা আপাতত স্থগিত করেছে। এখন শুধু স্নাতকোত্তর শ্রেণীতেই সরাসরি ভর্তি হওয়ার সুযোগ আছে। সে যা-ই হোক, তারা সবাই অভিবাসী বাংলাদেশী হিসেবে ফিনল্যান্ডে তাদের আবাস গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছে।
শিক্ষা ব্যবস্থা
আমি ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণেই ফিনল্যান্ডের শিক্ষাকে এ লেখার মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে নিয়েছি। ২০০০ সালে প্রথম আমি ফিনল্যান্ডের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠি, যখন জানতে পারলাম যে এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য টিউশন ফি দিতে হয় না। সে যা-ই হোক, তখন বিনা ফিতে পড়তে যাওয়ার জন্য হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক নীতিমালা বিভাগে আবেদন করেছিলাম। সামাজিক নীতিমালা বিভাগ আমাকে শর্তযুক্ত অনুমোদনপত্র পাঠিয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আমার আর ফিনল্যান্ড যাওয়া হয়নি। আমি চলে এলাম ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে। সেকথা বলার অবকাশ এখানে নেই। সে যা-ই হোক, তৃতীয়বারের মতো আমার হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে। বিভিন্ন সময়ে দেশটি ভ্রমণের অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে ও আমার অধীত জ্ঞানের সমন্বয়ে আমি এই লেখা তৈরি করার চেষ্টা করছি। এবার ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা ও সেখানে পড়াশোনার নানা সুযোগ-সুবিধার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
শিক্ষা একটি জন্মগত অধিকার ও রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত সেবা হিসেবে বিবেচিত হয় ফিনল্যান্ডে। ফিনল্যান্ড ৭ থেকে ১৬ বছর বয়সী ছেলেমেয়েরা বিনামূল্যে শিক্ষা লাভ করে। প্রাথমিক স্কুলে ৬ বছর এবং মাধ্যমিক স্কুলে ৩ বছর লেখাপড়া করা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। গবেষণায় ফিনল্যান্ডের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বিশ্বের শিক্ষা ছকের শীর্ষে অবস্থান করছে। গবেষণার ফলাফল ভাষা, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়াবলির ভিত্তিতে হয়েছে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত কোনো অভিজ্ঞতা এখনও হয়নি সেখানকার স্থানীয় প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনের। তবে বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপের মাধ্যমে কিছুটা দেখার সুযোগ হয়েছিল।
উচ্চশিক্ষার জন্য ফিনল্যান্ডে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়, অসংখ্য কলেজ এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ স্কুল রয়েছে। ইউরোপের যে দেশগুলোতে টিউশন ফি ছাড়া উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা যায় তাদের একটি ফিনল্যান্ড। তাই এদেশে প্রতি বছর এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের উদ্দেশে পাড়ি জমায়। তবে তাদের বেশিরভাগই স্নাতক পর্যায়ের বিভিন্ন প্রোগ্রামে ভর্তি হয়। এদেশে বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার বিশেষ সুযোগ রয়েছে। এখানে অভিবাসীদের ছেলেমেয়েদের জন্য তাদের নিজেদের ভাষা শিক্ষার সুযোগও রয়েছে, যেটা যুক্তরাজ্যের মতো বহু বর্ণ ও সংস্কৃতির দেশেও অনুপস্থিত।
ফিনল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশেষ করে স্নাতক স্তরে ভর্তির জন্য কেন্দ্রীয় একটি প্রতিষ্ঠান আছে (https://www.admissions.fi/), যার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ফলিত বিজ্ঞানের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করতে হয়। এ ওয়েবসাইটে এদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা তথ্য পাওয়া যাবে। তাছাড়া সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির জন্য আরেকটি ওয়েব পোর্টাল আছে (http:// universityadmissions.fi/) যার মাধ্যমে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনোটিতে ভর্তির জন্য আবেদন করা যায়। কিন্তু স্নাতকোত্তর বিষয়াবলির জন্য এককভাবে সম্পৃক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য আবেদন করার সুযোগ আছে। কোনো রকম সমস্যা দেখা দিলে এওয়েবসাইট দুটো থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম সংগ্রহ করে গুগল সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে (www.google.com) অনুসন্ধান করলে সহজে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবপেইজ কিংবা অন্য কোনো সাইটে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যেতে পারে। তাছাড়া এ নিবন্ধের শেষের দিকে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম ও তাদের ওয়েব অ্যাড্রেসগুলো দেয়া আছে। তা থেকে সরাসরি যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়বেসাইটে যেতে পারেন।
