মিসরে সেনা অভ্যুত্থানের অন্তরালে
মাসুমুর রহমান খলিলী: মিসরের ইতিহাসে সর্বজন স্বীকৃত প্রথম অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনে বিজয়ী প্রেসিডেন্ট মুরসিকে সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ যৌথ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। অভ্যুত্থানের পর প্রেসিডেন্ট মুরসিকে আটক করে রাখা হয়েছে অজ্ঞাতস্থানে। আর মুসলিম ব্রাদারহুডের শীর্ষ ৩০০ নেতার বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা। তাদের অনেককে ইতোমধ্যে গ্রেফতারও করা হয়েছে। মুসলিম ব্রাদারহুড সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নির্বাচিত সরকার উৎখাতকে মেনে নেয়নি। এর বিরুদ্ধে সারা মিসরে বিক্ষোভ প্রতিবাদের ডাক দিয়েছে। বিক্ষোভে সেনাবাহিনীর গুলিতে এক দিনে ৩০ জনের বেশি মারা গেছে। হোসনি মোবারকের পতনের পর মিসর সবচেয়ে বড় সঙ্কটকাল অতিক্রম করছে এখন। সেনাবাহিনীকে অভ্যুত্থানের জন্য যারা প্ররোচিত করেছিল তাদের ধারণা ছিল ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে দমন অভিযান চালানো হলে অতীতের মতো তারা সব কিছু মেনে নেবে। কিন্তু এবার নির্বাচিত সরকার উৎখাতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ফলে মিসরের সঙ্কট বড় রকমের অনিশ্চয়তার দিকে যাওয়া শুরু করেছে। বহু দশকের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণবিপ্লবের পর নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতে আফ্রিকান ইউনিয়ন ও তুরস্ক ছাড়া আর কেউ সেভাবে প্রতিবাদ জানায়নি। সৌদি আরব ও সিরিয়া অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানিয়ে ‘সেনাচার’ সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ব্রিটেন ও জার্মানির প্রতিক্রিয়ায় সেনা অভ্যুত্থানকে অভিনন্দন জানানো না হলেও দ্রুত নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানানোর মাধ্যমে তারা এই প্রক্রিয়াকে প্রকারান্তরে সমর্থন জানিয়েছে। মিসরে এবার ভেতর থেকে অভ্যুত্থানে সব ধরনের ইন্ধন দিলেও প্রকাশ্য স্বাগত জানানো থেকে বিরত থেকেছে ইসরাইল। মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থিত নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ড. মুরসির সরকার মিসরের সঙ্কট নিরসনে ব্যর্থ বলে উল্লেখ করে এই সরকারের বিরুদ্ধে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানানো হচ্ছে। এসব প্রতিবাদের পেছনে অভ্যন্তরীণ কারণের চেয়েও আন্তর্জাতিক মহলের ইন্ধনটিই ছিল অনেক বড় বিষয়। ২৫ জানুয়ারির বিপ্লবের পর যে সংসদ নির্বাচন মিসরে অনুষ্ঠিত হয় তাতে ৪৭ শতাংশ আসন লাভ করেছিল ব্রাদারহুড। এর বাইরে সালাফিরা পেয়েছিল ২৪ শতাংশের মতো আসন। উদারপন্থী ও সেক্যুলারিস্টরা সম্মিলিতভাবে আসন পায় ২৫ শতাংশের চেয়ে কম। পরবর্তী সময়ে সংসদের যে উচ্চকক্ষ বা শূরা কাউন্সিল গঠন করা হয় তাতেও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব ছিল এ রকমই। এর সাথে কিছুটা ভারসাম্য এনে সংবিধান প্রণয়নের গণপরিষদ গঠন ও পুনর্গঠন করা হয়। মিসরে বিপ্লব-পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের পর পরই মুসলিম ব্রাদারহুড যাতে ক্ষমতায় যেতে বা থাকতে না পারে তার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এর আগে মোবারকের পতনের পর নির্বাচন অনুষ্ঠানে বিলম্ব করা হয় যেন মানুষ আগের সরকারের স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ড ভুলে যায়। এ ক্ষেত্রে মোবারকোত্তর জেনারেল হোসেন তানতাবির নেতৃত্বে সেনা সরকার এক দিকে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠায় বিলম্ব করে অন্য দিকে সুশাসন প্রতিষ্ঠা তথা জনগণের মূল সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ না নিয়ে মানুষকে বিপ্লবের ব্যাপারে ুব্ধ করে তোলার চেষ্টা করা হয়। এ সময় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বিস্তারের চেষ্টাও লক্ষ করা যায়। এরপরও শেষ পর্যন্ত যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে ইসলামপন্থীরা নিরঙ্কুশভাবে জয়লাভ করে। নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের বিজয়ের পরপরই মোবারক আমলে নিযুক্ত বিচারকদের সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করে