যে হাত খেতে দেয় সে হাত কামড়াতে নেই
সিরাজুর রহমান
আওয়ামী লীগের মন্ত্রীদের নিয়ে শত দুঃখেও মাঝে মাঝে হাসতে ইচ্ছে করে। তারা মনে করেন বাকি বিশ্বের মাথা তাদের কাছে বন্ধক আছে। তারা কারও কথা শুনবেন না, কিন্তু তাদরে কথা মেনে চলতে অন্যেরা বাধ্য থাকবে। তার একচুল এদিক-ওদিক হলে মন্ত্রীদের মুখ দিয়ে যেসব ‘অমৃত বাণী’ অঝোরে ঝরতে থাকে, হাসিটার উদ্রেক হয় সেখানে থেকেই। আওয়ামী লীগের খুদে হিটলাররা এতদিন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে হুঙ্কার বর্ষণ করছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে, বিশেষ করে ৫ জানুয়ারি ফাঁকা মাঠের নির্বাচনের পর রাষ্ট্রীয় ঘাতকদের লেলিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। গত রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) অনির্বাচিত সংসদে শেখ ফজলুল করিম সেলিম ঢালাওভাবে কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে যেসব হুঙ্কার ছেড়েছেন সেগুলো অবিকল গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শেষাংশে হিটলারের উন্মাদ হুঙ্কারের মতো শুনিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এরপর কি রাজনৈতিক বৈরীদের মতো কূটনৈতিক সমালোচকদের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রীয় ঘাতকদের লেলিয়ে দেয়া হবে?
সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তৈরি পোশাকসহ বাংলাদেশী পণ্য বিনা শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানির সুযোগ বরাবরের মতো হাতছাড়া হতে যাচ্ছে। মন্ত্রীরা আবার উল্টা-পাল্টা কথাবার্তা বলতে শুরু করেছেন। বর্তমান অত্যন্ত বিতর্কিত এবং সম্ভবত অবৈধ সরকারের মন্ত্রীদের মধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সম্ভবত সবচাইতে অভিজ্ঞ। শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ সরকারেও তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি বলেছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ধর্তব্যে আনলে বাংলাদেশ সম্ভবত জিএসপি সুযোগ পাবে না। খাদ্যমন্ত্রী আমির হোসেন আমু পরোক্ষে হলেও এজন্য বিএনপিকে দায়ী করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি মিথ্যা অপপ্রচার চালিয়ে শুধু দেশেই নয় বিদেশি বন্ধুদের মাঝেও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন নিজেকে সর্বজ্ঞানী মনে করেন। তার ধারণায় অন্য সবাইকে ‘লেকচার’ দেয়ার একটা বিধিদত্ত অধিকার তার আছে।
মি. মেনন জিএসপি সুবিধা প্রসঙ্গে গোড়াতেই এক হাত নিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনাকে। মেনন বলেছেন, ‘বাংলাদেশে নিযুক্ত সে দেশের রাষ্ট্রদূত যিনি রয়েছেন, তিনি তো এ দেশের সবচেয়ে বড় রাজনীতিবিদ।’ এর পরেই যে কথাগুলো মেনন বলেছেন তাতে তার বিদ্যার বহর এবং লেকচার দেয়ার অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তিনি বলেছেন, ‘জিএসপি বাতিলে বাণিজ্যিক যুক্তির চেয়ে রাজনৈতিক যুক্তি অনেক বেশি। এর পরও আমরা তাদের দেয়া অনেক শর্ত পূরণ করেছি। কিন্তু তাদের সেই শর্তের সঙ্গে যখন বাংলাদেশের নির্বাচন ও ড. ইউনূসের ইস্যু আসে, তখন সেটা আর বাণিজ্যিক শর্ত থাকে না।’ আরও বেশি হাস্যকর কথা বলেছেন রাশেদ খান মেনন। তিনি বলেছন, ‘আমেরিকার শর্ত মেনেই যদি চলতে হয় তাহলে আমাদের স্বাধীনতা কেন?’