শিক্ষার মাধ্যম
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রভাষা দুটো—ফিনিশ আর সুইডিশ। তবে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিনিশ ভাষায় পড়াশোনা করতে হয়। সে জন্য বিশেষ করে স্নাতক স্তরের পড়াশোনার জন্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের ফিনিশ বা সুইডিশ ভাষার ওপর ভালো দক্ষতা থাকতে হবে। তবে একজন বিদেশিকে অবশ্যই প্রাথমিক ভাষা দক্ষতা হিসেবে ইংরেজি জানতে হবে, নচেত্ সমস্যায় পড়তে হবে।
উচ্চশিক্ষার কাঠামো ও স্তর বিন্যাস
উচ্চশিক্ষার জন্য ফিনল্যান্ডে ২৭টি ফলিত বিজ্ঞানের (Applied Sciences) এবং ১৬টি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ফলিত বিজ্ঞানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূলত পলিটেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়। এদেশে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয় সবচাইতে বড়। ১৬৪০ সালে স্থাপিত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৮২৮ সালে দেশের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে স্থানান্তরিত হয়। ২৭টি ফলিত বিজ্ঞানের বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৪টিতে একাডেমিক লেখাপড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তার মধ্যে ৫টি ফলিত বিজ্ঞানের বিশ্ববিদ্যালয় রাজধানী হেলসিঙ্কি এলাকায় অবস্থিত। সেগুলো হলো আরকাডা (অত্পধফধ), হাগা-হেলিয়া (Haaga-Helia), হেলসিঙ্কি মেট্রোপোলিয়া (Helsinki Metropolia), ডায়াকনিয়া (Diaconia) এবং লাউরিয়া (Laurea)।
ফিনল্যান্ডের উচ্চশিক্ষার কাঠামো দু’ভাগে বিভক্ত। স্নাতক স্তর (Undergraduate Level) ও স্নাতকোত্তর স্তর (Postgraduate Level)। স্নাতকোত্তর আবার দু’স্তরে বিন্যস্ত—মাস্টার্স ও ডক্টোরাল। উচ্চশিক্ষার এ দু’স্তরে যেসব ডিগ্রি অর্জন করা যেতে পারে সেগুলো হলো—ক. ব্যাচেলর ডিগ্রি, খ. মাস্টার ডিগ্রি এবং গ. ডক্টরেট বা পিএইচডি ডিগ্রি।
মাস্টার্স করতে দেড় থেকে দুই বছর লাগে আর ১২০ ক্রেডিট সম্পন্ন করা লাগে। কিন্তু যে কেউ চাইলে বেশি সময়ও নিতে পারে। তবে চার বছরের মধ্যেই মাস্টার্স কোর্স শেষ করতে হবে। সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুই বছরের মধ্যে মাস্টার্স কোর্স শেষ করার জন্য উত্সাহ দিয়ে থাকে। আর ডক্টোরাল কোর্সের ক্ষেত্রে সাধারণ সময় লাগে তিন থেকে ছয় বছর।
ফিনল্যান্ডে ডক্টরেট করতে হলেও ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অবশ্যই থাকতে হবে। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়েই ডক্টোরাল কোর্সে ভর্তি হতে হলে অবশ্যই আইইএলটিএস (IELTS) স্কোর অথবা তার সমমানের ইংরেজি ভাষা কোর্সের সার্টিফিকেট থাকতে হবে। স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তির জন্য সাধারণ সর্বনিম্ন আইইএলটিএস স্কোর ৬.৫ দরকার। এদেশে ডক্টোরাল কোর্সে ভর্তির জন্য সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে পছন্দের বিষয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। তারাও ভর্তি সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেন।
এদেশেও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের মতোই দুই সেমিস্টারে পড়াশোনা পরিচালিত হয়। প্রথম সেমিস্টার হলো শরত্কালীন (অঁঃঁস) সেমিস্টার—আগস্ট থেকে ডিসেম্বর। আর দ্বিতীয় সেমিস্টার হলো বসন্তকালীন (Spring) সেমিস্টার—জানুয়ারি থেকে জুলাই। একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে, ফিনল্যান্ডে ব্যাচেলর বা মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হওয়ার জন্য বয়স কোনো বাধা নয়। যে কোনো বয়সেই ভর্তির জন্য আবেদন করা যায়।
