নতুন সম্ভাবনার পথে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ
নতুন সম্ভাবনার পথে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প। সরকার এ শিল্পের প্রসারে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এ অবস্থায় পুঁজি বিনিয়োগকারীরা এ খাতে আরো মনোযোগী হলে আগামীতে এ শিল্পকে ঘিরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন বিপ্লবের সূচনা ঘটবে। পরিবেশ দূষণের দায় এবং ‘জাহাজ ভাঙা শিল্পের বাংলাদেশ’ অপবাদ ঘুচিয়ে পৃথিবীর বড় বড় অভিজাত ‘জাহাজ নির্মাণ’ করেই একদিন বিশ্ব জয় করবে বাংলাদেশ। এমনই আশা করছেন এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। পাল তোলা কাঠের জাহাজ যখন সাত সমুদ্র পাড়ি দিত সে যুগে চট্টগ্রামে গড়ে উঠেছিল জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বিশাল অবকাঠামো। চট্টগ্রামে নির্মিত বাণিজ্যতরী ও রণতরীর কদর ছিল বিশ্বব্যাপী। রফতানি হতো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। প্রায় একশ’ বছর পর বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের ঐতিহ্য আবার ফিরে এসেছে। শুধু তাই নয়, জাহাজ নির্মাণে এ মুহূর্তের বিশ্ববাজারের বিশাল চাহিদা কাজে লাগানো সম্ভব হলে এ খাতটি দেশের বিদ্যমান সকল রফতানি খাতকে ছাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রথম স্থানে উন্নীত হবে অচিরেই।
উল্লেখ্য, ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন (আইএমও)-এর নীতিমালায় ২৫ বছরের বেশি পুরনো জাহাজ সমুদ্রে চলাচল না করার বিধান করা হয়েছে। আইএমও’র এ নির্দেশনার কারণে কেবল ইউরোপীয় দেশগুলোতেই ২৫ বছর বা তার বেশি বয়েসী প্রায় তিন হাজার জাহাজের নিবন্ধন বাতিল হচ্ছে। এর স্থলে সমসংখ্যক নতুন জাহাজ যোগ করতে হবে।
জানা গেছে, বিশ্বে প্রতি বছর সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ৬ শতাংশ হারে বাড়ছে। কিন্তু জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান বাড়ছে ৩ শতাংশ হারে। সে হিসেবে বিশ্বের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাভাবিক অবস্থায়ও চাহিদা মাফিক জাহাজ নির্মাণে সমর্থ নয়। সেখানে হঠাৎ করে এ বিশালসংখ্যক জাহাজ নির্মাণ কীভাবে হবে তা নিয়ে চরম সংকটে পড়েছেন সামুদ্রিক জাহাজ পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। এ বিরাট সংকটই বাংলাদেশী জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য আশির্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছে।
এ সংকটের কারণেই বিশ্ববাজারে এ মুহূর্তে প্রায় ৪০ হাজার কোটি ডলারের জাহাজ নির্মাণের অর্ডার রয়েছে। এর মাত্র শতকরা দুই ভাগ কাজও যদি বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পায়, তাহলেও প্রায় ৮০০ কোটি ডলারের (৬০,০০০ কোটি টাকা) বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারবে বাংলাদেশ।
ইতিমধ্যে দেশীয় প্রযুক্তি ও লোকবল ব্যবহার করে দেশের শিপবিল্ডার্সগুলো যাত্রীবাহী জাহাজ, ড্রেজার, অয়েল ট্যাংকার, টাগবোট, ফিশিং বোটসহ নানা ধরনের যান্ত্রিক নৌযান নির্মাণে সফলতা দেখিয়েছে। এ সুবাদে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সুনাম এখন ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে। বিশ্বের অন্যতম জাহাজ নির্মাণকারী দেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, ভারতের সবগুলো শিপইয়ার্ড বছর দেড়েক আগে থেকেই ৫ বছরের জন্য অর্ডার নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তাই ক্রেতারা জাহাজ কেনার জন্য বাংলাদেশসহ বিভিন্ন বিকল্প দেশ খুঁজছে। এই সুযোগটা বাংলাদেশী জাহাজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কাজে লাগাতে উদ্যোগী হয়েছে।
এদিকে জাহাজ নির্মাতারা সরকারি উদ্যোগে জাহাজ নির্মাণ শিল্প জোন স্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পখাতে ব্যাংক গ্যারান্টি প্রদানের দাবি জানিয়েছেন। তাদের বক্তব্য, কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ তীরে ১৫টি শিপইয়ার্ড নিয়ে জাহাজ নির্মাণ জোন গড়ে তোলা সম্ভব। দেশিয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর গ্যারান্টি সার্টিফিকেট পশ্চিমা দেশগুলো গ্রহণ করতে চায় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য ব্যাংক গ্যারান্টির ব্যবস্থা করে এবং ঋণের সুদ কিছুটা কম করা হয় তাহলে জাহাজ নির্মাণ ব্যয় অনেকটা কমে যাবে।
বাংলাদেশে এখন ছোট-বড় শতাধিক জাহাজ নির্মাণ কারখানা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে মাত্র ৭টি প্রতিষ্ঠান রফতানিযোগ্য জাহাজ নির্মাণ করছে। এরমধ্যে রয়েছে, চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড, কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড, ফিসার শিপইয়ার্ড, মেঘনা ঘাটের আনন্দ শিপইয়ার্ড, খান ব্রাদার্স শিপইয়ার্ড, নারায়ণগঞ্জের এনইএসএল শিপইয়ার্ড ও দেশ শিপইয়ার্ড।
কর্ণফুলীর তীরে গড়ে ওঠা ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড ইতোমধ্যে জার্মানি, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও পাকিস্তানে সমুদ্রগামী জাহাজ রফতানি করে সুনাম কুড়িয়েছে। রফতানির জন্য আরও বেশ কয়েকটি জাহাজ নির্মাণের অর্ডার পেয়েছে। এ পর্যন্ত ছোটবড় প্রচুর জাহাজ নির্মাণ করেছে প্রতিষ্ঠানটি ।
আনন্দ শিপইয়ার্ডকে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণশিল্পের পথিকৃৎ বলা হয়। ১৯৯২ সালে আনন্দ শিপইয়ার্ড দেশে সর্বপ্রথম বিশ্বমানের (ক্লাস শিপ) জাহাজ নির্মাণ করে। এরপর ২০০৬ সালে মালদ্বীপে দুটি কার্গো জাহাজ রফতানির মাধ্যমে জাহাজ রফতানি বাণিজ্যে প্রবেশ করে প্রতিষ্ঠানটি। এই শিপইয়ার্ড ও পর্যন্ত ৩শ’টিরও বেশি জাহাজ তৈরি করেছে। রফতানি করেছে প্রায় এক ডজন জাহাজ। আরো কয়েকটি জাহাজ রফতানির তালিকায় রয়েছে।
১৯৯৫ সালে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর উত্তর পাড়ে জাহাজ নির্মাণ শুরু করে কর্ণফুলী শিপইয়ার্ড। এ পর্যন্ত প্রায় ৮০টি জাহাজ তৈরি করেছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জাহাজ নির্মাণ কাজে নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি। তাদের অনেকে জানেন না তাদের নিজ দেশে অনেক জাহাজ নির্মাণ কারখানা গড়ে ওঠেছে। এমনই একজন সিঙ্গাপুরের জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে আসা বাংলাদেশী কর্মী আবদুল করিম। ভাবতেই পারেননি দেশেই তিনি একই ধরনের কাজ পাবেন।
৩৫ বছর বয়েসী আবদুল করিম বছর দুয়েক আগে দেশে ফিরে আসেন এবং চট্টগ্রামের ওয়েস্টার্ণ মেরিন-এ যোগ দেন। এখানে বর্তমানে প্রতি ১২ জনে একজন কর্মী রয়েছেন- যারা একসময় বিদেশি কোন শিপইয়ার্ডে কাজ করতেন। করিম জানালেন, ‘সিঙ্গাপুরের চেয়ে এখানে আমার বেতন প্রায় অর্ধেক। কিন্তু সার্বিকভাবে বাংলাদেশে আমি ভালো আছি এবং আমি আমার পরিবারের কাছে থাকতে পারছি।’
বাংলাদেশ জুড়ে রয়েছে শত শত কিলোমিটার উপকূলীয় অঞ্চল। বিস্তীর্ণ সমুদ্র তীর, নদী তীর। আগামীদিনে এ অব্যবহৃত উপকূল জুড়ে জাহাজ নির্মাণ শিল্প গড়ে উঠলে এ সম্ভাবনাময় খাতকে ঘিরেই হয়ত একদিন এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। -বাসস