পানি সঙ্কটে সিলেটের ২৩ নদনদী
মোস্তাফিজুর রহমান কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার): শুষ্ক মওসুমে পানি মিলছে না সিলেট বিভাগের ছোট বড় ২৩টি নদনদীতে। নদীগুলোর বাংলাদেশ-ভারতীয় সীমান্তে উজানের উৎসমুখ পলিমাটিতে ভরাট হয়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলের ৬০টি নদীর গতি-প্রকৃৃতি বিপন্ন। বিশেষ করে সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা নদীর উৎসমুখ বন্ধ হওয়ায় এ দু’টি নদীর সাথে জড়িত ছোট বড় নদীগুলো অস্তিত্ব রায় লড়ছে আজ। দেখা দিয়েছে পানিসঙ্কট। এ দু’টি নদীর উজানে প্রতিবেশী ভারতের বাঁধ নির্মাণ ও একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে পানি বিশেষজ্ঞদের অভিমত। সরকার এখনি সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে সিলেটের এই নদীগুলোকে রা করা যাবে না। বিপন্ন হয়ে যাবে তাদের অস্তিত্ব।
ভারতীয় অংশে মিলিত হওয়া সিলেটের প্রধান নদী হচ্ছে কুশিয়ারা ও সুরমা নদী। আর এ দু’টি নদীর শাখা-প্রশাখা নদী হচ্ছে খোয়াই, মনু, ধলাই, পিয়াইন, সারি, সুতাং, রতœা, সোনাই, করাঙ্গী, ঝিংড়ি, ভেড়া মোহনা, রক্তি, কালনী, বৌলাইসহ অসংখ্য নদী। সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর উজানে প্রতিবেশী ভারতের বাঁধ নির্মাণ ও একতরফা পানি প্রত্যাহারের কারণেই শুষ্ক মওসুমে পানিপ্রবাহ নেই বললেই চলে। ফলে পানিসঙ্কটে এ অঞ্চলের কৃষি জমি অনাবাদি হয়ে পড়েছে। নদীগুলোর পানি না থাকায় হাজার হাজার কৃষক জমিতে পানি দিতে পারছেন না। কমে আসছে ফসল। নদীর তলদেশ ভরাট ও ভরাট অংশ বেদখল হয়ে নদীর পরিধিও কমে যাচ্ছে। এ কারণে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলার প্রায় ২৩টি নদনদীকে এখন চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সাথে আছে পরিবেশ বিপর্যয়। ভাটি অঞ্চল সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নবীগঞ্জে নৌচলাচল বন্ধ ও চাষবাসে ব্যাঘাত ঘটে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এখন চরমে। নদী নাব্যতা হারিয়ে ফেলছে। নদীর মাঝখানে দেখা দিয়েছে চর। নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তন, নাব্যতা হ্রাসে নদীভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন ভাঙছে নদীর পাড়। চর জেগে উঠায় ইঞ্জিনচালিত নৌকাও ব্যবহার করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিকাশমান পর্যটন শিল্পেও পড়েছে এর প্রভাব। কমলগঞ্জের খরস্রোতা ধলাই নদী প্রায় পানিশূন্য। দিন দিন ছোট হয়ে অস্তিত্বহীন হচ্ছে। সীমান্তবর্তী পাহাড়ি নদীকে কেন্দ্র করে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে জাফলং, লালাখালসহ বিভিন্ন এলাকায় গত কয়েক দশকে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে উঠেছে পর্যটনশিল্প। এই পরিস্থিতিতে শিল্পটি অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়তে পারে।
