জানুয়ারি মাসে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ৩৯
জানুয়ারি মাসে দেশে প্রতিদিন গড়ে একজন করে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এছাড়া একই সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় অন্তত ৫৩ জন নিহত ও এক হাজার ৪৭২ জন আহত হয়েছে বলে তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’। শনিবার সংস্থাটির মাসিক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। সংগঠনটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, জানুয়ারি মাসে দেশে অন্তত ৩৯টি বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে ক্রসফায়ারে ২০ জন, গুলিতে ১৮ জনকে এবং একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, এই সময়ে প্রতিদিন গড়ে একজন বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ৫ই জানুয়ারি বিতর্কিত নির্বাচনের পর যৌথবাহিনীর অভিযানের সময় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার অভিযোগ পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ সালে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) ২৯ জন নিরস্ত্র বাংলাদেশী নাগরিককে হত্যা করে। ২০১৪ সালেও এই ধারা অব্যাহত আছে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে এই সমঝোতা এবং চুক্তি লঙ্ঘন করে সীমান্তের কাছে বাংলাদেশীদের দেখা মাত্র গুলি করে হত্যা করছে ও অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে বাংলাদেশী নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে, যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং তা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। এতে বলা হয়, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে বিএসএফ হাতে এক বাংলাদেশী নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৪জন এবং অপহৃত হয়েছে ১৩ বাংলাদেশী। গত মাসে দেশে ১৬ ব্যক্তি গণপিটুনিতে মারা গেছেন। এছাড়া যৌতুক সহিংসতার শিকার হয়েছে ১২ নারী। ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩২ জন। যৌন হয়রানির শিকার ১৩ জন। তৈরি পোশাক শ্রমিক আহত হয়েছে ৬০ জন।
সংখ্যালঘু নাগরিকদের ওপর হামলা : নির্বাচনের পর দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রতিটি নির্বাচনের পরেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য পরিকল্পিতভাবে হামলা করা হয়েছে এবং তা এখনও হচ্ছে। অধিকার অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে ল্য করছে যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিকদের ওপর প্রতিটি নির্বাচনের পর হামলা চালানোর ঘটনা একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নির্বাচনের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে আক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও এ ব্যাপারে সরকার ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার জন্য মানবাধিকার কর্মীরা উদ্বিগ্ন ছিলেন।
অধিকারের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৬ই জানুয়ারি দৈনিক ইনকিলাব কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে ছাপাখানা সিলগালা করে দিয়েছে পুলিশ। ‘সাতক্ষীরায় যৌথবাহিনীর অপারেশনে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তা’ শিরোনামে ছাপা হওয়া প্রতিবেদনের সূত্র ধরে ওয়ারী থানায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৩) ও দণ্ডবিধিতে মামলা দায়ের করা হয়। এর আগে সরকার বিরোধীদলীয় ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া- চ্যানেল ওয়ান, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভি এবং দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করে দিয়েছে। আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়েছে। এরপর সর্বশেষ ঘটনায় ইনকিলাবের সাংবাদিকদের গ্রেফতার করে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয় সরকার। অধিকার মনে করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০০৯ ও ২০১৩) এর মাধ্যমে মত প্রকাশ ও সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ব্যাপক সুযোগ হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নসাৎ করছে। এই আইনের মাধ্যমে সরকার সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী ও ভিন্নমতালম্বী নাগরিকদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠাচ্ছে।
তবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০০৯ ও ২০১৩) বলবৎ থাকার কারণে প্রতিবাদ হিসেবে অধিকারের এই প্রতিবেদনটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করছে না বলে রিপোর্টে বলা হয়।
এতে ওই আইনের ব্যাপারে বলা হয়েছে, এ আইনের ৫৭ ধারায় বর্ণিত ইলেকট্রনিক ফরমে বিশেষ ধরনের কিছু তথ্যাদি প্রকাশ করা সংক্রান্ত অপরাধ আমলযোগ্য ও অ-জামিনযোগ্য হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং ২০১৩-এর সংশোধনীতে এর শাস্তি বৃদ্ধি করে সাত থেকে চৌদ্দ বছর পর্যন্ত করা হয়েছে। রিপোর্টে অধিকার এই নিবর্তনমূলক আইনটি বাতিলের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায়।
প্রতিবেদনে সংগঠনটি ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তা অবিলম্বে আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান করা। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়।