মন্ত্রীত্রয়ের যুক্তির প্রথম ও প্রধান দুর্বলতা এখানে যে শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানি (জিএসপি) একটা সুবিধা মাত্র, অধিকার নয়। সুবিধা অর্জন করতে হয় অন্য পক্ষের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে, তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে কিংবা তার মাথায় মুগুর মেরে সুবিধা আদায় করা যাবে না। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, কিন্তু প্রচুর তদবির করেও শেখ হাসিনা সে পুরস্কারের জন্য যোগ্য বিবেচিত হননি। নিজের গাত্রদাহ মেটাতে গিয়ে হাসিনা ইউনূসের ওপর প্রতিহিংসার কামান দেগে চলেছেন, যে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের কারণে ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং যে মডেল এখন অনেক দেশেই চালু করা হয়েছে, সে ব্যাঙ্কটিকেও ধ্বংস করার সব আয়োজন তিনি প্রায় সমাপ্ত করে এনেছেন।
মার্কিন সরকার গোড়া থেকেই এই প্রতিহিংসার পথ থেকে শেখ হাসিনাকে নিবৃত্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ব্যক্তিগতভাবে হাসিনাকে অনুরোধ করেছেন। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন (যিনি খুব সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন বলে মনে করা হয়) দফায় দফায় টেলিফোন করেছেন শেখ হাসিনাকে, সশরীরে ঢাকা পর্যন্ত উড়ে এসেছিলেন শেখ হাসিনার জিঘাংসা প্রশমিত করার আশায়। কিন্তু শেখ হাসিনা কারও কথা শোনেননি।
খুব সম্ভবত তিনিও রাশেদ খান মেমনের মতো স্বাধীনতা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ভুল ধারণা পোষণ করেন। বর্তমান শাসকদের নিয়ে একটা সমস্যা এই যে, স্বাধীনতার সংজ্ঞা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্বন্ধে সামান্যতম ধারণাও তাদের নেই। স্বাধীনতার অর্থ গোঁয়ার্তুমি কিংবা বন্ধুদের পরামর্শ শুনতে অস্বীকার করা নয়। গোঁয়ার্তুমি আর বেয়াদবি যদি স্বাধীনতার সংজ্ঞা হয় তাহলে অনেকেই সে স্বাধীনতা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে চাইবেন।
আধুনিক বিশ্বে বাণিজ্যকে রাজনীতি থেকে পৃথক করে দেখার চেষ্টা অবশ্যই হাস্যকর। আলোচ্য মন্ত্রীত্রয়ের জীবদ্দশাতেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গোটা পশ্চিমা বিশ্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে অর্ধ শতক ধরে বাণিজ্যিক অবরোধ চালিয়ে এসেছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন নির্যাতক কমিউনিস্ট পদ্ধতি পরিত্যাগ করে গণতন্ত্রকে আলিঙ্গন করার পরই শুধু সে অবরোধ প্রত্যাহার করা হয়েছে। পারমাণবিক গবেষণার বিষয়ে ইরান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি কর্তৃপক্ষের দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করায় সে দেশের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। তাতে ইরানের অর্থনীতি গভীর সঙ্কটে পড়েছিল। সাম্প্রতিককালে ইরান প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে সে পারমাণবিক বোমা তৈরি করবে না এবং পারমাণবিক গেবষণা কেন্দ্রগুলো সে আন্তর্জাতিক তদন্তের জন্য খুলে দিয়েছে। তারপর তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ সামান্য পরিমাণে শিথিল করা হয়েছে। অবশিষ্ট বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ প্রত্যাহার সম্বন্ধে গত মঙ্গলবার (১৮ ফেব্রুয়ারি)) ছয়টি বিশ্ব শক্তির সঙ্গে ইরানের আলোচনা শুরু হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নও জিএসপি বাতিল করতে চায়
জিএসপি সুবিধা বাতিলের হুমকি যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই দিচ্ছে তা নয়। বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের অন্য বৃহত্তম বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নও হুমকি দিয়েছে যে, বর্তমান বাংলাদেশ সরকার যদি মানবাধিকার ও গণতন্ত্রকে সমুন্নত করার পথ না ধরে, যদি বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ না হয়, যদি খুবই দ্রুত সংলাপের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পন্থা উদ্ভাবন করে গ্রহণযোগ্য একটা সংসদ নির্বাচন না হয় তাহলে তারাও অন্যান্য ব্যবস্থার সঙ্গে বাংলাদেশী পণ্য রফতানির ওপর জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহার করবে। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাস করে তাদের চিন্তা-ভাবনার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছে। এসবের ফলাফল কী হতে পারে সে আলামত এরই মধ্যে দেখা যাচ্ছে। বিগত কয়েকদিনে মিডিয়াতেই দেখেছি তৈরি পোশাক রফতানির যেসব অযর্ডার বাংলাদেশের পাওয়ার কথা ছিল সেসব অর্ডার চলে যাচ্ছে ভারতে, ভিয়েতনামে এবং কম্বোডিয়ায়। মিডিয়ায় আরও দেখেছি, ভারতে পোশাক তৈরির কারখানা নির্মাণের হিড়িক পড়ে গেছে। অন্তত ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ধরেই নিয়েছেন বাংলাদেশে বর্তমানে যারা গদিতে আছেন তারা গোঁয়ার্তুমি ছেড়ে সুস্থ বুদ্ধির পথে ফিরে আসবেন না, সুতরাং জিএসপি সুবিধা বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়েই যাবে।
বিগত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ধ্বংস করার সুপরিকল্পিত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের ছেলেরা জীবিকার খোঁজে পৃথিবীর ৬৮টি দেশে এখন ছড়িয়ে পড়েছে। অজস্র ঝুঁকি মাথায় নিয়ে তারা বিদেশে যাচ্ছে, কেননা দেশে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। মাত্র গত সপ্তাহে মিডিয়ায় দেখেছি, গত ছয় বছরে ১৪ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিক লাশ হয়ে ফিরেছে বিদেশ থেকে। অবৈধভাবে বিদেশের পথে এবং আরও নানাভাবে অঘোরে তারা প্রাণ হারাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের কলকারখানায় এবং বাণিজ্যিক কোম্পানিগুলোতে কী দেখছি আমরা?
হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিক বৈধ এবং অবৈধভাবে এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। বিশেষ করে পোশাক শিল্পে বিগত পাঁচ বছরে এদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে এবং এই সময়ে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে দুর্ঘটনার সংখ্যা কলেরা মহামারীর মতো বেড়ে চলেছে। এই পাঁচ বছরের দুর্ঘটনায় কয়েক হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক মারা গেছে। বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়, এসব ভারতীয় শুধু যে বাংলাদেশীদের চাকরিগুলো দখল করে নিচ্ছে তা নয়, ভেতরে ভেতরে সাবোটাজও চালাচ্ছে তারা। তারা জানে ও বিশ্বাস করে, তৈরি পোশাকের বিশ্ববাজার বাংলাদেশের হাতছাড়া হয়ে গেলে সে বাজার যাবে ভারতের হাতে।
খাদ্যমন্ত্রী আমির হোসেন আমু গত সপ্তাহে বাংলাদেশের মানুষকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কতজন ভারতীয় মারা গেছেন। নিশ্চয়ই তিনি চান যে বাংলাদেশের মানুষ চিরতরে ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকুক, করজোড়ে হাঁটু গেড়ে বসে বলুক— ‘মহাশয়, পদাঘাতে দিয়েছো খ্রিস্টের সম্মান।’ মুক্তিযুদ্ধে ভারত আমাদের সাহায্য দিয়েছে, সেকথা আমরা অস্বীকার করিনি। কৃতজ্ঞতা জানাতেও আমরা কার্পণ্য করিনি। বাংলাদেশের চাইতেও বেশি উপকৃত হয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব। আমির হোসেন আমু এবং তোফায়েল আহমেদসহ আওয়ামী লীগের গোটা নেতৃত্ব বাংলাদেশের অসহায় মানুষকে নেতৃত্বহীন করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তোপের মুখে ফেলে রেখে ভারতে চলে গিয়েছিলেন। পুরো নয় মাস কলকাতার হোটেলগুলোতে তাদের পুষেছে ভারত সরকার। শুনেছি কোনো কোনো নেতার অতিথি কলগার্লদের বিলও পরিশোধ করেছে ভারত সরকার। বিশেষ করে তোফায়েল আহমেদ এবং আমু প্রমুখ কয়েকজনকে ভারত সরকার বাংরাদেশের নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত করছিল, ভারতীয় মিলিটারি একাডেমিতে তাদের প্রশিক্ষণের জন্য পাঠিয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত পাকিস্তান থেকে ফিরে আসবেন বলে ভারত নিশ্চিত ছিল না। সুতরাং ভারতের প্রতি আমু ও তোফায়েলদের কৃতজ্ঞতা অন্যদের চাইতে বেশি হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
ভারত কী নিয়েছে আর কী দিয়েছে
কিন্তু কিছু ত্যাগ স্বীকারের পরিবর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতা থেকে ভারত কী পেয়েছে, আমুরা হিসেব করে দেখেছেন কখনও? ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের ফেলে যাওয়া সর্বাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং বাংলাদেশের বাজার থেকে আমদানিকৃত বিলাস সামগ্রী ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতেই ভারতে চলে গিয়েছিল। কলকাতার সাংবাদিকরা তখন রসিকতা করে বলতেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী সর্বাধিক অস্ত্র সাহায্য পায় পাকিস্তান থেকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বলে পূর্ব সীমান্তের প্রতিরক্ষা বাবত প্রতি বছর ভারতের ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে বহু বিলিয়ন ডলার করে। বিগত ৪৩ বছর ধরে ভারত বাংলাদেশকে ব্যবহার করছে ‘ক্যাপটিভ’ বাণিজ্যের বাজার হিসেবে। দু’দেশের বাণিজ্যের ভারসাম্যের ব্যবধান দিন দিন দুস্তর হচ্ছে। সর্বোপরি বিগত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশের সড়ক, রেল, নদীপথ এবং সমুদ্র বন্দর দুটো বিনা ব্যয়ে ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে দিয়েছে ভারতকে। অর্থাত্ কার্যত এই পাঁচ বছরে আমাদের সার্বভৌমত্বকেও ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বঅরত নানা উছিলায় দু’দেশের মধ্যকার আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলো কার্যকর করছে না। আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে তারা অভিন্ন নদীগুলোর উজানে বাঁধ তৈরি করছে, বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারার সব আয়োজন পাকা করে ফেলেছে।
এরপর যদি আমু, তোফায়েল এবং মেননরা বলতে চান যে একাত্তরের ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতা হিসেবে বাংলাদেশের রফতানি বাণিজ্যের বাজারও তারা ভারতের হাতে তুলে দিতে চান এবং সে উদ্দেশ্যেই দেশের পোশাক শিল্পকে সাবোটাজের হাতে তুলে দিয়ে এবং স্বদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করে ইউরোপ-আমেরিকার বাজার হাতছাড়া করে আমাদের পোশাক শিল্পের বাজার নষ্ট করছেন; তাহলে সে জন্য তাদের জবাবদিহি করতে হবে বাংলাদেশের জনতার কাছে।
একচক্ষু পররাষ্ট্রনীতির মতো একচক্ষু কৃতজ্ঞতাও কি দেখাচ্ছেন না তারা? হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭১ সালে বলেছিলেন স্বাধীন হলে বাংলাদেশ হবে একটা ‘বাস্কেট কেস’ (মুমূর্ষু যুদ্ধাহত)। (অনেকেই ভুল উদ্ধৃতি দেন। কিসিঞ্জার কখনও বটমলেস বাস্কেট বলেননি]। বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা মাত্র সেদিন বলেছেন, কিসিঞ্জার ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিন্তু কিসিঞ্জারকে ভুল প্রমাণিত করে বাংলাদেশ যে ৪৩ বছর পরও শুকিয়ে মরেনি তার জন্য উদার মার্কিন অর্থ ও প্রকৌশল সাহায্য, বাণিজ্যের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা এবং কয়েক লাখ অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসীর প্রতি অনুকূল আচরণ অনেকখানি দায়ী। বাংলাদেশের এই সীমিত সমৃদ্ধি ভারতের বদান্যতায় হয়নি মোটেও। আসলে ভারত যতখানি দিয়েছে আমাদের, নিয়েছে তার তুলনায় বহুগুণ বেশি। সংশ্লিষ্ট তিন মন্ত্রী এবং সার্বিকভাবে বর্তমান সরকার সেসব অস্বীকার করে মারাত্মক ভুল করছে।
কৃতজ্ঞ হতেও ভুলে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী
তার চাইতেও বেশি মারাত্মক ভুল হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের কথা ভুলে যাওয়া। একাত্তরে আওয়ামী লীগের আপাদমস্তক নেতৃত্ব যখন রণাঙ্গনে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত ছিল, তখনও বাংলাদেশের আপামর ছাত্র-জনতা কিসের লক্ষ্যে অত্যাধুনিক পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল? শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, গণতন্ত্র নেশার মতো বাংলাদেশের মানুষের শিরায় শিরায়। এই গণতন্ত্রের জন্যই তারা একাত্তরে প্রায় খালি হাতে হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। গণতন্ত্রকে হত্যা করে বর্তমান সরকারও পঁচাত্তরের বাকশালী সরকারের মতো জনতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। পঁচাত্তরে পরিণতি ভালো হয়নি। এবারে হবে কি?
শেখ হাসিনার স্মৃতিশক্তি দুর্বল। ওয়াশিংটনের মুখে চপেটাঘাত করার সময় তিনি ভুলে যান যে মার্কিন সরকারের কাছে তার কৃতজ্ঞ থাকার অনেক ব্যক্তিগত কারণও আছে। ২০১০ সালে শেখ হাসিনার সঙ্গে দীর্ঘ টেলিফোন আলাপে সন্তুষ্ট হতে না পেরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সে টেলিফোন কথোপকথনের পূর্ণ বিবরণ মিডিয়ায় ফাঁস করে দিয়েছিলেন। সে বিবরণে পরিষ্কার শেখ হাসিনাকে মনে করিয়ে দেয়া হয়েছিল যে ২০০৮ সালে দিল্লি আর ওয়াশিংটন সম্মিলিত চেষ্টা করে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী এবং শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। হাসিনা এখন এক পৃষ্ঠপোষককে পরিত্যাগ করে ও চটিয়ে সম্পূর্ণরূপে অন্য পৃষ্ঠপোষককে আঁকড়ে ধরেছেন। সেটা ওয়াশিংটনের জন্য সুখকর অনুভূতি নয়।
রফতানিতে জিএসপি সুবিধা হারানো ছাড়া আরও একটা গুরুতর হুমকি দেয়া হয়েছে মার্কিন সিনেটে পররাষ্ট্র কমিটির দ্বিতীয় এবং সর্বসাম্প্রতিক শুনানিতে। বলা হয়েছে, নতুন করে বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা না করা হলে এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে শুধু এমন প্রকল্পেই অর্থ সাহায্য দেবে যেসব প্রকল্পে সংসদ সদস্যদের ভূমিকার সুযোগ থাকবে না। বিগত সংসদে আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যদের কারও কারও সম্পদ শতগুণ এবং হাজারগুণ বেড়েছিল। সে লালসায় পড়ে ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনেও কেউ কেউ লাখের এবং কোটির অঙ্কে টাকা ব্যয় করেছেন। মার্কিন সিনেটের উপরোক্ত ঘোষণা অবশ্যই তাদের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হবে।
