বিটিআরসির হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে না ক্ষমতাসীনদের পরিবার

BTRCনানকের স্ত্রী ও মেয়ের কাছে পাওনা ৭০ কোটি টাকা। আবুল হোসেনের মেয়ের কাছে পাওনা ৯০ কোটি টাকা
সমীর কুমার দে
সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে আটকে রয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) প্রায় হাজার কোটি টাকা। বারবার তাগাদা দেয়ার পরও তারা টাকা পরিশোধ করছেন না। এমন পরিস্থিতিতে টাকা তো দিচ্ছেনই না, সেই সঙ্গে বিটিআরসির দেয়া শর্ত ভঙ্গের কারণে চারটি আন্তর্জাতিক গেটওয়ে অপারেটরের (আইজিডব্লিউ) কল আদান-প্রদান স্থগিত করেছে বিটিআরসি। গত রবিবার তিনটি প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিয়ে কল বন্ধ করা হয়। এর মধ্যে দু’টি অপারেটর চিঠি পাওয়ার পর কিছু টাকা পরিশোধ করেছে। আর কখনও শর্ত ভঙ্গ হবে না এমন আশ্বাস দেয়ার পর আরো কিছু শর্তের মধ্যে রেখে তাদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেছে বিটিআরসি। এর আগে আর একটি প্রতিষ্ঠানের কল আদান-প্রদান স্থগিত করা হয়। যদিও সোমবার সেটি খুলে দেয়া হয়েছে।
বিটিআরসির ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড অপারেশন বিভাগের উপ-পরিচালক মো. মেজবাউজ্জামানের স্বাক্ষর করা চিঠিতে চারটি অপারেটরের কল আদান-প্রদান স্থগিত করা হয়। বিটিআরসি সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক গেটওয়ে রাতুল টেলিকমের কাছে পাওনা ৭০ কোটি টাকারও বেশি। এই প্রতিষ্ঠানের ৫০ শতাংশের মালিক স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের মেয়ে সৈয়দা আমরিন রাখি। আরো ২০ শতাংশের মালিক নানকের স্ত্রী সৈয়দা আরজুমান বানু। গত দুই প্রান্তিকে অর্থাত্ জানুয়ারি থেকে তারা রেভিনিউ শেয়ারিং হিসেবে বিটিআরসিকে কোন টাকা দেয়নি। এমন পরিস্থিতিতে তাদের চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয় তারা মাসে ১০ লাখ মিনিটের বেশি কল আনা-নেয়া করতে পারবে না। কিন্তু তারা বিটিআরসির আদেশ না মেনে বেশি কল আনা-নেয়া করেছে। ফলে গত রবিবার থেকে তাদের কল আদান-প্রদান স্থগিত করে বিটিআরসি। গতকাল তারা এ বিষয়ে আর শর্ত ভঙ্গ হবে না এমন আশ্বাস দেয়ার পর তাদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের মেয়ের কোম্পানি ক্লাউড টেলের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ভিশন টেল লিমিটেড। গত জুন পর্যন্ত ভিশন টেলের কাছে বিটিআরসি’র পাওনা ৯০ কোটি টাকা। এ কারণে মাসে ১০ লাখ মিনিটের বেশি কল আনা-নেয়া করতে পারবে না বলে তাদের চিঠি দেয় বিটিআরসি। কিন্তু তারা বিটিআরসির আদেশ না মেনে বেশি কল আনা-নেয়া করেছে। এ কারণে রবিবার তাদের সব ধরনের কল আদান-প্রদান স্থগিত করে বিটিআরসি। তারা এখনও টাকাও দেয়নি এবং শর্ত ভঙ্গ করবে না এমন আশ্বাসও দেয়নি। ফলে তাদের স্থগিতাদেশ বাতিলও হয়নি। যদিও আবুল হোসেন এর আগে সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন তার মেয়ে ভিশন টেলের মালিকানা ছেড়ে দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি পাওনা রাষ্ট্রীয় টেলিফোন কোম্পানি বিটিসিএলের কাছে। তাদের কাছে বকেয়া শত কোটি টাকার উপরে। যদিও এই টাকা নিয়ে বেশি চিন্তিত নয় বিটিআরসি।
