প্রগতি ও নারী মুক্তি
আফতাব চৌধুরী:
কুড়ি শতকের প্রখ্যাত নারীবাদী লেখিকা সিমন দ্য বুভুয়া বলেছেন, কেউ নারী হয়ে জন্মায় না। সমাজই তাকে নারী করে তোলে। আর ভার্জিনিয়া উফল লিখেছিলেন তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এ রুম অব ওয়ানস ওন’ অর্থাত্ নিজের জন্য একটি নিজস্ব কক্ষ। তাত্ত্বিকদের কলমের খোঁচায় শব্দবন্দগুলো সাম্প্রতিককালে বিরাট তাত্পর্য বহন করলেও নারীবাদের অনেক আন্তিক কথা বা অনেক অর্থদ্যোতনা কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার মতো নয়। নারীবাদ বা নারী চেতনা প্রকৃত অর্থে এক নয়। অনেক। শুধু অনেকই নয়। যত নারী তত অর্থদ্যোতনা। অর্থাত্ স্থান-কাল-পাত্রভেদে নারীর সমস্যা যেমন এক নয়, তেমনিই তার সমাধানও কোনো একটি বিশেষ তত্ত্বকে অবলম্বন করে রচিত হতে পারে না। মোদ্দা কথা, কেবল তত্ত্ব দিয়ে নারীর সমস্যাবলিকে বিচার-বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর সব নারীর সমস্যা এক নয়। বাংলাদেশী নারীর সমস্যার সঙ্গে প্রাচ্যের নারীর সমস্যাবলিকে যদি পাশাপাশি রাখা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে উভয়ের মধ্যে সমস্যা এক উত্সজনিত নয়। উত্স যেমন ভিন্ন, তেমনই তার প্রতিকারও ভিন্ন হতে বাধ্য। উপযুক্ত প্রথম বাক্যটি যিনি রচনা করেছেন, ‘কেউ নারী হয়ে জন্মায় না। সমাজই তাকে নারী করে তোলে’, তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, তিনি যেভাবে আরেকজন প্রখ্যাত তাত্ত্বিক সার্ত্রকে সারাটি জীবন বৈবাহিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে উঠে সব ধরনের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছেন, তার জীবনসঙ্গীকে (স্বামী নয়) সহায়তা করেছেন, কুড়ি শতকের একজন বাংলাদেশী নারীর পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না। আর প্রায় আট দশক পরে বুভুয়ার উক্তিটি বাংলাদেশী সমাজে গুরুত্ব পাওয়ার রহস্যটিও তাই উদ্ঘাটন হওয়া দরকার। অর্থাত্ গত আট দশকে মূল্যবোধের প্রশ্নে বাংলাদেশী সমাজ অনেটাই প্রাচ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে শুরু করেছে বলেই নিজেদের সমর্থনে এ বিদেশিনীর উক্তিটিকে আমরা আঁকড়ে ধরতে চাইছি খড়কুটোর মতো। কল্পনা চাওলা কিংবা সুনীতা উইলিয়ামস ভিনগ্রহের নারী না হওয়া সত্ত্বেও তারা কিন্তু মহাকাশে পাড়ি দিয়েছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী ভারতবর্ষের পুরুষশাসিত সমাজে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। পাকিস্তানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো, বাংলাদেশের সাবেক ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী যথাক্রমে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা কিন্তু বেশ ভালোভাবেই তাদের কার্যকাল সমাপ্ত করেছেন বা করছেন। কিন্তু কারাগারে পাশাপাশি কক্ষে অন্তরিন থাকাকালে পরস্পর পরস্পরকে রান্না তরকারির বাটি আদান-প্রদানও করেছেন। সংবাদ মাধ্যমে সবাই দুর্লভ ছবিটি দেখেছেন যে, সুনীতা উইলিয়ামস মহাকাশে তার সহকর্মীদের রান্না করে দিয়েছেন। ফলে নারী যেখানে সার্বভৌম এবং সম্পূর্ণ স্বাধীন, এ অবস্থায় তাকে আবার নারী করে গড়ে তোলার অবকাশই কোথায়?
আসলে নারীর ঔপনিবেশিক মন বেশিরভাগ সময়ই থাকে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত। কোনো নারীই চায় না, ‘আমার বধুয়া আনবাড়ি যায় আমারই আঙিনা দিয়া’ পরিস্থিতিকে স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করতে। পুরুষ যেমন তার নারীকে রচনা করে ‘আপন মনের মাধুরী মিশায়ে’, তেমনি নারীরও তো থাকতে পারে একটি পুরুষ, যাকে সে রচনা করবে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে। এখনও দোকানে পুতুল কিনতে গেলে পুরুষ পুতুলের অভাব প্রকটভাবে পরিলক্ষিত হয়, অথচ নারীবেশী পুতুলের প্রাচুর্য লক্ষণীয়। বস্তুত নারী এবং পুরুষের নারীত্ব এবং পুরুষত্ব প্রেক্ষিতনির্ভর। স্থান-কাল-পাত্রভেদে নারীর সঙ্গে পুরুষের কিংবা পুরুষের সঙ্গে নারীর বৈপরিত্য দেখা দিতেই পারে—যেহেতু নারী এবং পুরুষের বাস্তবতা এক নয়; আলাদা আলাদা। একই পরিবারের যমজ ভাই-বোনের বাস্তবতা যেমন এক নয়, রুচি এক নয়, দিবারাত্রি সমান নয়, এ অবস্থায় বাংলাদেশী নারী আর প্রাচ্যের নারীর বাস্তবতাও এক হওয়ার নয়। সিমন দ্য বুভুয়া যতই বলুন, আমরা আমাদের প্রেক্ষিত অনুযায়ী, আমাদের বাস্তবতা অনুযায়ী সেসব অপ্তবাক্য মেনে নেব অথবা বর্জন করব; প্রাচ্যের নারীর অন্ধ অনুকরণের নাম নারীচেতনা হতে পারে না। প্রাচ্যের নারীরা শিক্ষা-দীক্ষায় আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। এক্ষেত্রে তারা আমাদের আদর্শ হতেই পারেন, কিন্তু প্রকাশ্যে রেস্তোরাঁয়, সমুদ্র সৈকতে, বিয়েবহির্ভূত তথা উলঙ্গ বেহায়াপনা, বেলেল্লাপানা কোনো মতেই অনুকরণযোগ্য হতে পারে না—বুভুয়া যতই বলুন না কেন। তথাকথিত নারীমুক্তির সঙ্গে তাই নারী প্রগতির এসপার ওসপার হওয়া চাই। তবে নারীকে চিন্তার ক্ষেত্রে যাবতীয় দৈন্য ঝেড়ে ফেলতে হবে। পুরুষতন্ত্রের অন্য নাম যদি আধিপত্যবাদ হয়, তাহলে বলতেই হয়, বাংলাদেশী নারীরা তা থেকে অনেকটাই মুক্ত। শিক্ষা, চাকরি, জনপ্রতিনিধিত্বসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারী এখন পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন করতে সক্ষম। আজ আর নারীকে আপন ভাগ্য জয় করার অধিকার দেয়ার প্রয়োজন নেই। নারী নিজেই সেই অধিকার কেড়ে নিতে সক্ষম।