বিদেশি মুদ্রা অর্জনের ওপর এ দুটি হুমকি আসছে এমন সময় যখন রেমিট্যান্সের আয় দ্রুত পড়ে যাচ্ছে। সরকারের ভ্রান্ত পররাষ্ট্রনীতির কারণে উপসাগরীয় দেশগুলোসহ বহু দেশ বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে কিংবা হ্রাস করছে। অর্থাত্ রেমিট্যান্স আরও কমে যাবে।
সরকারের অন্তরে আতঙ্ক
মনে হচ্ছে সরকারেও কোথাও না কোথাও দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টায় পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের নেতৃত্বে একটা প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়েছে ওয়াশিংটনে। কিন্তু গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢাললে কোনো লাভ হবে? বাংলাদেশ নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগের কারণ মৌল। মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশকে অর্থ সাহায্য, রাজনৈতিক সমর্থন এবং বাণিজ্যিক সুবিধা দেয় সে দেশে এবং সে অঞ্চলে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র মজবুত করার আশায়। বিগত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ঘটেছে সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাপার-স্যাপার। এই পাঁচ বছরে মানবাধিকার বলতে তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই বাংলাদেশে। রাজনৈতিক মতদ্বৈধের কারণে বিচারবহির্ভূতভাবে ছয় শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে এ সময়ে। মিথ্যা সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে, ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধের মিথ্যা অজুহাতে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হত্যা করা হচ্ছে। গুম ও খুনের ঘটনা এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। জানুয়ারি মাসেই রাজনৈতিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে ছয় শতাধিক।
গণতন্ত্রের নাম-নিশানা মুছে ফেলার সব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বাংলাদেশে। ভারত-মার্কিন ষড়যন্ত্রে গদি পাওয়ার সময় থেকেই সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের সব রকমের ব্যবস্থা হয়েছে। বিরোধীদের সভা-সমাবেশ এবং মিছিল করে রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিএনপির দলীয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে একাধিকবার পুলিশ হামলা করেছে, কার্যালয়টি বহুবার বন্ধ কিংবা পুলিশবেষ্টিত করা হয়েছে। হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মী সাজানো মামলায় কারারুদ্ধ আছেন। সরকার মুখে অস্বীকার করলেও কারও বুঝতে বাকি নেই যে সংবাদের স্বাধীনতা সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
মেহেরুন রুনি ও তার স্বামী সাগরসহ ২৩ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন এই পাঁচ বছরে। আহত এবং নির্যাতিত হয়েছেন আরও কয়েকশ’। মাহুমুদুর রহমান আজও বিনা বিচারে বন্দি আছেন। আমার দেশ পত্রিকার ছাপাখানা এখনও তালাবদ্ধ। দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশন এখনও নীরব। ৫ মে রাতে শাপলা চত্বরের সত্য বিবরণ প্রকাশের দায়ে মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের নেতাদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা রুজু করা হয়েছে। এই পাঁচ বছর ধরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সরকার সবচাইতে মারাত্মক আঘাত হেনেছে গণতন্ত্রের ওপর। কোনো কোনো মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতা গোড়া থেকেই বলে এসেছেন যে একটা বাকশালী ধাঁচের (একদলীয়) সরকার প্রতিষ্ঠাই তাদের কাম্য। সরকারের কাজকর্মেও অহরহ দেখা গেছে যে তারা যে কোনো মূল্যে গদি দখল করে থাকতে চায়। যেভাবে তারা দশম সংসদ নির্বাচনে এগোচ্ছিল তাতে নির্বাচন ন্যায্য এবং নিরপেক্ষ হবে বলে কেউ আশা করতে পারেনি। দেশে-বিদেশে এ বিশ্বাসই বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে, একটা লোকদেখানো নির্বাচনের অভিনয় করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকাই সরকারের লক্ষ্য। সে কারণে কোনো দেশই সে নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে রাজি হয়নি। একমাত্র ভারত ছাড়া পৃথিবীর অন্য সব দেশই সংলাপের মাধ্যমে স্বীকৃত একটা পদ্ধতিতে সবার গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন করার পরামর্শ দিয়েছিল সরকারকে। কিন্তু সবাই লক্ষ্য করছেন, একমাত্র দিল্লির ছাড়া অন্য কারও পরামর্শ এ সরকারের গ্রহণযোগ্য নয়।
সাজানো ভিডিওয় কেউ বিভ্রান্ত হবে না
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্য সব সাহায্যদাতা দেশ ও সংস্থা যে শেখ হসিনার সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট, এসব হচ্ছে তার কারণ। সাধারণ বুদ্ধির একটা প্রবাদ বহু দেশে আছে। ইংরেজিতে ‘ডোন্ট বাইট দ্য হ্যান্ড দ্যাট ফিডস ইউ’—যে হাত ভাত দেয় সে হাত কামড়াতে নেই। বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জেও বলে : যে গাই দুধ দেয় তার লাথিও সই। এগুলোসহ বহু হীত কথাতেই যে তাদের বিশ্বাস নেই, বর্তমান সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা বার বার তার প্রমাণ দিয়েছেন।
পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের নেতৃত্বে যে প্রতিনিধি দলটি ওয়াশিংটনে গেছে তাকে কতাখানি ক্ষমতা দেয়া হয়েছে জানি না। কিন্তু একথা মোটামুটি বলা যায় যে, উপরোক্ত পুরনো দাবিগুলো গ্রহণ করা না হলে মার্কিন সরকার জিএসপি কিংবা প্রকল্প সাহায্যের ব্যাপারে তাদের মনোভাব শিথিল করবে বলে মনে হয় না। হয়তো সেটা বুঝে গিয়েই সরকার এখন হিটলারি ছলনার আশ্রয় নিয়েছে। আল কায়দা প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির নামে যে ভিডিওটি গত ক’দিনে প্রচার করা হচ্ছে সেটাকে এ আলোকেই বিচার করতে হবে। নাইন-ইলেভেনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আল কায়দা ভীতি তুঙ্গে উঠেছিল। তার অপসুযোগ নিয়ে মার্কিন জনমতকে প্রভাবিত করা অবশ্যই এই ওয়েবসাইটের আনাড়ি প্রচেষ্টা। সরকারের গোয়েবলসরা আদাজল খেয়ে এ নিয়ে অপবাদ ছড়াচ্ছেন। কেউ হেফাজতে ইসলাম, কেউ জামায়াত আর কেউ বিএনপিকে সেজন্য দায়ী করার চেষ্টা করেছেন। সরকারের মি. গোয়েবলস হাছান মাহমুদ তো সরাসরি খালেদা জিয়াকেই সেজন্য দায়ী করেছেন।
তারা সবাই সরকারের অপপ্রচারকে খণ্ডন করেছেন। তারপর থেকে আল কায়দা তো স্বয়ং বলেছে যে এই ভিডিওর সঙ্গে তার সংস্থার কোনো সম্পর্ক নেই। অবশ্য সাধারণ মানুষও সরকারের অপপ্রচারে কান দেয়নি। তারা সন্দেহ করছে র’কে। তাছাড়া ইন্টারনেটে প্রচারের আবাসিক বিশেষজ্ঞ তো গণভবনেই আছেন। শহীদুল হক মিশনের সায়াহ্নের এসব অপপ্রচারে ওয়াশিংটনের মনোভাব প্রভাবিত হবে কিনা সে প্রশ্ন অনেকের মনেই উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আলোচ্য ভিডিও সম্বন্ধে স্টেট ডিপার্টমেন্টের (মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর) প্রতিক্রিয়া থেকে তো মনে হয় সরকারের আশাবাদী হওয়ার কারণ নেই। (লন্ডন ১৮.০২.১৪)