ওবামার ড্রোন মিশন : ৫ বছরে নিহত ২৪০০
পাঁচ বছর আগে ২০০৯ সালের ২৩ জানুয়ারি সিআইএ’র একটি ড্রোন পাকিস্তানের উপজাতীয় অঞ্চলের একটি বাড়ি মিশিয়ে দিল। সেটা ছিল বারাক ওবামার প্রেসিডেন্সির তৃতীয় দিন। আর এভাবেই সূচনা ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কমান্ডার-ইন-চিফের গোপন ড্রোন হামলা।
প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়, ওই হামলায় বিদেশি যোদ্ধা এবং সম্ভাব্য একজন অত্যন্ত ‘মূল্যবান টার্গেট’সহ আনুমানিক ১০ জঙ্গি নিহত হয়েছে। সদ্য দায়িত্ব গ্রহণকারী প্রশাসনের জন্য সাফল্যমণ্ডিত প্রথম আঘাত।
কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই বেসামরিক লোকজনের হতাহতের খবর আসতে শুরু করে। পরবর্তী রিপোর্টগুলোতে দেখা যায়, ওই হামলাটিতে সাফল্যের লেশমাত্র ছিল না। তাতে অন্তত নয়জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই একটি পরিবারের। পরিবারটির মাত্র এক সদস্যই বেঁচে ছিল। ১৪ বছর বয়সী ফাহিম কোরেশি। তবে সে যেভাবে আহত হয়েছিল, তাতে তার নিহত স্বজনদের থেকে তার পার্থক্য খুব বেশি ছিল না। তার পেটে কয়েকটি আঘাত লেগেছিল, মাথাটা তবিত হয়ে পড়েছিল, একটি চোখও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
ওই দিনই সিআইএ আরেকবার হামলা চালিয়েছিল। এবার আরেকটি বাড়ি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হলো। এখানেও আরেকটি ভুল হলো। এবার পাঁচ থেকে ১০ জন নিহত হয়েছিল। সবাই বেসামরিক নাগরিক।
নিউজউইক রিপোর্টার ড্যানিয়েল ক্যাইডম্যান পরে লিখেছেন, বেসামরিক প্রাণহানির বিষয়টি ওবামাকে অবগত করানো হয় এবং তিনি ‘বোধগম্যভাবেই ুব্ধ’ হয়েছিলেন। তিন দিন পর অভিষেক ভাষণে ওবামা বিশ্বকে বললেন, ‘আমেরিকা প্রতিটি জাতির এবং শান্তি ও মর্যাদা লাভে আকাক্সী প্রতিটি শিশু, নারী ও পুরুষের বন্ধু।’
পাকিস্তান সরকারও জানত, হামলাগুলোতে বেসামরিক লোকজন নিহত হচ্ছে। স্থানীয় রাজনীতি প্রশাসনের তৈরি করা নথিপত্র এবং গত বছর ব্যুরোর প্রকাশিত তালিকায় নিহতদের মধ্যে নয়জন বেসামরিক লোকের কথা উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এই প্রাণহানির ব্যাপারে সরকার কোনো কথা বলেনি।
এই বিপর্যয়কর সূচনা সত্ত্বেও ওবামা প্রশাসন ড্রোন হামলা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়িয়ে দেয়। ২০০৯ সালে ওবামার অভিষেকের পর থেকে সিআইএ পাকিস্তানে ৩৩০ বার হামলা চালায়। তার পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ চার বছরে চালিয়েছিলেন ৫১ বার। আর ইয়েমেনে ওবামা গোপন ড্রোন যুদ্ধের নতুন ফ্রন্ট খুলেছেন।
প্রাণঘাতী হামলা
কোরেশির ওপর হামলা চালানোর পর থেকে ওবামা প্রশাসন পাঁচ বছরে পাকিস্তান, ইয়েমেন ও সোমালিয়াজুড়ে ৩৯০ বারের বেশি ড্রোন আক্রমণ করেছে, সংখ্যাটা পুরো বুশ আমলের চেয়ে আট গুণ বেশি। এসব হামলায় দুই হাজার ৪০০ লোকের বেশি নিহত হয়েছে, যাদের অন্তত ২৭৩ জন বেসামরিক লোক বলে জানা গেছে।
ওবামার আমলে পরিচালিত ড্রোন হামলায় বুশের আমলের চেয়ে প্রায় ছয়গুণ বেশি লোক নিহত হলেও মৃত্যুর হার (প্রতিটি হামলায় নিহত লোকের গড় সংখ্যা) বর্তমান প্রেসিডেন্টের সময় আট থেকে কমে ছয় হয়েছে। বেসামরিক লোকের মৃত্যুর হারও কমেছে। বুশের আমলে প্রতিটি হামলায় গড়ে তিনজনের বেশি বেসামরিক লোক নিহত হতো। ওবামার আমলে এটা অর্ধেকে (প্রতিটি হামলায় গড়ে ১.৪৩ করে) নেমে এসেছে। বস্তুত, ২০১০ সালে পাকিস্তানে বেসামরিক হতাহতের সংখ্যা ব্যাপকভাবে কমে গেছে, ২০১৩ সালে বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার নিশ্চিত কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
