নির্বাচনী ফলাফলের পূর্বাভাস : সজীব ওয়াজেদ জয় কি ‘জরিপ’কে ‘তথ্য’ বলছেন?

মোবায়েদুর রহমান : গত কয়েকদিনে কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে। প্রতিটি ঘটনাই স্বতন্ত্রভাবে আলোচনার দাবিদার। তবে সময় এবং স্থানের অভাবে আলাদা আলাদা করে প্রত্যেকটি বিষয়ের ওপর আলোচনা করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই মূল বক্তব্য ঠিক রেখে প্রতিটি বিষয়ের ওপরই সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনার ইচ্ছে আছে।
প্রথমেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের দুটি মন্তব্য। জয় আমেরিকা থাকেন। মাঝেই মাঝেই তিনি বাংলাদেশে আসেন। তবে রাজনীতি নিয়ে প্রকাশ্যে এই সাড়ে ৪ বছরে তিনি কোন কথা বলেননি। এবার এই রমজান মাসে সর্বপ্রথম তিনি রাজনীতি সম্পর্কে কিছু কথা বললেন। সেটা বলেছেন প্রকাশ্যে এবং একটি ইফতার মাহফিলে। যুবলীগ এই ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছিলো। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য বিজয় এবং ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত শেখ হাসিনার জনসমাবেশে সংঘটিত গ্রেনেড হামলার ওপর তিনি স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন। তার এ বক্তব্য সবকটি টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত হয়েছে এবং সমস্ত পত্রিকায় ব্যাপক কাভারেজ পেয়েছে। এটি স্বাভাবিক। কারণ তিনি প্রধানমন্ত্রীর একমাত্র পুত্র। তার এই বক্তব্যের সূত্র ধরে বোধগম্য কারণেই বিপুল জল্পনা কল্পনার সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই ভাবছেন, এটি কি তার রাজনীতিতে প্রবেশের পদধ্বনি? তাদের ভাবনা এরকম যে, বাংলাদেশে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের প্রধান দুই নেত্রীর পুত্ররা এবার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হতে যাচ্ছেন। বেগম জিয়ার পুত্র তারেক রহমান ১২-১৪ বছর আগেই রাজনীতিতে এসেছেন। বিএনপি তাকে দেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গ্রুম (তৈরি) করছে। শেখ হাসিনা এবং বেগম জিয়া উভয়েই ৬৫-এর কোটা অতিক্রম করেছেন। তাই এখন তারা উত্তরসূরি রেখে যেতে চান। তারেক তো আগেই রাজনীতিতে এসেছেন। এখন মি. জয়ও রাজনীতিতে পদার্পণ করছেন। আজকের কোন একটি পত্রিকায় দেখলাম, জয়ের বয়স ৪২। পক্ষান্তরে তারেক রহমানের বয়স তার বেশি। কতো বেশি তা সঠিক বলতে পারবো না। তাদের রাজনীতিতে প্রবেশ এবং ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হওয়াকে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির ভিত্তি পোক্ত হওয়া বলে মনে করা হচ্ছে।
॥ দুই ॥
আমি অবশ্য ব্যাপারটিকে সেভাবে দেখতে চাই না। তারেক এবং জয় দুজনেই বাংলাদেশের নাগরিক। দুজনেই যথেষ্ট পরিপক্ব। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে অবশ্যই তাদের রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। যদি তারা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠেন এবং শীর্ষ নেতৃত্বে পৌঁছেন তাহলে কারও কিছু বলার থাকতে পারে না। তবে তাদের নেতৃত্ব যদি ওপর থেকে চাপিয়ে দেয়া হয় তাহলেই যতো প্রশ্ন ওঠে। পন্ডিত নেহেরুর কন্যা ইন্দিরা গান্ধী, ইন্দিরার পুত্র সঞ্জয় এবং রাজীব এবং রাজীবের পুত্র রাহুল। অন্যদিকে রাজীবের স্ত্রী সোনিয়া। ইন্দিরা গান্ধী নেহেরুর কন্যা হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতির প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নেতৃত্বে উঠে এসেছেন, যদিও তার মাথার ওপর সবসময় পিতা নেহরুর একটা হাত ছিলো। ইন্দিরার পুত্র সঞ্জয়ও রাজনীতির প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু মাঝপথে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ায় তার ভাই রাজীবকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রী করা হয়। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগ মুহূর্তেও তিনি বোয়িং বিমানের পাইলট ছিলেন। তাই বলা যায় যে, সঞ্জয় গান্ধীর নেতৃত্বে আরোহন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হলেও রাজীব গান্ধীকে একেবারে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
