চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বড় অঙ্কের জরিমানা হচ্ছে
আশরাফুল ইসলাম: সরকারি ব্যাংক বলে কথা। তাও চলছে সরকার সমর্থক পরিচালক অনুগত এমডিদের পরিচালনায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম ভঙ্গ করলে তেমন কী আসে যায়। আর জরিমানা করলেই বা কী। জরিমানার অর্থ তো কারো পকেট থেকে যাবে না। যাবে জনগণের অর্থে। সুতরাং বাংলাদেশ ব্যাংকের থোরাই কেয়ার। এমনি যেন হাবভাব চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ক্ষেত্রে। নিয়ম অনুযায়ী তিন মাসের বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন সাত মাসেও জমা দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। এরই মধ্যে ব্যাংকগুলোর বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণ। মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে চার ব্যাংক। বেড়ে গেছে ঋণের নিরাপত্তা সঞ্চিতি বা প্রভিশন ঘাটতি। সব মিলে বেহাল দশায় উপনীত হয়েছে এ চার ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক সূত্র জানিয়েছে, বর্ধিত সময় অনুয়ায়ী আর্থিক প্রতিবেদন জমা না দেয়ায় ব্যাংক চারটিকে বড় অঙ্কের জরিমানা করা হবে। ব্যাংক কোম্পানি আইন ২০০৩ অনুযায়ী আর্থিক প্রতিবেদন জমা দেয়ার সময় পার হওয়ার পর থেকে প্রতি দিন হিসেবে জরিমানা গুনতে হবে। প্রথম দিন দুই হাজার টাকা, এর পরের দিন থেকে ১০০ টাকা করে জরিমানা গুনতে হবে। আর সদ্য সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী প্রথম দিন ৫০ হাজার টাকা, এর পরের দিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা গুনতে হবে। তবে সে যেটাই হোক, আইন অমান্য করার দায়ে সরকারি মালিকানাধীন এ চার ব্যাংকে জরিমানা গুনতে হবে, এ বিষয়ে শক্ত অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা: রাজী হাসান গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আইন আমান্য করার কোনো সুযোগ নেই। অন্য ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে যা হয়, সরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেও তাই হবে। এখানে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। ব্যাংক কোম্পানি আইন ২০০৩ অনুযায়ী, প্রতি বছরের ব্যাংকগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন পরের বছরের প্রথম তিন মাসের মধ্যে জমা দিতে হয়। কোনো ব্যাংক আর্থিক প্রতিবেদন জমা দিতে ব্যর্থ হলে তারা আরো তিন মাসের সময় চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংক তা অনুমোদন দিলে ব্যাংকগুলো বছরের আর্থিক বিবরণী পরের বছরের ছয় মাস সময় পায়। কিন্তু সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোনো বছরের আর্থিক বিবরণী পরের বছরের প্রথম দুই মাসের সময় দিতে হবে। ব্যাংকগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আরো দুই মাস সময় দেয়ার বিধান করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ব্যাংক কোম্পানি আইন ২০০৩ অনুযায়ী চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কেননা, ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন হওয়ার আগেই ব্যাংকগুলোকে তিন মাসের সময় দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের অপর এক সূত্র জানিয়েছে, সাধারণত ব্যাংকগুলো প্রথম তিন মাসের মধ্যেই আর্থিক বিবরণী জমা দিয়ে থাকে। আর্থিক বিবরণী যাচাই বাছাই করে ব্যাংকগুলোর বার্ষিক মানদণ্ড নির্ণয় (ক্যামেলস রেটিং) করে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে সাত মাস অতিবাহিত হলেও সরকারি ব্যাংকগুলোর তাদের আর্থিক বিবরণী জমা দেয়নি। এর ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোর মানদণ্ড নির্ণয় করতে সমস্যা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক খেলাপি ঋণের যে পরিসংখ্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা দিয়েছিল তা বাস্তবতার সাথে মিল ছিল না। প্রকৃত অবস্থানের চেয়ে ব্যাংকগুলো কম দেখিয়েছিল। পরবর্তী বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যাচাই বাছ্ইা করে প্রতিটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়। একমাত্র রূপালী ব্যাংকেরই খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৭ শতাংশ উঠে যায়। অনুরূপভাবে অন্য ব্যাংকগুলোর একই অবস্থা। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর আর্থিক পরিস্থিতি বেহাল অবস্থায় পৌঁছেছে। এ অবস্থা আড়াল করতেই মূলত আর্থিক প্রতিবেদন দিতে ব্যাংকগুলো টালবাহানা করছে। ওই সূত্র জানিয়েছে, ইতোমধ্যে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে মূলধন ঘাটতি। বাস্তব চিত্র : বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মোট ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ১০ শতাংশ হারে তাদের মূলধন সংরণের প্রয়োজন ছিল ১০ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। তবে সংরণ করেছে মাত্র ৫৮৩ কোটি টাকা। এতে ঘাটতি দেখা দিয়েছে ৯ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা, যা শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ। তাদের মধ্যে সোনালী ব্যাংকে ঘাটতি রয়েছে পাঁচ হাজার ২৪৫ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকে এক হাজার ১১৫ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকে দুই হাজার ১২০ কোটি টাকা এবং রূপালী ব্যাংকে এক হাজার ১৬৫ কোটি টাকা। আর মার্চ শেষে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের মধ্যে অর্ধেকই দখল করেছে চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। ৫১ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণের মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকাই চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের। এর মধ্যে ১১ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা সোনালী ব্যাংকের, যা ব্যাংকটির মোট ঋণের সাড়ে ৩৪ শতাংশ। জনতা ব্যাংকের মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ বা চার হাজার ৫৯৬ কোটি টাকাই খেলাপি ঋণ। অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। আর রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা, যা মোট ঋণের প্রায় ২৭ শতাংশ।