সিলেটে পানির বড় উৎস সুরমা ও কুশিয়ারা নদী। এই দুই নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাচ্ছে বলে অন্যান্য নদী ও খালের মাছ ও জলজ উদ্ভিদও মরে যাচ্ছে। ২১৭ মাইল দীর্ঘ সুরমা নদী বিভিন্ন স্থানে ভরাট হয়ে গেছে। অন্য দিকে নদী দূষণও অব্যাহত রয়েছে। নদীর আশপাশ এলাকা থেকে নিঃসৃত হচ্ছে বর্জ্য। নদীতীরবর্তী অন্তত ৩-৪ কিলোমিটারজুড়ে অসংখ্য ড্রেন দিয়ে পুঁতিগন্ধময় বিষাক্ত কালো পানি সুরমা নদীতে মিশ্রিত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিকূলতায় নদনদী হারাচ্ছে তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। এতে করে দূষণের মাত্রায় জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। বিশেষ করে পানিতে বর্জ্য মিশ্রণের ফলে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে ভাটির জনপদের নদীগুলো। তীরবর্তী জনপদের জীবন-জীবিকা বদলে যাচ্ছে।
হবিগঞ্জের খোয়াই, মৌলভীবাজারের মনু, কমলগঞ্জের ধলাই, কোম্পানীগঞ্জের পিয়াইন, সারি, সুতাং, রতœা, সোনাই, করাঙ্গী, ঝিংড়ি, ভেড়া মোহনা, রক্তি, কালনী, বৌলাইসহ অসংখ্য নদীর নাব্যতা উদ্বেগজনক। নদী ভরাটের কারণে হাজার হাজার বোরোচাষি হাহাকার করেন এই মওসুমে। নদীতে পানি নেই। পাম্প বসিয়ে পানি তুলে জমি চাষ করতে পারচ্ছে না। সিলেটের নদীর প্রাণ সুরমা ও কুশিয়ারা এখন যৌবনহারা। জীর্ণ, শীর্ণ যেন কঙ্কালসার। নদী শাসনের ব্যর্থতায় ভাঙনে জকিগঞ্জের বহু এলাকা মানচিত্র থেকে ‘হারিয়ে’ পার্শ্ববর্তী ভারতের অংশ প্রশস্ত করছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জের সুরমা ও কুশিয়ারাসহ ২৭টি নদী এবং মৌলভীবাজারের মনু, ধলাই এবং হবিগঞ্জের খোয়াইসহ ২৩টি নদীই এখন কার্যত বিপন্ন। কয়েক বছর আগেও যেখানে পাহাড়ে বৃষ্টি হলে ঘন বৃ-লতা-গুল্মে পানি আটকে থাকত এবং দীর্ঘ সময় ধরে আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামত পানি। এতে মাটির য় হতো না। এখন বৃষ্টির পানির সাথে উদোম কিংবা ন্যাড়া পাহাড় ধুয়ে লাখ লাখ টন বালু এসে ভাটিতে নদীর তলদেশে ভরাট হচ্ছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে পরিবেশ বিপর্যয়ে সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকায় ৪০ লাধিক মানুষ চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। নতুন সঙ্কট সৃষ্টি হবে পর্যটননির্ভর ব্যবসাবাণিজ্যেও।
একটি সূত্র মতে, ভারতের আসামের বরাক নদী সিলেটের জকিগঞ্জ অমলসিদ নামক স্থানে সুরমা ও কুশিয়ারা নামে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বরাক অমলসিদের কাছে এসে ‘ইউ টার্ন’ নিয়ে সুরমা নাম ধারণ করেছে। আর সোজা নেমে যাওয়া নদীটির নাম কুশিয়ারা। বরাকের শতকরা ৭০ ভাগ পানি কুশিয়ারা নদী দিয়ে, অবশিষ্ট ৩০ ভাগ পানি প্রবাহিত হয় সুরমায়। সুরমা বরাক নদীর সাথে আড়াআড়িভাবে থাকায় সুরমার উৎসমুখে পলি জমে তলদেশ ভরাট হয়ে বিশাল চর পড়ছে। ফলে শুষ্ক মওসুমে সুরমা নদীর প্রবাহ শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। এ নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি নদীর নাব্যতা নিশ্চিতে বৃহৎ পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। এখনি প্রয়োজন সরকারের সঠিক পদপে গ্রহণ করা, তা না হলে অচিরেই নদনদীগুলো দেশ থেকে হারিয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন।