হংকংয়ে বাংলাদেশিদের ‘বন্দিজীবন’
সাইদুর রহমান: বিশ্বজুড়ে হংকং নিরাপদ, সম্পদশালী ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনের প্রতীক। তবে বিশাল বিশাল সব অট্টালিকা ও শপিং মলের আড়ালে দেশটির কিছু নতুন অধিবাসীদের কাছে হংকং যেন বিভীষিকারই আরেক নাম। চীনের মূল ভূখণ্ডের সীমান্তের কাছাকাছি হংকংয়ের একটি গ্রামের নাম পিং চে। দেশটির কিছু নতুন অধিবাসীর জন্য জরাজীর্ণ এই গ্রামটি যেন এক ধরনের কারাগারে পরিণত হয়েছে।
এখানকার বাসিন্দাদের একজন আরিফ। বাংলাদেশের ২৬ বছর বয়সী এই যুবক এখন রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার আশায় হংকংয়ে অবস্থান করছেন। তবে পিং চে গ্রামের যে ঘরটিতে তিনি থাকেন তা বসবাসের প্রায় অযোগ্য। এমনকি এক রাতে তিনি যখন ঘুমাচ্ছিলেন ছাদের একটি অংশ ভেঙ্গে তার মাথায় পড়ে।
এ বিষয়ে অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে আরিফ বলেন, “আমার আরও ভালো একটি জায়গায় থাকা প্রয়োজন।”
রাজনৈতিক আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে প্রতিবছর হংকংয়ে পাড়ি জমানো শত শত লোকের অবস্থাও বাংলাদেশের আরিফের মতোই। নিজ দেশে নির্যাতন বা শাস্তি এড়াতে শরণার্থী হিসেবে হংকংয়ে যাওয়ার পরই নতুন দুর্ভোগ শুরু হয় তাদের।
রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী এসব লোকজন হংকংয়ে প্রবেশের পর প্রথমে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেন। এই প্রক্রিয়াটি শেষ হতে সাধারণত কয়েক বছর লেগে যায়। আর প্রক্রিয়াটি শেষ হওয়ার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে করা আবেদনটি প্রত্যাখ্যাত হয়।
এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হচ্ছে- যতোদিন না কারো রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে করা আবেদন গৃহীত হয় বা এ সংক্রান্ত প্রক্রিয়া শেষ হয় ততোদিন পর্যন্ত সেই ব্যক্তি হংকংয়ে কাজ করার অনুমতি পায় না। এছাড়া এই সময়টাতে তাদের জরাজীর্ণ বাড়িতে থাকতে দেওয়া হয় এবং তাদের প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম খাবার সরবরাহ করা হয়।
এমনকি আবেদনের নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি সমাজে সবার সঙ্গে মিশতে বা নিজ দেশে ফিরে যেতেও পারে না। ফলে পিং চে গ্রামে অনেকটা একঘরে জীবন কাটে হংকংয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাশী এসব মানুষের।
এ বিষয়ে আরিফ বলেন, “আমাদের অনেকে এখানে এসেছে জীবন বাঁচানোর জন্য। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে মরে যাওয়াই ভালো। এইভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। আমরা যেভাবে বেঁচে আছি তাকে বেঁচে থাকা বলে না।”
চার বছর আগে বাংলাদেশের খুলনার ছেলে আরিফ ছিলেন ফার্মাকোলজির ছাত্র। পাশাপাশি তিনি পরিবারকে সাহায্যের জন্য একটি ব্যবসাও করতেন। তবে স্থানীয় সন্ত্রাসীদের একটি দল তার কাছে মোটা অংকের টাকা দাবি করে, অন্যথায় তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়।
এই অবস্থায় জীবন বাঁচাতে আরিফ একজনের দ্বারস্থ হন, যে তাকে তার ‘স্বপ্নের দেশ’ আয়ারল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। পরে ওই লোক আরিফের জিনিসপত্র চুরি করে তাকে একাকি হংকংয়ে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।
আরিফ বলেন, “আমি আমার সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি। আমি যখন জানলাম যে আমি হংকংয়ে আছি, আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছিলাম।”
আন্তর্জাতিক এক আইনের আওতায় হংকং কোনো রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাশীকে এমন কোনো দেশে ফেরত পাঠাতে পারবে না যেখানে তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়ে।
শরণার্থীরা কেবলমাত্র হংকংয়ে প্রবেশের পরই রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করতে পারবে এবং যতোদিন না তাদের আবেদনের বিষয়টি মীমাংসা হচ্ছে ততোদিন পর্যন্ত তারা সেখানে বৈধভাবে থাকতে পারবে।
এদের মধ্যে শেষ পর্যন্ত যাদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন গৃহীত হয় তাদের তৃতীয় কোনো দেশে পাঠানো হয় যেখানে তারা বৈধ নাগরিকত্ব পেতে পারেন।
এক্ষেত্রে বলা যায়- কাগজে-কলমে হংকং হচ্ছে একটি বড় ‘বিশ্রামাগার’। আর প্রকৃতপক্ষে হংকং হচ্ছে কারাগারের থেকেও বেশি কিছু।
এদিকে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাশীদের কাজ করার ব্যাপারে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে হংকং সরকারের বক্তব্য হচ্ছে- অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যে কেউ যাতে হংকংয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা না করে তা নিশ্চিত করতেই শরণার্থীদের কাজ করায় নিষেধাজ্ঞা জারি রাখা হয়েছে। এছাড়া রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাশী কোনো ব্যক্তি লুকিয়ে কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়লে তাকে ২২ মাসের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে হংকংয়ের আইনে।
কাজ করার অনুমতি দেয়ার পরিবর্তে হংকং সরকার আরিফের মতো রাজনৈতিক আশ্রয় প্রত্যাশীদের জীবন ধারণের জন্য ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল সার্ভিস (আইএসএস) নামের একটি বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য করে।
প্রতি মাসে আইএসএস আরিফের মতো প্রত্যেককে বাড়ি ভাড়া হিসেবে ১২০০ হংকং ডলার (১৫৫ মার্কিন ডলার) অর্থ সহায়তা দেয়। এর প্রায় পুরোটাই পিং চে গ্রামের যে বাড়িতে তারা থাকে তার ভাড়া দিতেই শেষ হয়ে যায়। এছাড়া প্রত্যেক শরণার্থী খাবারের জন্য প্রতিমাসে আইএসএসের কাছ থেকে ৯০০ হংকং ডলার পায় (১১৬ মার্কিন ডলার), যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।
এমনকি অর্থ সহায়তার এ পরিমাণ ২০০৬ সালের পর থেকে আর মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে আরিফ বলেন, “আগে যে টাকায় সাত কেজি চাল কেনা যেত মূল্যস্ফীতির কারণে তা তিন কেজিতে নেমে এসেছে। ফলে লোকজনকে বলতে গেলে না খেয়েই থাকতে হচ্ছে।”
আর কবে নাগাদ তাদের এই ‘যন্ত্রণার’ অবসান হবে সে কথাও নির্দিষ্ট করে বলতে পারছে না কেউ।