ব্রিটেনে উচ্চ শিক্ষা : সংকটে শিক্ষার্থীরা

Educationআফতাব চৌধুরী : ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন গত ২৫ মার্চ অভিবাসন বিষয়ক এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে বলেন যে কোন দেশের প্রকৃত, যোগ্য ও ইংরেজি ভাষায় দক্ষ শিক্ষার্থীরা ব্রিটেনে পড়ালেখার সুযোগ পাবে। তিনি আরো বলেন যুক্তরাজ্যে ন্যায়সঙ্গত ও ভারসাম্যপূর্ণ আন্তঃসরকার অভিবাসন পদ্ধতি নিশ্চিত করার মাধ্যমে পরিশ্রমী ও উন্নয়ন অভিপ্রায়ী মানুষরা সহযোগিতার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। যাদের অবদানে ব্রিটেনের সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী সমাজ পরিবর্তিত হয়েছে, সেই অভিবাসী সম্প্রদায়গুলো তাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে স্বীকার করেছেন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী। বিখ্যাত বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবী, শিল্পী, বাদ্যযন্ত্রী, ক্রীড়া তারকা বা ব্যবসায়ী, নেতা, উদ্যোক্তা এবং কঠোর পরিশ্রমী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নারী ও পুরুষ এরকম অনেক সফল ব্রাইটনের পারিবারিক ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে তারা অন্যান্য দেশ থেকে ব্রিটেনে এসে আবাস গড়েছিলেন। এই হচ্ছে ব্রিটেন দ্বীপের ইতিবৃত্ত। ক্যামেরন বলেন, ‘আমরা উদার, বৈচিত্র্যময় এবং স্বাগত জানাতে উন্মুখ।’ তিনি যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি ও অভিবাসন নীতির ইতিবাচক প্রভাব তুলে ধরে বলেন, আমরা চাই বিশ্বের সেরা মেধাবী ও উজ্জ্বল শিক্ষার্থীরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বেছে নিক। ফলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেঁধে দেয়ার দরকার পড়বে না। তিনি আরও বলেন, যাদের কঠিন শ্রম ও বিনিয়োগ ব্রিটেনে চাকরি ও কাজের সুযোগ তৈরি করবে, তাদের ব্রিটেন স্বাগত জানাবে। কারণ আমরা আমাদের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছি। যথার্থ অভিবাসন ব্রিটেনের জন্য শুধু সুবিধার নয়, জরুরিও। তারপরও কোন কোন দেশ থেকে গত ২০১২ সালে গ্রেট ব্রিটেনে পড়াশোনার জন্য দরখাস্ত কম পড়েছে। তবে কর্তৃপক্ষ আশা করছে এটি ভবিষ্যতে ঠিক হয়ে যাবে। ব্রাজিল ও ইন্দোনেশিয়া থেকে বরাবরই ব্রিটেনে কম শিক্ষার্থী পড়তে আসে।
আমরা জানি শিক্ষা ব্যবসায় ব্রিটেন অনেক উন্নত এবং বিশ্বের অন্যসব দেশের চেয়ে অনেক দূর এগিয়ে আছে। ‘ও’ লেভেল, ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা পরিচালনা, ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে বিভিন্ন কোর্স পরিচালনাসহ ব্রিটেনের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উন্নয়নশীল বিশ্বের ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তি করনোর মাধ্যমে তারা তাদের এই শিক্ষা ব্যবসা পরিচালনা করে থাকে। গত বছর হঠাৎ করে তাদের এই বাণিজ্যে কিছুটা ভাটা পড়ে। সরকার হঠাৎ করে বিদেশী ছাত্রছাত্রী ভর্তির ব্যাপারে কিছুটা কড়াকড়ি আরোপ করায় এই ঘটনা ঘটে। পরে অবশ্য সরকার তার সিদ্ধান্ত পাল্টায়।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ম্যালকম গিলস সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। ইউ কে বর্ডার এজেন্সি গত সেপ্টেম্বর মাসে লন্ডন মেট্রোপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশী শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিল করে দেয় এই অভিযোগ তুলে যে, তারা ভিসা সঠিকভাবে মনিটরিং করতে পারেনি। ফলে ইউরোপের বাইরের যেসব শিক্ষার্থী ছিল তাদের মাত্র ৬০ দিন সময় দেয়া হয় অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার নতুবা ব্রিটেনে ছেড়ে দেয়ার। প্রফেসর গিলস বলেন, প্রতিবছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ হাজার বিদেশী শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতে আসে। কিন্তু গত বছরের ওই ঘটনার পর মাত্র ১ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। এতে ২০ মিলিয়ন পাউন্ড ইনকাম কমে যায়। কমে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা কমে যাওয়া এবং কর্মী সংখ্যা কমানো।
তিনি আরও বলেন, ইউকেবিএ-ও কার্যক্রমের ফলাফল শুধুমাত্র লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের, তার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে এবং সর্বত্র এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ায় এই বার্তাবহন করে যে, ব্রিটেন বিদেশী শিক্ষার্থীদের আর আমন্ত্রণ জানাবে না। বিশ্বব্যাপী মানহানিকর ব্যাপারও ঘটেছে। যদিও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়কে উদাহরণস্বরূপ বলা হয় বা ধরা হয়েছিল, কিন্তু ক্ষতিটা হয়েছে সর্বত্র। বিশ্ববিদ্যালয় এখনও ইউকেবিএ এবং হোম অফিসের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে। পরবর্তী শুনানি আগামী অক্টোবর মাসে হওয়ার কথা।
ক্যামেরনের ঘোষণার পর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ৫ হাজার শিক্ষার্থী ইতিমধ্যে দরখাস্ত করেছে এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় এ নিয়ে ২৫টি দেশের সাথে কাজ করছে। লেবার এমপি কেইথ ভাস এবং চেয়ারম্যান অফ কমন্স অ্যাফোয়ার্স কমিটি বলেন, ‘এই সিদ্ধান্ত ছিল দ্রুত। এটি খুব খারাপভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল এবং ব্রিটেনে বিদেশী শিক্ষার্থী আসার ক্ষেত্রে ইউকে’র সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। এটি পুনরুদ্ধার করতে হবে। আমাদের দেশ থেকে যেসব ছাত্রছাত্রী ব্রিটেনে পড়াশোনা করতে যায় তারা মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত ও বিত্তবান পরিবারের সন্তান। ব্রিটেনে যাওয়া তাদের সাধারণ দুটো উদ্দেশ্য থাকে। একটি হচ্ছে স্থায়ীভাবে ব্রিটেনে থেকে যাওয়া বা ইউরোপের অন্য কোনো দেশে বা আমেরিকায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করা। আর তা সম্ভব না হলে পড়াশোনার পাশাপাশি অবসর সময়ে কাজ করে অর্থ জমিয়ে দেশে এসে কিছু একটা করা। ব্রিটেনের যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ থেকেই হোক না কেন, একটি সার্টিফিকেট নিয়ে আসতে পারলে দেশে তার মূল্য দেশীয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাত্রছাত্রীদের চেয়ে একটু বেশি তো হবেই। অন্তত ভাষাগত যোগ্যতা তো তাদের অনেক বেশি থাকবে। কিন্তু আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তের ছেলে-মেয়েরা যদি দেশে পড়াশোনা করত তাহলে দেশের টাকা দেশেই থেকে যেত, আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অরাজকতাই তাদের বাধ্য করে ব্রিটেনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হতে। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে বিষয়টি এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে বাস্তবতার নিরিখে ও দেশের স্বার্থে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরও দেখুন...
Close
Back to top button