বিটিআরসির চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছেই বিপুল পরিমাণ টাকা পাওনা রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি প্রতিষ্ঠান গত দুই প্রান্তিকে অর্থাত্ এ বছর কোন টাকাই দেয়নি। এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়া হয়, তারা মাসে ১০ লাখ মিনিটের বেশি কল আনা-নেয়া করতে পারবে না। ৬টি প্রতিষ্ঠান বিটিআরসির এই নির্দেশনা মানলেও ৪টি প্রতিষ্ঠান মানেনি। তাদের কল আদান-প্রদান স্থগিত করা হয়েছে। এর মধ্যে কিছু টাকা দিয়ে এবং আর শর্ত করবে না এমন আশ্বাসের পর ৩টি প্রতিষ্ঠানকে আরো কিছু শর্তের মধ্যে রেখে কল আদান-প্রদান চালু করা হয়েছে।
নিয়ম অনুসারে প্রতি মিনিটের আন্তর্জাতিক টেলিফোন কল আসার ক্ষেত্রে তিন সেন্ট করে পায় অপারেটর। পরে তার ৫১ দশমিক ৭৫ শতাংশ দিতে হয় সরকার তথা বিটিআরসিকে। এই টাকা জমতে জমতেই একেকটি কোম্পানির কাছে প্রায় শত কোটি টাকা পাওনা হয়েছে। লাইসেন্সের নীতিমালা অনুসারে একেকটি আইজিডব্লিউ’র বার্ষিক লাইসেন্স ফি সাড়ে ৭ কোটি টাকা। এই লাইসেন্স ফিও দিচ্ছে না প্রভাবশালী এসব কোম্পানি। সব মিলে ২৯টি আইজিডব্লিউ’র মধ্যে লাইসেন্স ফি দিয়েছে মাত্র পাঁচটি কোম্পানি। এখানেও কোম্পানিগুলো প্রায় ১৫০ কোটি টাকা বাকি ফেলেছে।
কল স্থগিত করা অপর দু’টি প্রতিষ্ঠানের হল- ডিজিকম টেলিকম ও কে টেলিকমিউনিকেশন লিমিটেড। ডিজিকম টেলিকমের কাছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা পাওনা থাকায় তাদের কল আদান-প্রদান আগেই স্থগিত করা হয়। গত মার্চ পর্যন্ত পাওনা পরিশোধের পর গতকাল তাদের কল আদান-প্রদান চালু করা হয়েছে। আর কে টেলিকমের অন্যতম মালিক আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান। তারাও গত মার্চ পর্যন্ত পাওনা পরিশোধ করেছেন। পাওনা দেয়ার পরও কেন তাদের কল আদান-প্রদান বন্ধ করা হল তা জানতে তিনি গতকাল বিটিআরসি চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোসের সঙ্গে দেখা করেন। এরপর তিনি ইত্তেফাককে বলেন, মাত্র তিন কোটি টাকা বকেয়া ছিল। তাও দিয়ে দিয়েছি। তারপরও তাদেরটি স্থগিত করা হয়। তিনি বলেন, এই লাইসেন্স নিয়ে কোন ষড়যন্ত্র হলে তিনি এই ব্যবসা করবেন না। তবে বিটিআরসি চেয়ারম্যান ভুল বুঝতে পেরেছেন বলে তিনি জানান। তাই গতকাল সোমবার সন্ধ্যার মধ্যেই তাদের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে বিটিআরসি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর মতে, সরকারের শেষ সময়ে এসে রাজনৈতিক বিবেচনায় পাওয়া এসব লাইসেন্সের মালিকরা বিটিআরসিকে টাকা দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তিন সেন্টে কল আনার কথা থাকলেও শুধু প্রতিযোগিতার কারণে দেড় সেন্টে বা তার চেয়েও কমে কল আনছে কোনো কোনো কোম্পানি। আর কল এনে এর পুরো টাকাই রেখে দিচ্ছে নিজের পকেটে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগে যখন ৪টি লাইসেন্স ছিল তখন যে কল এসেছিল এখন ২৯টি লাইসেন্স