বেসামরিক লোক হতাহত হওয়ার সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ার কারণ ড্রোন ও পেণাস্ত্র প্রযুক্তিতে উন্নতি, ড্রোন মিশন নিয়ে পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং দেশে ও বিদেশে গোপন ড্রোন হামলা নিয়ে বেশি বেশি বিশ্লেষণ।
২০০৬ সালে বুশ প্রশাসনের সময় যেভাবে ল্যবস্তু নির্ধারিত হতো, ওবামার আমলে তাতে দৃশ্যত পরিবর্তন এসেছে। ২০০৬ সালের ৩০ এপ্রিল সিআইএ’র একটি ড্রোন হামলায় পাকিস্তানের উপজাতীয় বাজুর এলাকার একটি মাদরাসা ধবংস হয়। এতে অন্তত ৬৮ শিশু নিহত হয়। বলা হয়েছিল, আল-কায়েদার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরিকে ল্য করে হামলাটি চালানো হয়। তিনি রা পেয়েছিলেন। গত বছর ২১ নভেম্বর আবার একটি মাদরাসাকে টার্গেট করা হয়। এটি ছিল উপজাতীয় এলাকার বাইরে হাঙ্গুতে। তখন ভবনটিতে প্রায় ৮০ শিশু ঘুমিয়ে ছিল। হামলায় ভবনটি একটি বিশেষ অংশ তথা মাত্র দুটি ক ধবংস হয়। নিহত হয় ছয় ব্যক্তি, আহত হয় নয়জন।
তবে ইয়েমেনে মার্কিন ড্রোন হামলায় বেসামরিক লোক নিহত হওয়া অব্যাহত রয়েছে। ২০০৯ সালে ইয়েমেনে ওবামার প্রথম হামলার পর গত বছর সেখানে সবচেয়ে বেশি লোক নিহত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ইয়েমেন এবং পাকিস্তানে ওবামার যুদ্ধে ড্রোন প্রধান অস্ত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অথচ ইয়েমেনে কিন্তু ড্রোন দিয়ে হামলা শুরু হয়নি। ২০০৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর মার্কিন সাবমেরিন দণি ইয়েমেনের মাজালায় সন্দেহজনক একটি জঙ্গি ক্যাম্পে গুচ্ছ বোমাসহ ক্রুজ পেণাস্ত্র হামলা চালানো হয়।
পেণাস্ত্রটি ইয়েমেনের সবচেয়ে গরিব একটি উপজাতীয় এলাকায় আঘাত হানে। গোলার আঘাত এবং আগুনে অন্তত ২১ শিশু ও ১২ নারীসহ অন্তত ৪১ জন বেসামরিক লোক প্রাণ হারায়। এর এক সপ্তাহ আগে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তিনি পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে শক্তি প্রয়োগ সম্পর্কে বলেন, এটা ‘কেবল প্রয়োজনীয়ই নয়, সেইসঙ্গে নৈতিকভাবেও যৌক্তিক।’ তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘আলোচনার মাধ্যমে আল-কায়েদা নেতাদের অস্ত্র সমর্পণে রাজি করানো যাবে না।’
পাকিস্তানে হামলা পরিচালনা করে সিআইএ। ইয়েমেনে সেটা করে সিআইএ এবং মার্কিন সামরিক বাহিনীর বিশেষ ইউনিট জয়েন্ট স্পেশাল অপারেশন্স কমান্ড। তারা ড্রোন, প্রচলিত যুদ্ধবিমান এবং সেইসাথে ক্রুজ পেণাস্ত্রও ব্যবহার করে আল-কায়েদা জঙ্গিদের ওপর।
তবে সাম্প্রকি সময়ে পাকিস্তানের মতো ইয়েমেনেও ড্রোনই প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট বুশ ২০০২ সালে ইয়েমেনে একটি ড্রোন হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাতে নিহত হয়েছিল ছয়জন। ওবামার আমলে সিআইএ ও পেন্টাগন ইয়েমেনে অন্তত ৫৮টি হামলা চালিয়েছে। এতে অন্তত ২৪ বেসামরিক লোকসহ ২৮১ জনের বেশি নিহত হয়েছে।
অস্পষ্ট মিশন
ড্রোন হামলা বাড়লেও হোয়াইট হাউজ এ ব্যাপারে সরকারিভাবে বলতে গেলে কোনো ধরনের স্বচ্ছতার ধার ধারেনি। ওবামা যে ড্রোন ব্যবহার করছেন, সেটা প্রকাশ্যে উল্লেখ করতে তিন বছর লেগেছিল। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে তিনি বলেছিলেন, ‘আসলে ড্রোনে বিপুল সংখ্যয় বেসামরিক প্রাণহানি হচ্ছে না।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘বেশির ভাগ েেত্র এগুলো আল-কায়েদা এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে খুবই নিখুঁত, সংপ্তি হামলা।’
অথচ এই সময়েই ব্যুরোর রেকর্ডে দেখা যায়, ড্রোনে ৬১ শিশুসহ অন্তত ২৩৬ বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। ড্রোন হামলা সম্পর্কিত ম্যাককাটচি নিউজ এজেন্সির ফাঁস হওয়া সিআইএ’র একটি রেকর্ডে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র অনেক সময় জানেই না, কাদের তারা হত্যা করছে। ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের পর এক বছরে ড্রোন হামলায় অন্তত ২৬৫ থেকে ৪৮২ জন নিহত হয়। নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে, এসব লোককে চিহ্নিত করা হয়েছে আফগান, পাকিস্তানি এবং অজ্ঞাত পরিচয় চরমপন্থী হিসেবে।
অ্যাটনি জেনারেল এরিক হোল্ডার এবং এনবিসির ফাঁস হওয়া একটি নথিতে বলা হয়েছে ড্রোন হামলায় বিদেশে বসবাসরত চার মার্কিন নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে। ২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ইয়েমেনে পেণাস্ত্র হামলায় মার্কিন নাগরিক আনোয়ার আল আওলাকি মারা যান। দুই সপ্তাহ পরে আরেক হামলায় তার ১৬ বছরের ছেলে (যার জন্ম হয়েছিল ডেট্রোয়টে) নিহত হয়।
বিচার বিভাগের ২০১৩ সালের এপ্রিলের একটি ফাঁস হওয়া মেমোতে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের আইনগত ব্যাখ্যা দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এতে বলা হয়, মার্কিন নাগরিকেরা যদি অবশম্ভাবী হুমকি বিবেচিত হয়, তবে তাদের হত্যা করার অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। এতে আরো বলা হয়, মার্কিন কোনো নাগরিকের ওপর হামলা চালানোর জন্য এমন কোনো প্রমাণের প্রয়োজন নেই যে ওই লোক শিগগিরই হামলা চালাচ্ছে। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের জামিল জাফর মেমোটিকে ‘শীতল নথি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
পরের মাসে প্রেসিডেন্ট ওবামা বক্তৃতায় ড্রোন হামলা এবং বিশেষ বাহিনীর টার্গেট নির্ধারণের নিয়ম-নীতি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রচার করেন।
এতে তিনি ড্রোনের ব্যবহার সীমিত করার কথা বলেন। ওবামা বলেন, ‘বেসামরিক লোকদের শাস্তি’ দিতে নয়, বরং যারা ‘অব্যাহতভাবে এবং শিগগিরই’ মার্কিন স্বার্থের প্রতি হুমকি তাদের ওপরই হামলা চালানো যাবে। ওবামা স্বীকার করেন, ড্রোন হামলায় বেসামরিক লোক নিহত হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ যারা মারা যাচ্ছে তারা আমরা যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন আমাকে এবং আমার চেইন অব কমান্ডকে তাড়া করে ফিরবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যেকোনো হামলার আগে প্রায় নিশ্চিত করতে হবে যে এতে কোনো বেসামরিক লোক হতাহত হবে না। আমাদেরকে এমন সর্বোচ্চ মান নির্ধারণ করতে হবে।’
কিন্তু প্রেসিডেন্টের ওই ভাষণের ছয় মাস পরে ব্যুরোর বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, পাকিস্তান ও ইয়েমেনে ছয় মাসে আরো বেশি লোক নিহত হয়েছে। একই সময়ে হতাহতের হারও বেড়েছে।
২০১৩ সালে পাকিস্তানে বেসামরিক লোকের মৃত্যুর নিশ্চিত কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ড্রোন হামলা শুরুর পর এ ধরনের ঘটনা এটাই প্রথম ঘটল। কিন্তু ইয়েমেনে বছরটা হয় বেসামরিক লোকের ব্যাপক প্রাণহানিকর। ১২ ডিসেম্বর জেএসওসি’র ড্রোন হামলা চালায় একটি বরযাত্রী দলের গাড়িবহরে। এতে বেশ কয়েকটি গাড়ি ধবংস হয়, গোলার আঘাতে ১৫ জনের মতো নিহত হয়। এক বছরের মধ্যে একক কোনো হামলায় সবচেয়ে বেশি বেসামরিক প্রাণহানির ঘটনা এটা। ইয়েমেনি সরকার প্রথমে বলেছিল, আল-কায়েদা জঙ্গিরা নিহত হয়েছে। কিন্তু এর পরপরই ইয়েমেনি সরকার হতাহতের শিকার পরিবারগুলোর সাথে আলোচনা শুরু করে দেয়। সরকার তাদের জন্য এক লাখ ৪০ হাজার ডলার এবং ১০০টা রাইফেল পাঠায়। যুক্তরাষ্ট্র এই হামলার ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেনি। তবে নজিরবিহীনভাবে এ ব্যাপারে একটি তদন্ত চালাচ্ছে।
জ্যাক সার্লে, অনুবাদ : হাসান শরীফ (ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন জার্নালিজম থেকে)