কিন্তু সোনিয়া গান্ধী এবং রাহুল গান্ধীর কথা আলাদা। সোনিয়া গান্ধীকে কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য কংগ্রেসের সমগ্র নির্বাহী কমিটি অনুরোধ করলেও প্রথম পর্যায়ে সোনিয়া সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। তখন তার সন্তানরা অর্থাৎ রাহুল গান্ধী এবং প্রিয়াংকা গান্ধী ছোট ছিলো। তাই বেশ কয়েক বছর পর তার ছেলে-মেয়েরা যখন বড় হয় তখন সোনিয়া গান্ধী রাজনীতিতে আসেন। রাজীব গান্ধীকে গতবারও ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে বলা হয়েছিলো। রাজীব গান্ধী নিজ থেকেই সেই অফার বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি তখনও মনে করতেন যে, নেতৃত্ব গ্রহণের আগে রাজনীতিতে কিছুটা অভিজ্ঞতা এবং কিছুটা প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়। তিনি রাজনীতির শিক্ষানবিশ পর্যায়ে রয়েছেন। কংগ্রেসের মতো বড় দলের নেতৃত্ব গ্রহণ অথবা ভারতের মতো বিশাল দেশের কান্ডারি হওয়ার জন্য তার সেই অভিজ্ঞতা এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। এখন আগামী নির্বাচনের পর যদি কংগ্রেস বিজয়ী হয় তাহলে রাহুল গান্ধী ভারতের রাষ্ট্র তরণীর হাল ধরবেন কিনা সেটি আগামী দিনই বলে দেবে।
বেনজির ভূট্টো পিপলস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর কন্যা। এই পরিবারটির ওপর দিয়ে বিপদ-আপদের মারাত্মক ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে গেছে। একটি হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে তার পিতা জুলফিকার আলী ভূট্টোকে ফাঁসির রজ্জুতে হত্যা করা হয়েছে। বেনজিরের এক ভাই শাহনেওয়াজ ভূট্টোর লাশ প্যারিসের একটি হোটেলে পাওয়া গেছে। শাহনেওয়াজের মৃত্যু অথবা হত্যার রহস্য আজও উৎঘাটিত হয়নি। বেনজিরের আরেক ভাই মুর্তজা ভূট্টো করাচিতে অজ্ঞাতনামা বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন। তার পিতাকে ফাঁসি দেয়ার পর অত্যন্ত কম বয়সে বেনজির ভূট্টো তার পিতার প্রতিষ্ঠিত পিপলস পার্টির হাল ধরতে বাধ্য হন। জুলফিকার আলী ভূট্টোর কন্যা হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যেমেই তিনি পিপলস পার্টির নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন এবং দুইবার নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। সুতরাং নেহেরু পরিবার বা ভূট্টো পরিবার যাদের কথাই বলা হোক না কেন, ওরা সকলেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনীতির মাধ্যমে জনগণের ভোটে নির্বাচনে জয়লাভ করেন এবং ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
ফিরে আসছি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। কোন পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়াকে নিজ নিজ দলের হাল ধরতে হয়েছিলো, সেটি বাংলাদেশের সব মানুষই জানেন। একজনের পিতা আর আরেকজনের স্বামী সামরিক বাহিনীর অফিসারদের দ্বারা নিহত হন। স্বামী অথবা পিতার আকস্মিক হত্যাকান্ডে তাদেরকে দলের নেতৃত্বে দলীয় নেতাকর্মীরাই বসান। উভয় নেত্রীই জনগণের কাছে যান এবং নিজ নিজ দলকে নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী করে প্রধানমন্ত্রী হন। পারিবারিকভাবে একজন শেখ মুজিবের কন্যা এবং আরেকজন জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হওয়ায় পরিবার তন্ত্রের গন্ধ থাকলেও তারা দুজনেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসেছেন। প্রশ্ন উঠেছে তাদের ছেলেদেরকে নিয়ে। তারেক রহমান তো এক যুগেরও বেশি সময় ধরে রাজনীতি করছেন। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হওয়া তো দূরের কথা, তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য বা এমপিও হননি। শুধু দলই করে গেছেন। অন্যদিকে সজীব ওয়াজেদ জয় সেদিন রাজনীতিতে হাতেখড়ি নিলেন। আওয়ামী লীগ যদি পুনর্বার বিজয়ী হয় তাহলেও জয় প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন না। তার মাতাই প্রধানমন্ত্রী থেকে যাবেন, যদি আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। আর যদি বিএনপি বিজয়ী হয় তাহলেও খালেদা জিয়াই প্রধানমন্ত্রী হবেন। তবে পুরো ৫ বছর তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, নাকি মাঝপথে তারেক রহমানকে জায়গা করে দেবেন, সেটি একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারে।
॥ তিন ॥
এখন জয়ের রাজনৈতিক বক্তৃতার প্রসঙ্গ। এটিকে তার Maiden Political Speech বা প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য বলে বিবেচনা করা যায়। বেগম জিয়ার ইঙ্গিতে শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সমাবেশে পরিকল্পনা করেছেন তারেক- এমন সরাসরি অভিযোগ করেছেন সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি একজন সুশিক্ষিত মানুষ। সেজন্যই তার কাছে প্রশ্ন করতে চাই যে, আওয়ামী লীগ তো সাড়ে ৪ বছর হলো ক্ষমতায় আছে। এই সাড়ে ৪ বছরে ঐ গ্রেনেড হামলা-মামলার বিচার চূড়ান্ত হওয়ার কথা। কিন্তু সেটি হয়নি। তাদের হাতে সময় আছে আর মাত্র ৬ মাস। এই ৬ মাসে তারা যদি বিচার শেষ করতে পারেন তাহলে ভালো কথা। কিন্তু বিচার শেষ হওয়ার আগে কাউকে দোষী করা যায় না। খালেদা জিয়ার ইঙ্গিতে তারেক রহমান পরিকল্পনা করেছেন- এই উক্তির মাধ্যমে দুজন আসামি হয়ে যান। কিন্তু বিচারে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে বলা যায় না যে, তারা মা-ছেলে মিলে এই কাজটি করেছেন। জয়ের মাতা এখন প্রধানমন্ত্রী। তারেকের মাতা ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী। আইনের এই দিকগুলো তারেক এবং সজীব উভয়েরই জানার কথা। তারপরেও শিক্ষিত লোকদের এই ধরনের উক্তি না করাই ভালো। না করলে একটি সুস্থ ও শুদ্ধ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।
এবার আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় প্রসঙ্গ। নির্বাচনে জয়-পরাজয় তো রয়েছেই। এখন দেশে ক্রিয়াশীল রয়েছে দুটি রাজনৈতিক জোট। একটি বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। আরেকটি হলো শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় মহাজোট। কে জিতবে আর কে হারবে সে সম্পর্কে জোট নেতাদের কারও কাছেই আগাম তথ্য থাকার কথা নয়। এজন্যই সজীব ওয়াজেদ জয় যখন বলেন যে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অবশ্যই জিতবে, এ বিষয়ে তার কাছে ‘তথ্য’ আছে তখন মি. জয়ের এই উক্তিটি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। নির্বাচনের আগে কারো কাছে জয়-পরাজয় সম্পর্কে কোন ‘তথ্য’ থাকতে পারে না। কোন ‘সংখ্যাও’ থাকতে পারে না। তথ্য বা সংখ্যা থাকবে ইলেকশনের পর। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে যে, শব্দ চয়নে জয়ের বিভ্রাট ঘটেছে। আমার ধারণা, তিনি হয়তো নির্বাচনী পূর্বাভাস জানার জন্য কোন প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে নির্বাচনী ফলাফল সম্পর্কে আগাম ‘জরিপ’ করেছেন। এই জরিপকেই তিনি সম্ভবত বলছেন তথ্য বা সংখ্যা। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে সজীব ওয়াজেদের জন্য যেটা প্রয়োজন সেটা হলো ‘তথ্য’ বা ‘সংখ্যা’ শব্দ দুটি সংশোধন করে ‘জরিপ’ রিপোর্ট বলা। তাহলে এটি নিয়ে আর কোন বিভ্রাট বা বিভ্রান্তি থাকবে না। আর সেটা করলে বিএনপির অভিযোগ, অর্থাৎ নির্বাচনে কারচুপি করা এবং সে সম্পর্কিত নীলনকশা প্রণয়ন করার অভিযোগ হালকা হয়ে যাবে। আমার মনে হয়, জাতীয় রাজনীতিতে সম্পূর্ণ নবাগত বলে সজীব ওয়াজেদ জয় রাজনীতির সঠিক পরিভাষা রপ্ত করতে পারেননি।
আজ আর স্থান সংকুলান হচ্ছে না। তাই অন্য দুটি টপিক বারান্তরে আলোচনার ইচ্ছা রইলো।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button