বার্কলেস ব্যাংক থেকে যেভাবে মিলিয়ন পাউন্ড চুরি হয়
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ: নাম তার জন স্কেরমার। পেশায় কম্পিউটার গিগ এক্সপার্ট, বার্কলেস ব্যাংকের রেমিট্যান্স আইটি শাখায় কর্মরত। বেতন ভালোই, থাকেনও বেশ দামী বাড়িতে, স্ত্রী সহ দুই ছেলের জনক, বয়স ৪৫। অথচ এই ব্যাংকার ভদ্রলোকের আজব এক শখ পেয়ে বসে, পতিতাদের সাথে মেলামেশা, নিজেকে খুব উঁচু মানের এক ব্যবসায়ী হিসেবে তুলে ধরা, তারপর তাদের পেছনে দেদারছে খরচ আর দামী রেস্টুরেন্টে ডাইনিং, ফষ্টিনষ্টি আর তার খরচ মেটাতে বার্কলেস ব্যাংকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ভুয়া একাউন্ট খুলে প্রতারণার মাধ্যমে কাস্টমারদের জমাকৃত টাকা খুব দক্ষতার মাধ্যমে নিজের ঐ ভুয়া একাউন্টে ট্রান্সফার করে সেই সব দামী কলগার্লদের একাউন্টে জমা করে দেন, যাদের সাথে তিনি মজা করে থাকেন পয়সার বিনিময়ে।
জানা যায়, এই জন বার্কলেস ব্যাংকে আইটি সেকশনে চাকুরীর সুবাধে নিজের খায়েশ আর লোভ লালসা চরিতার্থ করার জন্য ভুয়া নামে ১ মিলিয়নের অভার ড্রাফট সম্বলিত একটি একাউন্ট খুলেন আর সেই একাউন্টে নিজের মানি( যা ব্যাংক থেকে চুরি করে ট্রান্সফার করা হয়) ট্রান্সফার করে দেন, এভাবে তিনি থাইল্যান্ডের এক কলগার্ল নাম কোকাই, তার পেছনে ১ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করার বিশ্ব রেকর্ড গড়েন এই ব্যাংকার জন। কোকাইয়ের সাথে ডাইনিং, ট্রিপ ইত্যাদির জন্য তিনি চেশায়ারের তার লন্ডনের হোম থেকে ট্রাভেল করেন আর পরিবারকে তিনি জানান তিনি পুলিশের হয়ে ফ্রড কেইসের ইনভেস্টিগ্যাশনের দায়িত্ব পেয়েছেন, তাই ঘন ঘন বাইরে যাওয়া এই আর কি!
সব কিছুই ঠিক ঠাক মতো চলছিলো। জন স্কেরমারের ব্যাংক একাউন্ট থেকে জালিয়াতি করে মিলিয়ন পাউন্ড ফ্রডের মাধ্যমে তার খায়েশের ল্যাভিশ লাইফ চলছিলো। বাধ সাধে, ব্যাংকের নজরে বহুদিন পর আসে, কাস্টমারদের একাউন্টের টাকা বা ডিপোজিট জমা হচ্ছেনা অথচ কোথায় যাচ্ছে ব্যাংক হদীস বের করতে পারেনি। দায়িত্ব দেয়া হয় জন স্কেরমারকে বিষয়টি খতিয়ে দেখে পুলিশের ফ্রড টিমকে অবহিত করার। আর তখনি পুলিশী ইনভলম্যান্টের সুবাধে জন স্কেরমার এবার নিজেই স্বীকার করেন, বাইরের কোন ফ্রড বা হ্যাকার নন, তিনি নিজেই ভুয়া একাউন্ট সেট আপ করে ব্যাংকের ২.১ মিলিয়ন পাউন্ড চুরি করেছেন। একে একে সব খুলে বলেন, তৎক্ষণাৎ ফেরত দেন ৭২২,০০০ পাউন্ড সহ ৩৫,০০০ পাউন্ড মূল্যের দামী আওডি কার। বার্কলেস ব্যাংক তাদের এই সফট ওয়ার ইঞ্জিনিয়ারকে পুলিশে সোপর্দ করে। যথারীতি আদালতে হিয়ারিং চলাকালে এই চাঞ্চল্যকর ফ্রডের তথ্য বেরিয়ে আসে প্রকাশ্যে।
যেভাবে ফ্রড শুরু-
২০০৮ সালে এই জন স্কেরমার সফট ওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে বার্কলেস ব্যাংকের আইটি ডিপার্টম্যান্টে নিয়োগ পান। চাকুরীর সুবাধে জন বার্কলেস ব্যাংকের কাস্টমারদের একাউন্ট থেকে মানি ফ্রডের মাধ্যমে নিজের ভুয়া গোস্ট একাউন্টে ট্রান্সফার করতে থাকেন নির্দ্বিধায়। প্রথমে ব্যাংক কোনভাবেই এমন প্রতারণার ধারণাই করতে পারেনি।ব্যাংক বলছে জন ফ্রডের মাধ্যমে ২.১ মিলিয়ন পাউন্ড হাতিয়ে নিয়েছেন।
জনের সাথে পরিচয় হয় থাইল্যান্ডের কলগার্ল আচারিয়া রোনকাওয়ানিয়া কোকাই-এর। তাকে পরিচয় দেন তিনি খুব বড় একজন ব্যবসায়ী, টাকার কুমীর।আচারিয়ার কোকাইয়ের সাথে সাক্ষাতের জন্য জন ছুটে চলেন লন্ডন থেকে, এভাবেই তার পেছনে ল্যাভিশ লাইফ স্টাইলে স্পেন্ট করে বসেন ৯৯৬,৯৯৯ পাউন্ড- যা তিনি কোর্টে স্বীকার করলেন।
সিটি ফ্রডের লন্ডন পুলিশের টিমের তদন্তে বেরিয়ে আসে জন দশ জন কলগার্লকে এই সময়ের ভিতরে ব্যাংক থেকে মানি ট্রান্সফার করে পেমেন্ট দিয়েছেন অথচ বার্কলেস শুরুতেই কোন ধারণাই করতে পারেনি তাদেরই সফট ওয়ার ইঞ্জিনিয়ার এই মাস্টার-মাইন্ডের পেছনে।
এভাবে জন বিগত পাঁচ বছর ব্যাংকের একাউন্ট থেকে একের পর ফ্রডের মাধ্যমে মানি ট্রান্সফার করে যাচ্ছিলেন অথচ কোনভাবেই তা ট্রেস করা সম্ভব হচ্ছিলোনা ব্যাংকের পক্ষে।তিনি ছিলেন সন্দেহের বাইরে।
গত সপ্তাহে জনের সেন্টেন্স হয়েছে। ৪৩ বছর বয়স্কা তার স্ত্রী, যিনি নিজেও একজন ম্যাথ টিচার, ডেইলি মেইলকে জানান, গত ক্রিস্টমাসের ঠিক আগ মুহূর্তে তারা বিষয়টি বুঝতে পারেন, তার এই ফ্রড ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে।যার ফলে তাদের ৪০০,০০০ পাউন্ডের চেশায়ারের টাউন হাউস বিক্রি করে দিতে হচ্ছে।
পাদটিকাঃ বাংলাদেশেও অনেক আগে থেকেই এভাবে নামে বেনামে একাউন্ট এমনকি একাধিক একাউন্ট খুলে প্রতারণা ও ধোঁকার মাধ্যমে বহু নামী দামী অনেকেই ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে থাকেন, তফাৎ বাংলাদেশে হয় ব্যাংকের যোগসাজশে এবং লোনের মাধ্যমে। অধুনা শুরু হয়েছে, ব্যাংকারদের ও ফড়িয়াদের সহায়তায় সুড়ঙ্গ খুড়ে নির্ধারিত সময়ে নির্ধারিত ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা চুরির অভিনব এক আদিম কৌশল- যেখানে অভিজ্ঞদের মতে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত অনেক রাঘব বোয়াল জড়িত। সহায়তা ছাড়া এধরনের জালিয়াতি যে হতে পারেনা, সেটাতো তথ্য প্রমাণ ঘাটাঘাটির আগেই মনে করিয়ে দেয়।