রোহিঙ্গা ইস্যুতে নীরব কেন সুচি ?
প্রায় ১৫ বছর ধরে গৃহবন্দিত্বকে বেশ সাহসিকতার সাথে মোকাবিলা করায় অং সান সুকি তার শক্ত নৈতিক অবস্থানের জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন।
কিন্তু এখন দেশের বাইরে অনেকের কাছে এবং দেশেও তার ঐ অবস্থান দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমারের এই বিখ্যাত নারীর অবস্থান বেশ সমালোচনার বিষয় পরিণত হয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মিয়ানমারের সিনিয়র গবেষক ডেভিড ম্যাথিয়েসন বলেন, ‘আমি মনে করি মানবাধিকার সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তিনি একটা হতাশার নাম।’
এই নোবেল বিজয়ীর খ্যাতি বিশ্বজোড়া এবং যেকোন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব মিয়ানমারের ভ্রমণ করলে তার সাথে দেখা করেন, ছবি তুলেন এবং সেসব ছবি সম্মানের সাথে টাঙিয়ে রাখেন।
কিন্তু পর্যবেক্ষকদের মতে অর্ধশতকের পর মিয়ানমার হয়তো কর্তৃত্বপরায়ন সামরিক সরকারের হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছে। কিন্তু সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর হামলার ব্যাপারে এই ৬৮ বছর বয়সী নারীর কোনো কথা বলতে ব্যর্থ হওয়াকে অনেক বড় ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ নিয়ে অংসান সুকির সমালোচনার যথেষ্ট জায়গা রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রথ একটি প্রতিবেদনে বলেন, ‘এটা ধরে নেয়া বিশ্ববাসীর জন্য ভুল হবে যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হওয়া এই সম্মানিত নারীও মানবাধিকার রক্ষাকর্মী হয়ে যাবেন।’
এখন মানবাধিকার নিয়ে তার নীরবতার ব্যাখ্যা বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে দিয়েছেন। এটাকে অনেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নীরবতা হিসেবে দেখছেন!
মানবাধিকার রক্ষার এই স্পষ্টভাষী রক্ষক কেন হঠাৎ করে তার মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন?
এটাকে ডেভিড ম্যাথিয়েসন ‘একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত নীরবতা’ হিসেবে দেখছেন।
তিনি মনে করেন, সূচি ও তার দল এনএলডি মিয়ানমারের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থানের জন্য এমনটি করছেন।
রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর হামলার ঘটনার কেন তিনি নিন্দা জানাচ্ছেন না জানতে চাইলে গত নভেম্বরে সিডনিতে এক সভায় সুচি বলেন, ‘লোকজন নিন্দা চায় না,চায় আত্মরক্ষা। আমি নিন্দা জানাচ্ছি না। কারণ আমি দেখেছি যে নিন্দায় কোনো সুফল পাওয়া যায় না।’
তবে তার ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা দা আরাকান প্রজেক্টের পরিচালক ক্রিস লিউয়া।
সুচির অবস্থানকে ‘চরম হতাশাজনক’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, এতে সহিংসতাকারীদেরই সবুজ সংকেত দেয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা আর বৌদ্ধদের সহিংসতাকে এক পাল্লায় মেপেও সুচি ভুল করছেন।
এই রাজনৈতিক বন্দি যিনি নিজেকে ‘সবসময়ের জন্য রাজনীতিবিদ’ হিসেবে দেখেছেন এবং বারবারই এটা বলে আসছেন যে তিনি মিয়ানমারের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হতে চান।
২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে তিনি সামরিক বাহিনী সমর্থিত প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন।
ম্যাথিয়েসন বলেন, ‘তিনি এখন একটি ভিন্ন খেলা খেলছেন। মানুষ এখনো তাকে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মহান মানবাধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষার আইকন হিসেবে মনে করে। কিন্তু তারা যে জিনিসটা বোঝেন না তা হলো এই যে তিনি একজন রাজনীতিবিদ হতে চান এবং পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম একটি সামরিক বাহিনীকে হটাতে চাচ্ছেন।’
ম্যাথিয়েসন বলেন যে সুকির রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ভর করছে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর। এর মধ্যে আছে ‘আন্তর্জাতিক অসীম প্রত্যাশার চাপ, যার অনেকগুলোই বাস্তবতার বাইরের এবং অভ্যন্তরীণ সংকট যেখানে তিনি যদি মুসলিমদের পক্ষে কথা বলেন তাহলে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত হবে সংকটপূর্ণ।’
তাছাড়া তিনি এমন একটি রাজনৈতিক সমস্যাপূর্ণ সময়ে রাজনীতি করতে যাচ্ছেন যেখানে সামরিক বাহিনী এখনো অনেক শক্তিশালী এবং তিনি তাদের অধীনে একজন সংসদ সদস্য হিসেবে অবস্থান করছেন।
এদিকে তার রাজনীতি আরও সংকটে পরে যখন ২০০৮ সালে সংবিধানে একটি ধারা নিয়ে আসা হয় যেখানে বলা হয় কোনো ব্যক্তির বিদেশী স্বামী/স্ত্রী বা সন্তানাদি থাকলে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া যাবে না। সুকির প্রয়াত স্বামী ছিল বিদেশে জন্মগ্রহণকারী একজন অক্সফোর্ড একাডেমিক আর তার দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেও বৃটিশ নাগুরিক।
যেখানে সুকির সমর্থক ও দলীয় নেতা কর্মীরা সংবিধানের এই ধারাটি সংশোধনের কথা বলছেন সেখানে পার্লামেন্টকে মনে হচ্ছে এ নিয়ে চিন্তিত নয় বরং অন্য সংশোধনীগুলোর দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।
মিয়ানমারের সংবাদপত্র ‘ইরাবতী’র সম্পাদক অং জ মনে করেন, ‘দমনমূলক শাসকগোষ্ঠিরই একটি শাখা বর্তমান সরকারকে নিয়ে সুকির পাঠ ভুল ছিল।’
চীন সমর্থিত লেতপেদাঙ্গ কপার খনি প্রকল্পের ক্ষেত্রে তার বিতর্কিত সমর্থনকে স্থানীয়রা ব্যাপক সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এ প্রকল্পের বিরোধিতা করেছিল এবং সুকির অনেক সমালোচনা করেছিল। এরকম একটি ভুল পদক্ষেপ তার সমর্থন কমিয়ে দিতে পারে।
অং জ আরও বলেন যে ‘বর্তমান শাসকগোষ্ঠি খুব চতুরতার সাথেই তাকে ব্যবহার করে তাদের নিজেদের রাজনৈতিক বৈধতা আদায় করে নিচ্ছেন। পাশ্চাত্যের কাছে একটি প্রত্যাখ্যাত দেশ থেকে অনেক প্রিয়পাত্র হয়ে উঠছেন।
অনেক বার্মিজের কাছে তিনি এখনো অনেক প্রিয়পাত্র বটে, তবে দেশ ও দেশের বাইরে তার অনেক রাজনৈতিক জোটকে হারাচ্ছেন তিনি।’
(সিএনএনে টিম হিউমের লেখা Aung San Suu Kyi’s ‘silence’ on the Rohingya: Has ‘The Lady’ lost her voice? নিবন্ধের সংক্ষেপিত অনুবাদ)