ইসলাম থেকে দূরে সরে পরার কারণেই মুসলমানরা নানা দুর্দশার শিকার হচ্ছে : আল্লামা শফী
আবুল বাশার, হাটহাজারী: এশিয়ার অন্যতম বিখ্যাত ও প্রাচীন ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার বার্ষিক মাহফিল ও দস্তারবন্দী সম্মেলন শুক্রবার লক্ষাধিক মুসল্লীর অংশগ্রহণে আখেরি মুনাজাতের মাধ্যমে শেষ হয়েছে। সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক, হেফাজতে ইসলামের আমীর, দেশের শীর্ষ আলেম, পীরে কামেল আল্লামা শাহ্ আহ্মদ শফী বলেছেন, বর্তমান ঈমান, আমল ও ধর্মীয় অনুশাসন পালনে সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে গাফলতি দেখা যাচ্ছে। ইসলাম থেকে দূরে সরে পড়ার কারণেই মুসলমানগণ নানা দুর্দশা ও ঘাতপ্রতিঘাতের শিকার হচ্ছে। সঠিকভাবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার মাধ্যমেই কেবল এই বিপদাপদ থেকে মুক্তি পেতে আল্লাহর সাহায্য আশা করা যায়। তিনি বলেন, মুসলমানদের ঈমানী দুর্বলতা ও অনৈক্যের সুযোগে দেশী-বিদেশী ইসলামের দুশমনরা নানা অপপ্রচার, ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে মুসলমানদের ঈমানী চেতনাকে নষ্ট করার গভীর ষড়যন্ত্র চলাচ্ছে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, বেহায়াপনা, উলঙ্গপনা ও নারী-পুরুষের অবাধ চলাফেরার বিস্তার ঘটিয়ে তরুণ সমাজকে বিভ্রান্ত করে ধর্মহীন করে গড়ে তুলতে চাইছে। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ওলামায়ে কেরাম ও অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে নানা মিথ্যাচার, কাল্পনিক তথ্য ও চক্রান্ত চালিয়ে তৌহিদী জনতাকে বিভ্রান্ত করার চক্রান্ত চালানো হচ্ছে। বয়ানে হেফাজত আমীর অবিলম্বে আলেম-ওলামা, কওমী মাদরাসা ও তৌহিদী জনতার বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র ও মিথ্যাচার বন্ধ করতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
হেফাজত আমীর আরো বলেন, ওলামায়ে কেরাম দুনিয়াবি কোনো স্বার্থে লোভ-লালসায় পরে ঈমান বিক্রি করতে পারে না। তারা একমাত্র আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের সন্তুষ্টির জন্যই নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। সুতরাং ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়ার মিথ্যাচারে কোনো মুসলমানই বিভ্রান্ত হতে পারেন না।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী আরো বলেন, ইসলামে অসত্য, অন্যায়, সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্রের কোন স্থান নেই। ইসলাম ন্যায় ও শান্তির ধর্ম। ইসলামকে অনুসরণ করতে পারলে এদেশে কোন হানাহানি ও সন্ত্রাস থাকবে না। আর ইসলামী শিক্ষায়ও কোনো প্রকার সন্ত্রাসের স্থান নেই। অথচ দেশে বিদেশে আজ ইসলাম ও মুসলমানদেরকে নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা নিজ নিজ ধর্ম পালন করলে, ধর্মীয় তৎপরতা চালালে এবং তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিলে কেউ মৌলবাদী, প্রগতি বিরোধী ও জঙ্গীবাদি হয় না। অথচ নামায আদায় ও দাড়ি-টুিপ পরলে অথবা ইসলাম ধর্মীয় কোন আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নিলেই প্রগতি বিরোধী, দেশবিরোধী ও মৌলবাদীর রং লাগানো হয়।
শুক্রবার অনুষ্ঠিত হাটহাজারী মাদ্রাসার দস্তারবন্দী ও বার্ষিক ইসলামী সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন আল্লামা তফাজ্জল হক হবিগঞ্জী, বিশেষ অতিথি আল্লামা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী।
আরো বয়ান করেন আল্লামা আব্দুল হামিদ পীর সাহেব মধুপুর, আল্লামা মোস্তফা আল-হোসাইনী, আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী, মাওলানা নূরুল ইসলাম জিহাদী, মাওলানা সালাহ উদ্দীন নানুপুরী, মাওলানা সাজেদুর রহমান, ড. আ.ফ.ম. খালেদ হোসেন, মাওলানা সলিম উল্লাহ, মাওলানা আজিজুল হক মাদানী, মাওলানা সৈয়দুল হক আরমানী, মাওলানা নোমান মেখলী, মাওলানা মাহমুদুল হাসান, মুফতী জসীম উদ্দীন, মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী, মাওলানা আনাস মাদান, আলহাজ্ব আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ।
সম্মেলনে হাটহাজারী মাদরাসার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, সংবিধান সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি সংযোজনের পর থেকে ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদিরা ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে একের পর এক যেভাবে অপপ্রচার ও আঘাত দিয়ে চলেছে, আমাদের প্রাণের স্পন্দন হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে, বয়োবৃদ্ধ দাড়ি-টুপীধারীদের উপর উঠতি তরুণরা যেভাবে বর্বর আচরণ করছে, পর্দানশীন মা-বোনদেরকে স্কুল, কলেজ ও রাস্তাঘাটে নাজেহাল করা হচ্ছে, তাতে আমরা হতভম্ব ও বিস্মিত না হয়ে পারছি না। তিনি বলেন, নাস্তিক-মুরতাদ ও ক্ষমতাসীন মহলের ইসলামবিদ্বেষী এ আচরণের বিরুদ্ধে সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী আরো বলেন, বর্তমানে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে ইসলামপ্রিয় তৌহিদী জনতার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ভিন্নরূপে আরেক ভয়াবহ আগ্রাসন চালানো হচ্ছে। ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় সংবাদ পরিবেশনা, উপস্থাপনা থেকে শুরু করে নাটক-সিনেমায় নারীদেরকে নিয়মিতভাবে দৃষ্টিকটূ পোশাকে উপস্থাপন করে এসব পোশাককে সামাজিকভাবে স্বাভাবিককরণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বর্তমানে রাস্তাঘাট, মার্কেট ও জনসমাগমস্থলে স্কুল-কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রী ও নারীদের পোশাক-আশাকের ধরণ দেখলে এমন আশঙ্কার বাস্তবতা দেখা যায়।
তিনি বলেন, বিশ্বে ইসলাম ও মুসলিম মিল্লাতের বিরুদ্ধে পরিচালিত ইহুদী-খ্রিস্টান মিশনারি ও ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের সর্বাত্মক আগ্রাসনের কবলে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী মুসলমানরা তথাকথিত নাস্তিক্যবাদী ও ফ্যাসিবাদীদের চক্রান্তের শিকারে পরিণত হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রশাসনের চোখের সামনেই ইসলামবিরোধী এসব অপকর্ম পরিচালিত হচ্ছে। তিনি বলেন, দেশকে ইসলামশূন্য ও ঈমানী চেতনাহীন করার ষড়যন্ত্রে ওলামা-মাশায়েখ ও তৌহিদী জনতা চোখবুজে থাকবে না। সুতরাং ইসলাম ও আলেম ওলামা বিরোধী সকল ষড়যন্ত্র বন্ধে অবিলম্বে সরকারের পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায় তৌহিদী জনতার ক্ষোভ কোনোভাবেই থামাতে পারবে না সরকার।
আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী আরো বলেন, বর্তমানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের বিভিন্নস্থানে ওয়াজ-মাহফিল, তাফসীর মাহফিল ও ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠানে বাধা দেওয়া হচ্ছে। আমাকে অসংখ্য ধর্মীয় মাহফিলে যেতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান নির্বিঘেœ পুলিশী নিরাপত্তায় অনুষ্ঠান করতে পারলেও ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ হয়েও ধর্মীয় কাজে মুসলমানরা বাধার শিকার হচ্ছে। এটা স্পষ্টতই ইসলামবিরোধী চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। সরকারকে অবিলম্বে ইসলামবিরোধী অবস্থান পরিত্যাগ করতে হবে।
ড. আ ফ ম খালেদ হোসেন বলেন, সরকার তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে যে আইন পাশ করেছে, তা আল্লাহ ও তদীয় রাসূল (সা.)-এর অবমাননা রোধে যথেষ্ট নয়। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে কিছু বললে বা লিখলে জেল-জরিমানা হয়। অথচ সর্বকালের সর্বশেষ্ঠ মহামানব মুসলমানদের প্রাণের স্পন্দন রাসূল (সা.)-এর শানে বেয়াদবি করেলে কিছু হয় না। এটা চরম দুর্ভাগ্যজনক। তিনি অবিলম্বে ইসলাম, আল্লাহ ও রাসূল অবমাননা রোধে কঠোর আইন পাশের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে সংবিধানকে এ পর্যন্ত ১৫ বার সংশোধন করেছে। অথচ কোটি কোটি মুসলমানের প্রাণের দাবী সত্ত্বেও তারা সংবিধানে সামান্য পরিবর্তন আনতে রাজি নয়। তিনি বলেন, উলামায়ে কেরাম শুধু ঈমান-আক্বীদার অতন্দ্র প্রহরী তা নয়, বরং তারা এদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির হেফাজতে জান কুরবানী দিতে প্রস্তুত।
উল্লেখ্য, বার্ষিক মাহফিলের পাশাপাশি দস্তারবন্দী সম্মেলন বা বিশেষ সমাবর্তনে বৃহস্পতি ও শুক্রবার দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদীস (টাইটেল) উত্তীর্ণ প্রায় চার হাজার তরুণ আলেমকে প্রতিষ্ঠানের নাম ও মনোগ্রাম খচিত বিশেষ সম্মানসূচক পাগড়ী প্রদান করা হয়। পাগড়ী প্রদান করেন হেফাজত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী, মুহাদ্দিস আল্লামা শামসুল আলম, মুফতীয়ে আযম আল্লামা আব্দুচ্ছালাম চাটগামী, হেফাজত মহাসচিব আল্লামা হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী, মুফতী কিফায়াতুল্লাহ, মাওলানা কবীর আহমদ, মাওলানা হাফেজ শোয়াইব, মাওলানা ফোরকান আহমদ, মুফতী জসীম উদ্দীন, মাওলানা আনাস মাদানী প্রমুখ। বৃহস্পতিবার বাদ মাগরীব এবং শুক্রবার বাদ ইশা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ২০১২ ও ২০১৩ সালে উত্তীর্ণ তরুণ চার হাজার আলেম পাগড়ী গ্রহণ করেন। বিশেষ সমাবর্তনে দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক হেফাজত আমীর আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী তরুণ আলেমদের উদ্দেশ্যে উপদেশমূলক দীর্ঘ বক্তব্য রেখে বলেন, তোমরা ইসলামের আদর্শ ও শান্তির বাণী প্রচার করার জন্য দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়।
এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় হেফাজত আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফী হাটহাজারী মাদ্রাসার পুনঃনির্মিত সুবিশাল বায়তুল কারীম প্রধান জামে মসজিদ উদ্বোধন করেন। মসজিদটির স্থাপত্যকলা ও নান্দনিকতায় উপস্থিত সকলেই মুগ্ধ হন।
গতকালের হাটহাজারী মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাজার হাজার উলামায়ে কিরাম ছাড়াও লক্ষাধিক মুসল্লী অংশগ্রহণ করেন। আল্লামা শাহ আহমদ শফী শুক্রবার বাদ জুমা উপস্থিত লক্ষাধিক উলামায়ে কেরাম ও তৌহিদী জনতার উদ্দেশ্যে বিশেষ হিদায়াতী বয়ান পেশ করেন। আখেরী মুনাজাতে জামিয়া প্রধান দেশের ও বিশ্বের সকল মুসলমানের শান্তি, ঐক্য ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মুনাজাত পরিচালনা করেন। এ সময় সমগ্র ক্যাম্পাস জুড়ে কান্নার রোল পড়ে যায়।
এশিয়ার অন্যতম বিখ্যাত দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিল উপলক্ষ্যে শিক্ষা ভবন, ছাত্রাবাস, বিশাল প্যান্ডেল এবং চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কসহ সমগ্র হাটহাজারী এলাকা যেন হাজার হাজার উলামা-মাশায়েখ ও তরুণ আলেমদের এক মিলন মেলায় পরিণত হয়।