রানা প্লাজা ধসের এক বছর
ক্ষতিপূরণের আশায় এখনও অপেক্ষা
‘নাতিকে বুকে চাইপ্যা ধইরা এক বছর মাইয়ার কথা ভুলার চেষ্টায় আছি। দুধের শিশু মা কি জিনিস জানে না আমার নাতি। তোলা খাবার খাওয়াতে চাই, খায় না। কেমন জানি দিন দিন শুকাইয়া যাইতাছে। ডাক্তার দেখামু, সেই ট্যাকাও নাই। হুনছি সরকার ট্যাহা দেওয়ার লিস্ট করছে। কিন্তু এহনও কোনো ট্যাহা পাই নাই।’
সাভারে রানা প্লাজা ধসে প্রাণ হারানো আকলিমার দেড় বছরের পুত্র নাঈমকে বুকে নিয়ে বলছিল মরিয়ম বেগম। আকলিমার পরিবারের মতো এখনও অনেক হতাহত শ্রমিকের পরিবার ক্ষতিপূরণের কোনো টাকাও পায়নি। পাবে কি না সেই নিশ্চয়তাও নেই। আবার আহত শ্রমিকদের অনেকের মেলেনি কাজ। অথচ কথা ছিল আহতদের মধ্যে যাদের সক্ষমতা রয়েছে তাদের কাজের ব্যবস্থা ও নিহতদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে সরকার ও পোশাক কারখানার মালিকরা।
সরকারি ও পোশাক শ্রমিকদের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকেই অনুদান দেওয়া হয়েছে সাড়ে ২২ কোটি টাকা। এছাড়া বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারী ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ খরচ করেছে প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকদের বেতন, ক্ষতিপূরণসহ আনুষঙ্গিক খরচ রয়েছে। এর বাইরে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে নতুন করে ৪০ মিলিয়ন ডলার (সোয়া ৩ কোটি টাকা) ক্ষতিপূরণ আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন। তবে সরকার বলছে, রানা প্লাজা ধসে হতাহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কাজ চলছে। যারা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার উপযুক্ত কিন্তু এখনও পায়নি নতুন করে তাদেরও তালিকা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব আবদুস সোবহান সিকদার জানান, শুধু প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকেই অনুদান হিসেবে ২২ কোটি ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৭২০ টাকা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন দপ্তর ও দাতা সংস্থা উদ্ধার কাজে খরচ করেছে ৪ কোটি ৬২ লাখ টাকা। আরো অনুদান লাগবে কি না তা নির্ধারণে কাজ চলছে।
রানা প্লাজা ধসের পর হতাহতদের ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের বিষয়টি সামনে আসে। সরকারি ত্রাণ তহবিল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে বেশকিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের দাবির মুখে পোশাক কারখানার মালিকরাও শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। ব্যবসায়ীদের তৎপরতায় বিদেশি ক্রেতারাও ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তায় হাত বাড়ায়। তবে এখনও ব্যবসায়ী, বিদেশি ক্রেতাদের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছে শ্রমিকরা।
নাজমা আক্তার সাভারের রানা প্লাজা ধসে পা হারিয়ে এখন পঙ্গু। ঘরে বৃদ্ধ বাবা। মা মারা গেছেন অনেক আগেই। বলছিলেন, ‘ক্ষতিপূরণ বলতে এখন পর্যন্ত ১০ হাজার টাকা পাইছি হাসপাতাল ছাড়ার সময়। শুনছি আরো টাকা পামু। কিন্তু কবে পামু তা জানি না।’
সরকারি অনুদানের খতিয়ান
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় গুরুতর আহত ৩৬ জনকে সরকারি উদ্যোগে পারিবারিক সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে ৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ৭৯৮ জন নিহত পরিবারের ১ হাজার ৯৯ সদস্যকে ১২ কোটি সাড়ে ৩৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে শনাক্ত হওয়া ১৬৪ জন নিহতের ২২৮ জন আত্মীয়কে ২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক এমাজউদ্দীন চৌধুরী কায়কোবাদকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুরে নেওয়া ও চিকিৎসা বাবদ খরচ হয়েছে ১ কোটি ৬ লাখ টাকা। যদিও তাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি। পরে তার স্ত্রী ও দুই সন্তুানকে ১২ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছে সরকার।
রানা প্লাজা ধসে পড়ার ঘটনায় আহতদের চিকিৎসার জন্য ২২টি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিল হিসেবে ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে সরকার। ডিএনএ প্রোফাইলিং করতে সরকার দিয়েছে ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া উদ্ধার কাজে নেতৃত্ব দেওয়া সেনাবাহিনীকে খরচ হিসেবে দেওয়া হয়েছে ১ কোটি ২১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। ঢাকা জেলা প্রশাসন উদ্ধার কাজে খরচ করেছে ২ কোটি ৫৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। উদ্ধার কাজে ফায়ার সার্ভিস পেয়েছে ২৫ লাখ টাকা। আর ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার পেয়েছেন ২৭ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে উদ্ধার কাজে খরচ হয়েছে ৪ কোটি ৬২ লাখ ৪১ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়েছে সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থা।
ক্ষতিপূরণ আদায় হচ্ছে বিদেশি ক্রেতাদের থেকেও
শ্রমিক অধিকার সংগঠন গ্লোবাল ট্রেড ইউনিয়ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল, ইউএনআই, ক্লিন ক্লোদ্স ক্যাম্পেইন সম্প্রতি এক বিবৃতিতে জানায়, তারা যে ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে তার এক- তৃতীয়াংশ ইতিমধ্যে উঠানো হয়েছে। ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের এক বছর পূর্তির আগেই সব অর্থ উঠানো সম্ভব হবে। এই অর্থ ভবন ধসে নিহতদের পরিবার এবং দুই হাজারের বেশি আহত শ্রমিককে দেওয়া হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, যে ২৯টি ব্র্যান্ড রানা প্লাজার কারখানাগুলো থেকে পোশাক কিনত তাদের মাত্র অর্ধেক এই অর্থ দিয়েছে। তহবিলটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়, যেসব ব্যান্ড রানা প্লাজা থেকে কিনত তাদের অনেকের নিজস্বভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। ‘ক্লিন ক্লোদ্স ক্যাম্পেইন’-এর কর্মকর্তা ইনেকে জেলদেনরস্ট বলেন, গত বছর এই ২৯টি ব্র্যান্ড যৌথভাবে ২২ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। এ আয়ের মাত্র ০.২ শতাংশের চেয়েও কম ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছে। অথচ এসব শ্রমিকের জন্যই তাদের বড় অঙ্কের মুনাফা হয়েছে।
ব্রিটিশ বস্ত্র রিটেইলার প্রাইমার্ক জানায়, গত মাসে তারা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিপূরণের জন্য অতিরিক্ত ১০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে। এর মধ্যে ৯ মিলিয়ন ডলার সরাসরি রানা প্লাজার পোশাক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ৫৮০ কর্মচারীকে এবং বাকি এক মিলিয়ন তহবিলে জমা দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য যেসব ব্র্যান্ড অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেÑক্যানাডার লোব্লাও, বৃটেনের বঁ মার্শে এবং প্রিমিয়ার ক্লোদিং, ডেনমার্কের মাসকট, স্প্যানিশ এল কর্তে ইংলেস, ম্যাংগো এবং জারার ইন্ডিটেক্স।