স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান : প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সাধারণ নির্বাচনের সময় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে জনগণ যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে- তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “একাত্তরের মত ঐক্যবদ্ধ হয়ে জাতি গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সন্ত্রাসী ও স্বাধীনতা বিরোধীদেরকে প্রতিহত করেছে এবং দেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেছে।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১৪ প্রদানকালে এ কথা বলেন ।
জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর চেতনা বাস্তবায়নে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্রতিবছর দেশের নাগরিক বা সংগঠনকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয়।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য নয়জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে চলতি বছরের স্বাধীনতা পুরস্কার দেয়া হয় ।
প্রধানমন্ত্রী এ বছর স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে তাঁদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে এই পুরস্কার প্রদান করেন। পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে- একটি করে ৫০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণপদক, দুই লাখ টাকার একটি চেক ও একটি সনদপত্র।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বলেন, গত সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট তাদের জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করেছিল। তারা প্রিসাইডিং অফিসার, বিজিবি ও পুলিশ হত্যা, বাসে, রেলে আগুন, পুড়িয়ে মানুষ হত্যা, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, সম্পদ নষ্টসহ নানা অপকর্ম করেছিল।
তিনি বলেন, “একটি বিষয়ে আমি সত্যি প্রশংসা করি, সেসময় প্রশাসন, সশস্ত্র বাহিনী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী একাত্তরের মত ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ নির্বাচন যাতে অনুিষ্ঠত হতে পারে, জানমাল যাতে রক্ষা হয়- দৃঢ়তার সাথে তা মোকাবেলা করতে পেরেছিল। যার জন্য দেশে শান্তি ফিরে আসে। দেশে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা রক্ষা পায় ।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর সরকার দেশের অর্থনীতির অগ্রগতির পাশাপাশি বাংলাদেশকে একটি উদার গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও শান্তিকামী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, যারা উড়ে এসে জুড়ে বসে- দেশের জন্য তাদের কোন মায়া থাকে না। ভোগ করার মানসিকতা দিয়েই তারা দেশ চালায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যারা ত্যাগ স্বীকার করেছে, যখন তাদের হাতে ক্ষমতা এসেছে ,তখনই দেশের উন্নতি হয়েছে।”
তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্রে আমরা সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে পেরেছি বলেই দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল একটাই- দেশকে আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে দাঁড় করানো। যে জাতি যুদ্ধ করে বিজয় অর্জন করতে পারে, সে জাতি কেন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আর হানাহানি, জঙ্গীবাদ চাই না। আমরা বাংলাদেশকে সেভাবে গড়তে চাই যেখানে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, হানাহানি থাকবে না। বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের একটি উন্নত দেশ।
শেখ হাসিনা বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে শান্তি ফিরে এসেছে, আবার আমরা অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে পা রাখতে সক্ষম হয়েছি। এবারই প্রথম বাংলাদেশে একটি সরকারের সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়েছে। আর সেই সরকার, সেই দলের নেতৃত্বে আসে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছে, যাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।
তিনি বলেন, যারা সৃষ্টি করে, যারা ত্যাগ স্বীকার করে তারাই জানে কিভাবে তাদের সৃষ্ট কর্মকে রক্ষা করতে হয়। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী ও স্বাধীনতার বিরোধী শক্তিকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, যারা হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসে, ক্ষমতা দখল করে, তারা শুধু ব্যস্ত থাকে কিভাবে ভোগ দখল করা যায়। তারা শুধু নিজেদের জন্য ভোগ করতে পারে। যারা দখল করে ক্ষমতায় এসেছিল ভোগ করার দিকে তাদের যতটা নজর ছিলো উন্নয়নের দিকে ততটা নজর ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর মত বলিষ্ট নেতৃত্ব ছিল বলেই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশ অতি অল্প সময়েই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে বিদ্ধস্ত অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায়। ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সৈন্যরা ফিরে যান। সারা বিশ্বে এ ধরণের ঘটনা বিরল।
পচাঁত্তরের ১৫ আগস্টের নৃশংস ঘটনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে কি দেখলাম- যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে, মাবোনদের হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে, হত্যাযজ্ঞ চালাতে সাহায্য করেছে, যাদের বিচার জাতির পিতা শুরু করে দিয়েছিলেন, যাদের যুদ্বাপরাধী হিসাবে গ্রেফতার করা হয়েছিল , তাদের সবাইকে ছেড়ে দেয়া হয়। যারা পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিয়েছিল তাদের শুধু ফিরিয়ে আনা নয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্টিত করা হয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আবার দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়। হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে জাতির সামনে তুলে ধরার প্রয়াস নেয়। দেশবাসী যাতে জানতে পারে এদেশের অনেক ইতিহাস আছে, ত্যাগ আছে। একুশ বছরে যা মুছে ফেলা হয়েছিল চেষ্টা করা হয়েছে সেই গৌরবের ইতিহাসকে আবার তুলে আনার।
২০০৮ সালে দেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে আবারও নির্বাচিত করার পর দেশ আবার সামনে এগিয়ে যেতে থাকে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ সময়ে বিশ্বব্যাপী মন্দা সত্ত্বেও অর্থনীতির প্রতিটি সূচক ছিল ইতিবাচক। তাঁর সরকার প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের উপরে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে দেশে ১ কোটিরও বেশী মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়ে ১ হাজার ৪৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। শিক্ষার হার ও মান বেড়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে।
তিনি বলেন, হরতাল অবরোধের নামে রাস্তাঘাট কেটে যখন নানা ধরনের ঘটনা ঘটানো হয় সেই পরিস্থিতিতে তার সরকার বছরের প্রথম দিন ৩১ কোটি নতুন বই ছেপে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছাত্রছাত্রীদের হাতে পৌঁছে দিয়েছে।
প্রতিটি ইউনিয়নে তথ্য সেবা কেন্দ্র করে দেয়া হয়েছে। ১১ কোটি মানুষ বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষের জীবনকে সহজ করা এবং দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দেয়াই তার সরকারের লক্ষ্য।
যারা স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন তাদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের মত অবদান রেখেছেন।
সবাইকে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামীকাল ২৬ মার্চ প্যারোড স্কয়ারে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হবে। সকলকে আমন্ত্রণ জানাই। যারা দূরে আছেন তারা নিজ নিজ জায়গা থেকে একাত্ম হবেন। আমরা এ দেশটা সুন্দর ভাবে এগিয়ে নিযে যেতে চাই।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুসহ স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল শহীদ, জাতীয় চার নেতা, স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্যাতিত নারী, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের গভীর শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করেন।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞার পরিচালনায় পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি, প্রধান মন্ত্রীর মুখ্য সচিব, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীবর্গ, তিন বাহিনী প্রধানগণ, কুটনৈতিকবৃন্দ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, বিচারপতিগণসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।