ক্রমেই ভারী হচ্ছে প্রবাসী লাশের বোঝা
অনেক স্বপ্ন আর বুক ভরা আশা নিয়ে বিদেশ যান তারা। পরিবার ও বাবা-মাসহ সবকিছু ছেড়ে পাড়ি জমান বিদেশের মাটিতে। সবকিছুর মায়া ভুলে ছুটে বেড়ান কাজের নেশায়। একটুখানি সুখ-সচ্ছলতা, পরিবারের মানুষদের মুখে একটু হাসি ফোটানোতেই সুখ খুঁজে পান প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
কিন্তু যখনই কোনো দুর্ঘটনা বা অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে লাশ হয়ে দেশে ফেরেন, তখন বুক ভেঙে যায় স্বজনদের। অশনিসংকেতে ভরে ওঠে চারপাশ। শুধু পরিবারের মানুষ নয়, সারা দেশে তখন নেমে আসে কান্নার রোল, বিপর্যয় আর মর্মভেদী আহাজারি।
দিন দিনই বড় হচ্ছে বাংলাদেশি প্রবাসীদের মৃতের তালিকা। এরই ধারাবাহিকতায় ক্রমেই আরও ভারী হয়ে উঠছে লাশের বোঝা।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, ২০০৫ সালে ৪১ লাখ ৭৬ হাজার ৭২৯ জন বাংলাদেশি প্রবাসীর বিপরীতে দেশে মোট লাশ আসে ১ হাজার ২৪৮টি। সেখানে ২০১৩ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭৬। যদিও বর্তমানে বিভিন্ন দেশে মোট ৮৭ লাখ ১৭ হাজার বাংলাদেশি প্রবাসী কর্মরত রয়েছেন।
তবে প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, অনাবাসিক ও অন্যান্যসহ সবমিলিয়ে মোট ১ কোটি বাংলাদেশি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন।
২০০৮ সালেই প্রথম বাংলাদেশি প্রবাসীদের লাশের সংখ্যা দুই হাজারের কোটা পেরিয়ে যায়। যদিও এর আগের বছরে সেই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬৭৩। ২০০৭-২০০৮ সময়টাতেই লাশের সংখ্যা সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়ে। অর্থাৎ এই এক বছরেই লাশের সংখ্যা ৪২৫টি বেড়ে হয় ২ হাজার ৯৮। এরপর থেকে ক্রমেই বিদেশ থেকে আসা প্রবাসীদের লাশের সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রবাসীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মৃতের সংখ্যাও।
এদিকে বাংলাদেশ বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্যে বছরে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রবাসী বাংলাদেশিদের মৃতদেহের একটা পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে।
সেখানে দেখা গেছে, ২০১৩ সালে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যুবরণকারী প্রবাসীদের মোট ৫৫৮টি মৃতদেহ গ্রহণ করেছে বিমান কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে স্ট্রোকের কারণে সর্বোচ্চ ৭৪৯টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ওই বছরে। এ ছাড়া হার্ট অ্যাটাকের কারণে ৪৭০, অসুস্থতার কারণে ৪৫৭ এবং সড়ক দুর্ঘটনার কারণে ১২৬টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
এতে আরও দেখা যায়, ২০১৩ সালেই মোট মৃতের সংখ্যা হয় ৩ হাজার ৭৬। যার মধ্যে আবার ৫৮০ প্রবাসীর মৃত্যুর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ এতে মোট ২ হাজার ৪৯৬টি মৃত্যুর কারণ জানা গেছে। এর মধ্যে ৭০ দশমিক ৪৩ ভাগ প্রবাসীর মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া অস্বাভাবিকভাবে সড়ক দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা, খুন ও আগুনে পুড়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৩০ ভাগ প্রবাসীর।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিদিনই গড়ে আট থেকে দশজন প্রবাসীর লাশ আসছে। গত মাসে (জানুয়ারি) এসেছে ২৪৯টি লাশ। গত বছরের ৭ ডিসেম্বর এক দিনেই লাশ হয়ে দেশে ফেরেন ১৫ জন প্রবাসী শ্রমিক। এর মধ্যে ১০ জনের লাশই এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এই ১৫ জনের মধ্যে আটজন মারা গেছেন হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে আর পাঁচজন দুর্ঘটনায়।
