মালয়েশিয়ায় সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি বাংলাদেশী গ্রেফতার

Malaysiaমনির হোসেন: মালয়েশিয়ায় অবৈধ বিদেশী শ্রমিক ধরপাকড় অভিযান শুরুর পর বৃহষ্পতিবার পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি বাংলাদেশী গ্রেফতার হয়ে দেশটির বিভিন্ন ডিটেনশন ক্যাম্প ও কারাগারে বন্দী রয়েছেন। থাকা ও খাওয়ার কষ্টের কারণে ইমিগ্রেশন ক্যাম্পগুলোতে  বেশির ভাগ শ্রমিকের দিন কাটাতে হচ্ছে মানবেতরভাবে। অনেকে এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
এ দিকে যারা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন এবং যারা গ্রেফতার এড়িয়ে আগেভাগে হাইকমিশন থেকে ট্রাভেল পাস সংগ্রহের জন্য দালালদের শরণাপন্ন হচ্ছেন, তাদের বেশির ভাগ প্রতারিত হচ্ছেন বলে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত প্রবাসী শ্রমিকেরা জানান, গত ২১ জানুয়ারি রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে স্মরণকালের বিশেষ এই ধরপাকড় অভিযানে পুলিশ, রেলা ও ইমিগ্রেশনের হাতে প্রতিদিন শত শত শ্রমিক কুয়ালালামপুর, পেনাং, জহুরবারু, মাল্লাকাসহ বিভিন্ন প্রদেশ থেকে গ্রেফতার হয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধরা পড়েছে পাশের দেশ ইন্দোনেশিয়ার শ্রমিকেরা। পলাতক শ্রমিকদের দাবি, অভিযান শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি বাংলাদেশী শ্রমিক ধরা পড়ে  বর্তমানে দেশটির ১১টি ডিটেনশন ক্যাম্পসহ বিভিন্ন কারাগার ও থানা কম্পাউন্ডে আটক রয়েছেন বলে জানা গেছে, যা প্রতিদিন দেশটির শীর্ষ টেলিভিশন চ্যানেল ও পত্রিকাগুলোতে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। ওই সব প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, গ্রেফতার হওয়ার সাত দিনের মধ্যে আটক শ্রমিকদের নিজ উদ্যোগে টিকিট কেটে দেশে ফেরত যেতে হবে। তবে বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত কতজন শ্রমিক ট্রাভেল পাসে দেশে ফেরত এসেছেন সেই হিসাব মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে পাওয়া যায়নি।
গত রাতে মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনের লেবার কাউন্সিলর (শ্রম) মন্টু কুমার বিশ্বাসের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার জানা মতে মালয়েশিয়ায় শুরু হওয়া অবৈধ শ্রমিক ধরপাকড় অভিযানে এ পর্যন্ত ২৭৫ জন ধরা পড়ে ডিটেনশন ক্যাম্পে আছেন। তাদের দেখতে দু-একটি ক্যাম্প ভিজিট করা হয়েছে। আমরা তাদের সাথে দেখা করে ফরম পূরণ করার জন্য দিয়ে এসেছি। পরে ওগুলো ইমিগ্রেশন থেকে আমাদের কাছে পাঠাবে। এরপর দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হবে। মালয়েশিয়ায় এ পর্যন্ত সাড়ে তিন হাজারের বেশি শ্রমিক গ্রেফতার হয়েছে, শ্রমিকদের দেয়া এমন তথ্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার কাছে আটকের যে তথ্য রয়েছে আমি সেটাই বললাম।
গতকাল কুয়ালালামপুর বুকিত জলিল ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক শ্রমিক জয়নালের স্বজন মালয়েশিয়ার কোতারায়া এলাকার এক ব্যবসায়ী টেলিফোনে বলেন, যে ডিটেনশন ক্যাম্পে জয়নালকে রাখা হয়েছে ওই ক্যাম্পটি খুবই ছোট্ট। কিন্তু সেখানে শ্রমিকের সংখ্যা তার চেয়েও বেশি, যার কারণে সবার ঘুমানোর কষ্ট হচ্ছে। এক কাপড়ে তাদের থাকতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন ক্যাম্পগুলোতে শ্রমিকদের যে খাবার দেয়া হচ্ছে