শওকত হোসেন হিরণ আর নেই
বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও সংসদ শওকত হোসেন হিরণ ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আজ বুধবার সকাল ৭টায় রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৮ বছর।
তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলেসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। কিছুদিন আগে সুইডেনে পড়াশোনারত বড় মেয়ে রোশনী হোসেন তৃণার বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ছোট ছেলে সাজিদ হোসেন রাফসান ঢাকার বি এ এফ শাহিন কলেজ থেকে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে।
শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত হিরণকে বাঁচিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন চিকিৎসকরা। কিন্তু সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ করে দিয়ে হিরণ পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে।
তার পরিবারের সূত্র জানায়, এমপি হিরণ ‘স্থায়ীভাবে বোধশক্তিহীন অবস্থায়’ চলে গিয়েছিলেন এবং তাকে এতোদিন বিশেষ ব্যবস্থায় বাঁচিয়ে রাখা (লাইফ সাপোর্ট) হয়েছিলো। সিঙ্গাপুরের গ্লেনঈগলস হাসপাতালের চিকিৎসকরা হিরণের বাঁচার সব আশা ছেড়ে দেয়ায় এবং বাংলাদেশে এনে লাইফ সাপোর্ট খুলে ফেলার পরামর্শ দেয়ায় বৃহস্পতিবার তাকে সেখান থেকে এয়ার এ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছিলো।
এদিকে তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে বরিশালের রাজনৈতিক অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। ঢাকায় থাকা দলীয় নেতাকর্মীসহ আত্মীয় স্বজন ও সতীর্থরা অ্যাপোলো হাসপাতাল প্রাঙ্গণে ভিড় করছেন। চলতি বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
গত ২২ মার্চ শনিবার রাত ১০টায় হিরণ বরিশাল কাবের সামনে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর আঘাত পান এবং অচেতন হয়ে পড়েন। তাৎক্ষণিক তাকে শেরে বাংলা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় (শেবাচিম) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করেন। পরে রাত সাড়ে ১২টার দিকে অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় এ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সেখানে রোববার তার মস্তিষ্কে ‘ডিকমপ্রেসিভ ক্রানেকটমি’ নামে একটি অস্ত্রোপচার করা হয়। পরে মেডিক্যাল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সোমবার রাতে হিরণকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মঙ্গলবার সকালে তার একটি অস্ত্রোপচার করা হয়। এরপরও অবস্থার কোনো উন্নতি না হওয়ায় বৃহস্পতিবার রাতে দেশে ফিরিয়ে এনে পুনরায় অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
১৯৫৬ সালের ১৫ অক্টোবর পটুয়াখালীর বাউফল এলাকার মৃত আবুল হাশেম মিয়া ও মৃত জয়নব বেগমের সংসারে জন্মগ্রহণ করেন শওকত হোসেন হিরণ৷
১৯৭৩ সালে সক্রিয় রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় বরিশাল ল’কলেজ থেকে ‘এলএলবি’ পাশ করা হিরণের। ওই বছর তিনি জাসদ ছাত্রলীগে যোগদান করেন। ১৯৭৯ সালে জাসদ ছাত্রলীগ ছেড়ে বিএনপির ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত হন। ১৯৮৬ সালে তিনি যুক্ত হন এরশাদের জাতীয় পার্টির সাথে। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে তিনি তৎকালীন চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর হাত ধরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যোগাদন করেন।
এছাড়া তিনি এরশাদ সরকারের আমলে বরিশাল সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তবে পরে দুইবার জাতীয় পার্টি প্রার্থী হিসেবে বরিশাল-৫ (সদর) আসন থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েও পরাজিত হন।
২০০৮ সালের বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তবে ২০১৩ সালের ১৫ জুন বিসিসি’র নির্বাচনে তিনি বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আহসান হাবিব কামালের কাছে পরাজিত হন।
পরে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি বরিশাল সদর আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হন।
পেশায় ঠিকাদার ও ব্যবসায়ী শওকত হোসেন হিরণ সাউথ এ্যাপোলো মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল লিমিটেড, বেলস লিমিটেড, বেলস ফার্মা ইউনানি প্রাইভেট লিমিটেড, অ্যাভান্স অ্যাসোসিয়েট প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান, এইচ পি এল ও এইচ পি এল শিপিং এবং সাউথ বেঙ্গল পরিবহনের সত্ত্বাধিকারী, সাউথ এ্যাপোলো ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স প্রাইভেট লিমিটেড ও বেলভিউ মেডিক্যাল সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেডের পরিচালকসহ অন্তত ১১টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন।
শওকত হোসেনের এক ছেলে ও এক মেয়ে। সম্প্রতি মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। হিরণের স্ত্রী জীবুন্নেছা আফরোজ একজন সমাজ সেবক। নগরীর রিফুজী কলোনী এলাকার ডেঙ্গু সরদার রোডের ওহাব বাড়ির ‘হিরন পয়েন্ট’ নামের বাসায় তিনি পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন।
হিরণের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক প্রকাশ
শওকত হোসেন হিরণের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এক সময়ের অবহেলিত বরিশাল শহরকে সাবেক মেয়র হিরণ তার আন্তরিকতা ও অকান্ত পরিশ্রমে প্রাচ্যের ভেনিসে পরিণত করেছিলেন। বরিশালের উন্নয়নে তার ভূমিকা ছিল অতুলনীয়। বরিশালের মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা ছিলো অকৃত্রিম। বরিশালের মানুষ তাকে চিরদিন গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় স্মরণ করবে।
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবূবুল হক শাকিল স্বাক্ষরিত শোক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, হিরণের মৃত্যুতে বরিশাল হারিয়েছে একজন স্বপ্নদ্রষ্টা রাজনীতিবিদকে, উন্নয়নের রূপকারকে।
তিনি বলেন, হিরণের মৃত্যুতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হারিয়েছে একজন শক্তিশালী সংগঠককে, দেশ হারিয়েছে একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিককে।
শোক বিবৃতিতে তিনি মরহুম শওকত হোসেন হিরণের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্য এবং লাখ লাখ কর্মী, বন্ধু ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।