দেয়ার পরও কল বাড়েনি। ফলে বাড়েনি সরকারের কোন রাজস্বও। এক হিসেবে দেখা গেছে, ২০১১ সালের জানুয়ারিতে যখন ৪টি লাইসেন্স ছিল তখন কল এসেছে ১৩৫ কোটি মিনিট। ২০১২ সালে এই সময় এর পরিমাণ ছিল ১৪৩ কোটি মিনিট। তখনও লাইসেন্স ছিল ৪টি। আর ২৯টি লাইসেন্স দেয়ার পর এবার জানুয়ারিতে কল এসেছে ১৩২ কোটি মিনিট। একইভাবে ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে কল এসেছে ১২২ কোটি মিনিট। ২০১২ সালের এ মাসে ১২৪ কোটি মিনিট। আর ২৯টি লাইসেন্স দেয়ার পর ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসেছে ১২৫ কোটি মিনিট। গত মার্চে কল এসেছে ১৩১ কোটি মিনিট। আর ৪টি লাইসেন্সের সময় গত বছরের মার্চে এসেছিল ১২৪ কোটি মিনিট। আর ২০১১ সালের মার্চে এসেছিল ১৩২ কোটি মিনিট।
বিটিআরসির সূত্র জানিয়েছে, মহাজোটের অন্যতম শরিক জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী জিয়াউদ্দিন বাবলুর কোম্পানি ফাস্ট কমিউনিকেশন্স লিমিটেড। এই কোম্পানির কাছে বিটিআরসি’র পাওনা ছিল প্রায় ৪০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অবশ্য কিছু টাকা তারা পরিশোধ করেছেন। টেলেক্স লিমিটেডের কাছেও বিটিআরসি’র পাওনা প্রায় সমান। এটি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের কোম্পানি। প্রথমে তার নামে লাইসেন্স না হলেও পরে কোম্পানিটি কিনে নেন তিনি। সম্প্রতি তিনিও অল্প কিছু টাকা পরিশোধ করেছেন। প্রধামন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভীর দুই ছেলে এবং ছেলে বউদের নামে নেয়া হয়েছে ওয়ান এশিয়া অ্যালায়েন্স ্র গেটওয়ের লাইসেন্স। এই কোম্পানির কাছেও পাওনা প্রায় একই। এরাও অবশ্য কিছু টাকা পরিশোধ করেছে। অবৈধ কল টার্মিনেশনের জন্য বিটিআরসি এই তিনটি কোম্পানিটির সকল সংযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। পরে আবার চালু করা হয়।
বিটিআরসির একজন কর্মকর্তা জানান, ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে সব প্রতিষ্ঠানের জুন পর্যন্ত পাওনা পরিশোধ করার কথা। কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠানই জুন পর্যন্ত পাওনা পরিশোধ করেনি। অর্ধেক প্রতিষ্ঠান মার্চ পর্যন্ত পাওনা পরিশোধ করেছে। আর ৫/৬টি প্রতিষ্ঠান এ বছর কোন টাকাই দেয়নি। বিটিআরসি’র হিসেব বলছে, ডিসেম্বরের শেষে তাদের পাওনা পরিমাণ ছিল ৩৭৭ কোটি টাকা। মার্চের শেষে এটি বেড়ে যায় ৫৩৩ কোটিতে। আর জুনের শেষে তা দাঁড়ায় ৯৪৭ কোটিতে। আর এই জুলাই মাসের পাওনা ধরলে ১১শ’ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। তবে এর মধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কিছু টাকা পরিশোধ করেছে। তারপরও বিটিআরসির পাওনা হাজার কোটি টাকার কম হবে না।
নিজের দলের লোকদের কাছে সরকারের এই বিপুল পরিমাণ টাকা বাকি থাকা প্রসঙ্গে কয়েকদিন আগে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী এডভোকেট সাহারা খাতুন বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে আমরাও চিন্তা করছি। দেখা যাক কি করা যায়।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button