ইসলামিস্টদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নেয়ার কথা জানায় এবং বলে তারা ইসলামপন্থীদের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকবে না। এর অংশ হিসেবে সাংবিধানিক আদালত মিসরে প্রথমবারের মতো স্বীকৃত অবাধ নির্বাচনে গঠিত সংসদকে বাতিল ঘোষণা করে। এটি করা হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাত্র কয়েক দিন আগে। এরপর দুই পর্বের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মুসলিম ব্রাদারহুডের রাজনৈতিক শাখা ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিজ পার্টির প্রার্থী হিসেবে ড. মোহাম্মদ মুরসি বিজয়ী হলেও তার ক্ষমতা গ্রহণের পথে বাধা সৃষ্টি করা হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতা নেন কিন্তু সেনা নেতৃত্বের সাথে এ জন্য একটি সমঝোতায় আসতে হয়। এ সমঝোতার অংশ হিসেবে তিনি যে সরকার গঠন করেন তাতে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ ছিল না তার। নতুন মন্ত্রিসভায় দুই-একজন ছাড়া প্রধানমন্ত্রীসহ বাকি সবাই ছিলেন ব্রাদারহুডের বাইরের ব্যক্তি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ছিল সরাসরি সেনাবাহিনী পরিচালিত। পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মুরসির সিদ্ধান্ত সেভাবে কার্যকর ছিল না। অর্থ মন্ত্রণালয়েও পুরোপুরি কর্তৃত্ব ছিল না মুরসির। প্রসিকিউটর জেনারেল পদে পরিবর্তনকে বারবার বাধাগ্রস্ত করা হয়। এ ক্ষেত্রে এক হয়ে কাজ করে মিসরের উচ্চতর বিচার বিভাগ ও সেনা নেতৃত্ব। সাংবিধানিক আদালত সংসদের নিম্নকক্ষ বাতিলের পর উচ্চকক্ষ শূরা কাউন্সিল ও সংবিধান পরিষদ বাতিল করে। এরপর কার্যত মুরসির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকেই বাতিল করতে যাচ্ছিল। ঠিক সে সময় ড. মুরসি ডিক্রি জারি করে ক্ষমতাকে নিজের হাতে নিয়েছিলেন, যাতে বিচার বিভাগ সংবিধান পরিষদ ও শূরা কাউন্সিলকে বাতিল করতে না পারে। মুরসির এই ক্ষমতা গ্রহণকে স্বৈরাচারের কর্তৃত্ব গ্রহণ হিসেবে দেখিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করা হয়। শেষ পর্যন্ত শূরা কাউন্সিল ও সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার বিনিময়ে গৃহীত ক্ষমতা মুরসি পরিত্যাগ করেন আরেক ডিক্রি জারি করে। রেফারেন্ডামে সংবিধান অনুমোদন হওয়ার পর তা কার্যকর করার জন্য সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হলে আবার বাধার সৃষ্টি করা হয়। শেষ পর্যন্ত সংসদ নির্বাচন আর অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। মুরসির নির্বাচনের এক বছরের মাথায় তাহরির স্কোয়ারে সমাবেশ করে সেনা অভ্যুত্থানের অজুহাত সৃষ্টি করা হয়। মিসরের পরিস্থিতিকে যারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন তারা জানেন সেখানে অভ্যন্তরীণ জনমত মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করেনি। ইসলামিস্টদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার বাইরের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজটিই শুধু সম্পন্ন করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক শক্তি একসাথে কাজ করেছে। এতে ভূমিকা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী পশ্চিমা দেশগুলোর, ভূমিকা ছিল উপসাগরীয় আরব নেতৃবৃন্দের, প্রতিবেশী ইসরাইল ও সিরিয়ার। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর মধ্যে একমাত্র তুরস্ক ছাড়া আর কেউ মিসরে মুরসির নির্বাচিত সরকার টিকে থাকুক তা চায়নি। মুসলিম ব্রাদারহুডের মিসরের মতো দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে পশ্চিমা ও আরব দেশগুলোর রিজার্ভেশনের বিষয়টি দলের নেতাদের অজানা ছিল না। এ কারণে তাহরির স্কয়ারের আন্দোলনে ব্রাদারহুড অংশ নিলেও নেতৃত্বে যাওয়ার চেষ্টা সচেতনভাবে করেনি। বিপ্লবোত্তর সংসদ নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে প্রার্থী না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল, এমনকি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও প্রার্থী না দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিল মুসলিম ব্রাদারহুড। পরে সে ঘোষণা থেকে তারা সরে আসে। শেষ পর্যন্ত মিসরের অভ্যন্তরীণ জনমত নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড় অংশের এই রিজার্ভেশনই ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের আয়োজনকে চূড়ান্ত করতে সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের সামনে একটি নীতিগত প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়। সেটি ছিল মধ্যপ্রাচ্য বা মুসলিম দেশগুলোর জন্য গণতন্ত্র না উদারনৈতিকতা বা সেক্যুলারিজম সহায়ক হবে সে বিবেচনা করা। এক সময় মধ্যপ্রাচ্যে গণতন্ত্রের বিকাশের পক্ষে পশ্চিমের নীতিনির্ধারণ পর্যায়ে মত ছিল জোরালো। তাদের হিসাবে ছিল মধ্যপ্রাচ্যে জনগণের মত প্রকাশের সুযোগকে রুদ্ধ করে রাখার কারণে আলকায়েদার মতো জঙ্গি ও চরমপন্থার বিকাশ ঘটছে। কিন্তু আরব জাগরণের পর অনুষ্ঠিত কয়েকটি নির্বাচনে ইসলামিক দলগুলো ভালো করলে বিপরীত ধারা শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর এ ক্ষেত্রে ইসরাইলি লবি জোরালো ভূমিকা পালন করে। মুরসির নির্বাচিত সরকার হটিয়ে আবার মোবারক মার্কা নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নতুন উদ্যোগে পশ্চিমের সমর্থন সৃষ্টি হয়। মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাগরণ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছিল রাজতান্ত্রিক আরব দেশগুলোর জন্য। আলজেরিয়া, মিসর, লিবিয়া, সিরিয়া ও ইয়েমেনের পর বিক্ষোভ দেখা দেয় জর্দান, বাহরাইন ও মরক্কোর মতো দেশেও। এই প্রবণতা আরেকটু বিস্তৃত হলে তা সৌদি আরব, কুয়েত, আমিরাত ও কাতারের মতো স্থিতিশীল দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ কারণে আরব জাগরণের সাফল্যে ছেদ টানার প্রয়োজন অনুভব করেন উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর নেতারাও। তারা চেয়েছিলেন এসব দেশে ব্রাদারহুড ঘরানার সব সংগঠনের তৎপরতা ঘোষণা দিয়ে গুটিয়ে নেয়া হোক। সেটি বাস্তবে হয়েছে মর্মে দেখা যায়নি। এ কারণে বাইরে আরব জাগরণোত্তর সরকারের সাথে উপসাগরীয় সরকারগুলোর যতই সুসম্পর্ক দেখা যাক না কেন বাস্তবে এসব দেশের সরকার মিসর বা তিউনিসিয়ার সরকারকে ব্যর্থ করার জন্য ভূমিকা রেখেছে। মিসরে সেনা অভ্যুত্থানের পর সাংবিধানিক আদালতের যে প্রধান বিচারপতিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বসানো হয়েছে তিনি সৌদি সরকারের আইন উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন ১১ বছর। এ ছাড়া মুরসি ইরানের সাথে মিসরের সম্পর্ককে একেবারে স্বাভাবিক করার উদ্যোগ না নিলেও তিনি শীর্ষ মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে সঙ্ঘাত পরিহার ও সমঝোতার নীতির প্রতি আগ্রহী ছিলেন। এটি উপসাগরীয় দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মিলেনি। এতে শেষ পর্যন্ত মিসরে মুরসির সরকারের পতন ঘটানোর ব্যাপারে আরব নেতারা অন্তরালে হয়ে পড়েন অনেকটা বেপরোয়া। ইসরাইল বরাবরই মুসলিম ব্রাদারহুডকে তার অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে। দেশটির সীমান্তের সাথে লাগোয়া একটি শক্তিশালী দেশের ক্ষমতায় ব্রাদারহুডের বসা ও টিকে থাকাকে সর্বাত্মকভাবে ঠেকাতে চেয়েছে দেশটি। পশ্চিমা লবিকে এ ব্যাপারে সম্মত করা এবং তার নিজস্ব গোয়েন্দা নেটওয়ার্ককে কাজে লাগানোর কাজটি করেছে ইসরাইল। মিসরের অভ্যন্তরীণ উদারপন্থী দলগুলোর কাছে ব্রাদারহুডের সাফল্য তাদের জন্য ক্ষমতা থেকে দীর্ঘমেয়াদি বিচ্ছেদের নামান্তর। মোবারকপন্থী সেক্যুলারিস্ট যারা বহু দশক ধরে ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছে তাদের জন্য মুরসির শাসন ছিল কুইনিন তুল্য। এ ছাড়া মিসরের পুঁজিপতি ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসায়ের বিকাশের জন্য নতুন শাসনকে ইতিবাচক মনে করেননি। ফলে অভ্যন্তরীণ এসব শক্তির মধ্যে এক ধরনের স্বার্থের ঐক্য সৃষ্টি হয়, যা আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতার সাথে এক হয়ে সেনাবাহিনী-বিচার বিভাগের যৌথ অভ্যুত্থানের পথ সৃষ্টি করে। এই অভ্যুত্থানের পর মিসরের ভাগ্যে কী ঘটতে যাচ্ছেÑ বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এর সাথে জড়িত রয়েছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি ও ভবিষ্যৎ। দেশ-মহাদেশের পরবর্তী সংখ্যায় এ ব্যাপারে থাকবে গভীর বিশ্লেষণ।