২০০৮ থেকে ২০১৩—ছয় বছরে ৫৬টি দেশ থেকে লাশ এসেছে ১৩ হাজার ৮৭২ জন প্রবাসীর। এর আগে ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এসেছে ছয় হাজার ১৭টি লাশ। আরও আগে ২০০২ সাল পর্যন্ত তিন হাজার ৬১৩ জন প্রবাসী শ্রমিকের লাশ আসার তথ্য আছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে।
ছয় বছরে চার হাজার ২০৯ জনের লাশই (৩০ শতাংশ) এসেছে সৌদি আরব থেকে।
সৌদি আরবের পর সবচেয়ে বেশি লাশ এসেছে মালয়েশিয়া থেকে। ছয় বছরে এই সংখ্যা দুই হাজার ৩২৭ (১৬ শতাংশ)। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ছয় বছরে এসেছে দুই হাজার লাশ, কুয়েত থেকে ৮৮৬, ওমান থেকে ৬৬৪, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫২৩, ভারত থেকে ৪১০, বাহরাইন থেকে ৩৭৪, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ৩৪৫, কাতার থেকে ৩০৩, সিঙ্গাপুর থেকে ২৯৯, ইতালি থেকে ২৭৩, যুক্তরাজ্য থেকে ১৯৩, লেবানন থেকে ১৩১, লিবিয়া থেকে ১১৫, পাকিস্তান থেকে ১০২ এবং থাইল্যান্ড থেকে ৬৯ জন লাশ হয়ে ফিরেছেন। বাকি লাশগুলো এসেছে অন্যান্য দেশ থেকে।
প্রবাসীদের লাশ এলে মৃত্যুর কারণ লিখে রাখা হয় বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্কে। ২০১৩ সালে মারা যাওয়াদের মধ্যে দুই হাজার ৪৯৬ জন প্রবাসীর মৃত্যুর কারণ তদন্ত করে দেখা গেছে, মাত্র ১৫৯ জনের মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক। অর্থাৎ স্বাভাবিক মৃত্যুর হার মাত্র ৬ শতাংশ। ৯৪ শতাংশ প্রবাসীই অস্বাভাবিকভাবে মারা গেছেন।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী মারা গেছেন স্ট্রোকে। ২০১৩ সালে এই সংখ্যা ৭৪৯, অর্থাৎ ৩০ শতাংশ। হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে ৪৭০, কর্মক্ষেত্রে ও সড়ক দুর্ঘটনায় ৬২৬, অসুস্থতায় ২৯৮, ক্যানসারে ৬২ এবং আগুনে পুড়ে ২৬ জন মারা গেছেন। আর ১৯ জন আত্মহত্যা এবং নয়জন খুন হয়েছেন। ২০ জনের মৃত্যুর কারণ অজানা।
একইভাবে ২০১২ সালে মারা যাওয়া দুই হাজার ৩৭৭ জনের মৃত্যুর কারণ তদন্ত করে দেখা গেছে, স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ১৫২ জনের (৬ শতাংশ)। স্ট্রোকে ৭৩০, হূদেরাগে ৩৩৬, অসুস্থতায় ২৫২, দুর্ঘটনায় ৭৫২, ক্যানসারে ৫৬ ও আগুনে পুড়ে মারা যান আটজন। এ ছাড়া ১৩ জন খুন হয়েছেন, আত্মহত্যা করেছেন নয়জন। ৯৬ জনের মৃত্যুর কারণ অজানা।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বুধবার রেমিট্যান্স রিজার্ভের পরিমাণ ১৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আর এই রেমিট্যান্স প্রবাহের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখে থাকেন এই প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এতে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি দিন দিন সবল হচ্ছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছে এমন সংগঠনগুলো মৃত্যুর এই হার নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে, বর্তমানে এক কোটি লোক বিদেশে থাকেন। প্রতিদিন গড়ে সাত থেকে আটটি লাশ আসা অসম্ভব কিছু নয়।
এ বিষয়ে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জাফর আহমেদ খান বলেন, ‘আমাদের কর্মীদের কর্মপরিবেশ ও থাকার পরিবেশ ভালো করার জন্য আমরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কথা বলছি।’
অভিবাসনবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন কারাম এশিয়া। এর সমন্বয়ক হারুন-অর-রশিদ মালয়েশিয়া থেকে বলেন, ‘এত প্রবাসীর মৃত্যু মর্মান্তিক। দীর্ঘদিন ধরেই আমরা বলে আসছি, শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নত করা হোক। নিয়মিত ছুটি দেওয়া হোক। তাঁদের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া হোক। কিন্তু কেউ তা শুনছে না।’