মিসরে নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে সেনাবাহিনী
মিসরের সেনাবাহিনী নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে হটিয়ে ক্ষতা দখল করলেও শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইর চলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই অভ্যুত্থান সিরিয়া পরিস্থিতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। ডেইলি টেলিগ্রাফ ও টুডেস জামান। মিসরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ মুরসির কাছ থেকে এ মাসের প্রথম দিকে এক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করে বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়েছে দেশটির সেনাশাসকেরা। এতে দেশটি বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্টের প্রতি অনুগতদের সাথে সমঝোতা না করে গত শনিবার যে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে, তা থেকে প্রমাণিত হয় সেনাবাহিনী ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে পুরনো খেলা খেলতে চাইছে। অবশ্য আরব বসন্তের আগে থেকেই মিসর বদলে গেছে। হোসনি মোবারক ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেননি। তেমনি সেনাবাহিনীর সর্বশেষ নির্মম শক্তির ব্যবহার দেশটিতে আরো ভয়াবহ রক্তপাতের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, সেনাপ্রধান জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ সিসি মুসলিম ব্রাদারহুডকে পুরোপুরি দমনের এবং তারপর তাদের ছাড়াই গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করছেন। সেনাবাহিনীর ইসলামপন্থী দলগুলোকে দমনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি হয়তো ভাবছেন তা করা সম্ভব হবে। পশ্চিমা ও উপসাগরীয় অনেক দেশ হয়তো এ ধরনের পদক্ষেপে সমর্থন দেবে। কিন্তু ২০১১ সালের পরে মিসরের জীবন ধারায় যে পরিবর্তন ঘটেছে, এ ধরনের নীল নকশায় তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এই পরিবর্তনের ফলে বর্তমানে এ ধরনের কর্মপন্থা গ্রহণ অনেকটা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মোবারকের সময়ে ইসলামপন্থীদের সংগঠিত হতে ও তাদের ইচ্ছামতো ধর্ম পালনে বাধা দেয়া হতো। তাকে অপসারণের পর থেকে তারা ইচ্ছামতো সব কিছু করার স্বাধীনতা পেয়েছে এবং এখন ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া সবশেষ অভ্যুত্থানের পেছনে সালাফি, সেক্যুলার বিপ্লবী ও পুরনো সরকারের সদস্যরাসহ যেসব শক্তি রয়েছে, তারা এক অদ্ভূত মিশ্রণ। মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি ঘৃণা ছাড়া আর কোনো দিক দিয়ে তাদের মিল নেই। সুতরাং নিশ্চয়ই তারা দীর্ঘকাল রাজনৈতিক জোট হিসেবে বহাল থাকবে না। কয়েক সপ্তাহ পরে জেনারেল সিসি হয়তো মিসরের অনেক সমস্যা চিহ্নিত করতে চাইবেন। ২০১১ সালের বিপ্লবের পরে আমরা দেখেছি সেনাবাহিনী রাজনীতির ব্যাপারে অনমনীয় ও হতাশ। মুসলিম ব্রাদারহুড শান্তিপূর্ণ সাংগঠনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে অনেক অত্যন্ত নিবেদিতপ্রাণ সমর্থককে সক্রিয় করবে। মিসরীয় সমাজে তাদের রয়েছে গভীর শিকড় ও সহানুভূতি এবং তাদের প্রতি যে আচরণ করা হচ্ছে তাতে এ সহানুভূতি আরো বাড়ছে। অভ্যুত্থান সমর্থনকারী মিসরের অনেকে এখন ভিন্ন চিন্তা করছেন। তারা জেনারেল সিসিকে তার পূর্বসূরিদের মতো সামরিক শাসক মনে করছেন। মিসরের বর্তমান পরিস্থিতির মূলে রয়েছে কয়েক দশক ধরে বিদ্যমান বিভিন্ন সমস্যা। লাগাতার সামরিক শাসনে দারিদ্র্য, সামাজিক বৈষম্য ও বেকারত্বের বিস্তার ঘটেছে। হোসনি মোবারকের শেষ দিনগুলোতে দুর্নীতি ও তার ঘনিষ্ঠমহলের লুটপাট ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। এরই মধ্যে ৩০ জুন ২০১২ মুরসি হলেন প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। দেশটিতে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা এমন প্রকট ছিল যে সুশাসন কার্যত অসম্ভব ছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট মুরসি ও ব্রাদারহুড এ দিকে দৃষ্টি না দিয়ে ক্ষমতা সংহত করার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করে। এ দিকে মিসরের অভ্যুত্থান সিরিয়া পরিস্থিতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলবে। যদিও মিসরের ঘটনাবলিকে অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে মনে করা হয়। কিন্তু ঐতিহাসিক ভূমিকা, সামরিক সক্ষমতা ও আরব বিশ্বের প্রধান শক্তি হওয়ার কারণে আঞ্চলিক ক্ষমতার পালা বদলে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে এই ঘটনা। সাম্প্রতিককালে সিরিয়ার ব্যাপারে মুরসি সরকার যে জোরালো অবস্থান নিয়েছিল, তা এই অভ্যুত্থানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে মনে করেন অনেকে। তাই সিরিয়া পরিস্থিতি যেমন এই অভ্যুত্থানের একটি কারণ, তেমনি এই অভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে সিরিয়া পরিস্থিতির ওপর। মিসরের অভ্যুত্থানকে সিরিয়া সরকারের একটি সাফল্য ও বিরোধীদের জন্য ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। মিসরে অভ্যুত্থানের পর প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ এটিকে রাজনৈতিক ইসলামের ব্যর্থতা বলে বর্ণনা করেন। অন্য দিকে সিরিয়ার বিরোধী জোট এটিকে তাদের জন্য একটি ধাক্কা হিসেবে বিবেচনা করে।