পাইলটকন্যার খোলা চিঠি
এমএইচ ৩৭০ : যেখানেই থাকো ফিরে এসো
রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে যাওয়া এমএইচ-৩৭০ ফ্লাইট নম্বরের বিমানটি এ মুহূর্তে সারাবিশ্বে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। কিন্তু মানুষ কি পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারছে সেই ২৩৯ জন যাত্রীর ভালোবাসার মানুষের মনের কথা? মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের একজন পাইলট আবদ রহিম হারুনের মেয়ে ডা. নূর নাদিয়ার আবদ রহিমের এ আবেগঘন খোলা চিঠি-
এ লেখাটা লিখতে গিয়ে আমাকে অনেক পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে এমন একটা চিঠি আমার আরও আগে লেখা উচিত ছিল। তাহলে আমার বাবা জানতে পারতেন তাকে নিয়ে কেমন গর্ব করি আমি। সত্যিই তিনি আমার গৌরবের বিশাল অংশজুড়ে ছিলেন। যদিও তার পেশার কারণেই জীবনের অর্ধেকটা সময় আমি পাইনি তাকে। বাবা, তুমি কী জানো আমার বন্ধুদের আমি বলতে লজ্জাই পেতাম যে, আমার বাবা পাইলট? এটা খুব মজার ব্যাপার, আমার বাবা একজন ড্রাইভার এ কথা আমার নতুন বন্ধুদের বলতে খুব মন খারাপ হতো। আমাদের পরিবারটা খুব সাধারণ জীবনযাপন করত। আমি নিজেও কখনও নিজেকে কোনো বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শিশু হিসেবে দেখতে চাইনি। মালয়েশিয়ার এয়ারলাইন্স পরিবারের ছোট্ট একজন সদস্য ছিলাম আমি। মনে পড়ে, খুব ছোটবেলায় অনেকবার উড়োজাহাজে চড়েছি আমি। আমার প্রথম আকাশ ভ্রমণটা ছিল আমার বাবারই সঙ্গে। আর আমার প্রিয় পাইলট ছিলেন কোতা কিনাবালু।
আমার বাবা, স্কুল ছাড়ার পর থেকেই মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের সঙ্গে ছিলেন। অনেকবার আমরা অন্য কোনো বেসরকারি এয়ারলাইন্সে কাজ নিতে বলেছি বাবাকে কিন্তু তিনি শোনেননি। কত প্রস্তাব যে এসেছে তার কাছে! তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনি আসলে তার পরিবারের সঙ্গেই থাকতে চেয়েছেন। আর চেয়েছেন, যেখানেই সম্ভব আমাদের সঙ্গে থাকতে। আমরা দারুণ সব সুবিধা পেতে পারতাম। আন্তর্জাতিক স্কুলে পড়তে পারতাম, আমাদের সব ট্যাক্স কোম্পানিই পরিশোধ করে দিত। আমরা এমনকি একজন শোফার পেতাম যে গাড়ি চালিয়ে আমাদের এখানে-ওখানে নিয়ে যেত। এসবই হতে পারত যদি বাবা বেসরকারি কোথাও কাজ নিতেন, সরকারি পাইলটদের সম্মান ঠিক এতটাই ছিল। তুমি যদি কোনো পাইলটের মেয়ে হও মনে রাখবে- তোমাকে কিন্তু সবখানে একা যেতে হবে। স্কুলের সেই প্রথমদিন, রেজাল্ট কিংবা খেলার পুরস্কার বিতরণীর দিন, জন্মদিনের দিন। এমনকি, হতে পারে ঈদের দিনটিও তোমাকে কাটাতে হতে পারে বাবাকে ছাড়া।
মনে পড়ে আরেক দিনের কথা। কলেজে ইংরেজি টিচার একে একে সবাইকে জিজ্ঞেস করছিলেন বাবাকে নিয়ে কোন স্মৃতিটা তোমাদের সবচেয়ে মনে পড়ে? যখন আমার পালা এল আমি দাঁড়িয়ে বললাম, আমার শুধু এটাই মনে পড়ে, জীবনের অর্ধেকটা সময় আমি বাবাকে দেখিনি। একটা বিশেষ উত্তর আমাদের জন্য খুব সাধারণ ছিল- কেউ যখন জিজ্ঞেস করত, বাবা কোথায়? আমরা উত্তর দিতাম আছেন হয়তো পৃথিবীর কোনোখানে!
তার রোস্টার দেখতে হবে। কিন্তু আমাদের পরিবার কখনোই ভুলতে পারতো না যে কোনো মুহূর্তে আসতে পারে সেই ফোন, যেখানে গম্ভীর শোকার্ত কণ্ঠে হয়তো জানানো হবে- বাবা আর কোনোদিন ফিরবেন না। আমরা সেই মুহূর্তটার জন্য প্রস্তুত হয়েই থাকতাম। যেখানেই থাকো এমএইচ ৩৭০, ফিরে এসো।