যেসব বিষয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ রয়েছে
সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক পর্যায়ের দু’একটি প্রোগ্রাম ইংরেজি মাধ্যমে হলেও বেশিরভাগ কোর্সই ফিনিশ কিংবা সুইডিশ ভাষায় হওয়ায় এবং ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয় বলে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ কিছুটা সীমিত। তবে কেউ যদি ফিনিশ কিংবা সুইডিশ ভাষায় পারদর্শী হয় তবে তার জন্য স্নাতক পর্যায়ে রয়েছে শিক্ষার অবারিত সুযোগ। অন্যদিকে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, বিশেষ করে ফলিত বিজ্ঞানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ফিনিশ ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায়ও বেশ কয়েকটি ব্যাচেলর প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। তবে কোনো কোনো ফলিত বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি মাধ্যমের কোর্সগুলোতে বিদেশিদের টিউশন ফি দিতে হয়। তাই আবেদন করার সময় ভালোভাবে জেনে-বুঝে আবেদন করা উচিত।
স্নাতক স্তর
এদেশের অধিকাংশ স্নাতক কোর্সই কর্মদক্ষতা তথা পলিটেকনিক ভিত্তিক। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, এখানে স্নাতক স্তরে ভর্তি হওয়ার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয়। ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার জন্য প্রথমে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। আবেদনপত্র পূরণের সময় পছন্দের ক্রমানুসারে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নির্বাচন করা যায়। স্নাতক কোর্সে ভর্তির জন্য টোফেল (TOEFL)-এ ৫৫০ স্কোর কিংবা আইইএলটিএস (IELTS)-এ কমপক্ষে ৬.০ স্কোরসহ এইচএসসি বা এর সমমান শিক্ষাগত যোগ্যতার যে কোনো ব্যক্তি আবেদন করতে পারবে।
আবেদনের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়
আবেদন করার সময় একজন শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ চারটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চারটি বিষয় পছন্দ করতে পারবে। তবে যেহেতু দুটোর বেশি বিষয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়া সম্ভব নয়, সেজন্য এক ও দুই নম্বর পছন্দের তালিকায় একটি বিষয় ও দুটি ভিন্ন ভিন্ন ইউনিভার্সিটি এবং তিন ও চার নম্বর পছন্দের তালিকায় আরেকটি বিষয় ও দুটি ভিন্ন ভিন্ন ইউনিভার্সিটি পছন্দ করলে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
অনলাইনে আবেদন করার পর এসএসসি, এইসএসসির মার্কশিট, সার্টিফিকেট ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ যে বিশ্ববিদ্যালয়টি পছন্দের তালিকায় প্রথম থাকবে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি অফিসের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে হবে। তারপর ওই বিশ্ববিদ্যালয় আবেদনকারীকে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ও সময় জানিয়ে ইমেইল করবে কিংবা চিঠি পাঠাবে।
ভর্তি পরীক্ষায় সাধারণত সাধারণ গণিত, আইকিউ (ওছ), বিশ্লেষণাত্মক প্রশ্ন (Analytic Questions) এবং বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন থাকে। ভর্তি পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বরের ওপর ভিত্তি করে পছন্দের ক্রমানুসারে যে কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ দেয়া হয়। ভর্তি পরীক্ষা সাধারণত এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে হয়ে থাকে। আর অনলাইন আবেদন করার শেষ সময় সাধারণত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ।
যেসব বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে
স্নাতক ডিগ্রির উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কোর্স হচ্ছে মানুষের বয়ঃবৃদ্ধি ও বৃদ্ধত্বকালীন সেবা (Human Ageing and Elderly Service), আন্তর্জাতিক বাণিজ্য (International Business), প্লাস্টিক প্রযুক্তি (Plastic Technology), তথ্যপ্রযুক্তি (Information Technology), পরিবেশ প্রকৌশল (Environmental Engineering), নার্সিং (Nursing), সামাজিক সেবা (Social Services), ভ্রমণ ও আতিথেয়তা ব্যবস্থাপনা (Tourism and Hospitality Management), বাণিজ্য তথ্যপ্রযুক্তি (Business Information Technology) এবং ইলেকট্রনিক্স (Electronics)।