তা প্রয়োজনের তুলনায় কম। তিনি খাবারে বর্ণনা দিয়ে বলেন, ভোর ৫টার দিকে একজনকে দুটি বিস্কুট ও পলি প্যাকেটে অর্ধেক কাপ রং চা দেয়া হয়। দুপুরে পলিথিনে মোড়ানো অল্প ভাত ও দুই পিচ ভাজা শুঁটকি মাছ আর রাতের খাবারে দেয়া হয় অর্ধেক ডিম ও অল্প পরিমাণ ভাত। এই খাবার খেয়েই তাদের কোনো মতে জীবন কাটাতে হচ্ছে। ওই ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এত কিছুর পরও প্রতিদিন হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইমিগ্রেশন ম্যানেজ করে ও কক্সবাজার ও টেকনাফ দিয়ে ট্রলারে করে অবৈধভাবে লোক আসছে মালয়েশিয়াতে।
মালয়েশিয়ার জঙ্গলে পলাতক জীবন কাটানো শ্রমিক মেহেদী হাসান তার অভিজ্ঞতার কথা বলেন। তিনি বলেন, হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে মালয়েশিয়ায় আজ বহু শ্রমিক বৈধ হওয়ার সুযোগ পেয়েও বঞ্চিত হয়েছেন। এবার গ্রেফতার অভিযান শুরুর পর দালাল চক্র নতুন মিশনে নেমেছে। প্রতারকেরা কারাগারে আটক শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠাতে আউট পাস ও ট্রাভেল পাস সংগ্রহ করে দেয়ার কথা বলে তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে হাজার হাজার রিংগিট আদায় করছে। এরপর গা-ঢাকা দিচ্ছে। দালালদের প্রতারণায় অনেক শ্রমিক ও তাদের স্বজন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এই বিষয়টি হাইকমিশন ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। নতুবা এই চক্রের খপ্পরে পড়ে অনেকেই পথে বসবে। মেহেদী হাসান উদাহরণ দিয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, গত সোমবার জহুরবারু দুলাই থেকে পাঁচ বাংলাদেশী শ্রমিক পুলিশি অভিযানে ধরা পড়ে। সেখান থেকে কৌশলে তিনজন পালিয়ে যেতে পারলেও সিরাজগঞ্জ উল্লাপাড়ার বাসিন্দা হাসান ও মোজাফফর ধরা পড়ে যায়। বর্তমানে তারা দু’জনই জহুরবারু তেগানানাথ ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক রয়েছেন। মালয়েশিয়ায় থাকা তাদের মামা দু’জনের জন্যই ট্রাভেল পাস করতে ইকবাল সোবহান নামে এক দালালের কাছে চার হাজার রিংগিট দেন। কিন্তু ওই দালাল রিংগিট নেয়ার পরই টেলিফোন ধরছে না। শুধু তারাই নয়, দেশটির ডিটেনশন ক্যাম্পের বেশির ভাগ শ্রমিক ও মালয়েশিয়ায় পালিয়ে থাকা শ্রমিকদের ট্রাভেল ও আউট পাস, পাসপোর্ট রিনিউ ও ডিটেনশন ক্যাম্প থেকে মুক্ত করার কথা বলে সিন্ডিকেটের সদস্যরা এখন জমজমাট বাণিজ্য শুরু করেছে।
মালয়েশিয়ান টিভি তুজোতে গ্রেফতার অভিযানের দৃশ্য দেখানোর সময় আটক এক বাংলাদেশী শ্রমিক পুলিশ কর্মকর্তার পা ধরে আকুতি জানান। ওই শ্রমিক পুলিশকে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকেন, আমাকে গ্রেফতার করে আপনারা জেলে নিয়ে যান মেরে ফেলেন, তবুও বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবেন না। কারণ দেশে গেলেই আমাকে লোনের দুই লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে। আমি এই টাকা কোত্থেকে দেবো?
ডিটেনশন ক্যাম্পে মানবেতর জীবন কাটানোর প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেও হাইকমিশনের লেবার কাউন্সিল মন্টু কুমার বিশ্বাস এ প্রতিবেদককে বলেন, দালালদের মাধ্যমে শ্রমিকেরা প্রতারিত হচ্ছেন এটা নতুন নয়। তবে আপনাদের মাধ্যমে আমি জানাতে চাই কোনো শ্রমিক যেন কোনোভাবেই দালালদের দারস্থ না হয়। তারা যেন সরাসরি হাইকমিশনে এসে তাদের সমস্যার কথা জানায়।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button