সন্ধিক্ষণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ?
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বর্তমানে চলছে ইউরোপীয় পার্লামেন্টারী ইলেকশনের জন্য নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অটুট থাকার প্রয়োজনীয়তা ও অপ্রয়োজনীয়তার প্রশ্নটি খুব জোরে শোরে না হলেও এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। ইইউ সমর্থক ও ইইউ বিরোধী দুটি ভাগে ভাগ হয়ে গেছে ইউরোপের দেশগুলো।
জরিপে দেখানো হচ্ছে, দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তি- কনজারভেটিভ ও সোশাল ডেমোক্র্যাটরা প্রচার-প্রতিযোগিতায় রয়েছে পরস্পরের খুব কাছাকাছি। কিন্তু ইউরোপীয় ঐক্যে বিশ্বাসীদের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে এবার গণসাজুয়ের পছন্দ-অপছন্দের প্রশ্নটি। দুশ্চিন্তায় পড়েছেন শুধু কনজার্ভেটিভ ও সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরা নন, বরং লিবারেল এবং গ্রীনরাও। ফ্রান্সে ন্যাশনাল ফ্রন্ট অথবা ইউকের ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টির মতো দেশবিদেশের মধ্যে সীমায়িত রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের নিজ নিজ দেশে এবার জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসতে দেখা যাচ্ছে। ফিনল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, হল্যান্ড, হাঙ্গেরি, গ্রীস ও অন্যান্য দেশে ইইউ বিরোধী বিভিন্ন দল এবং ইইউ-এর প্রয়োজনীয়তা সম্বন্ধে বরাবর সন্দিহান দলগুলো- ইদানীং দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। উল্লিখিত দেশগুলোয় ইইউ-এর প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকারিতা প্রশ্নে জনমনে বিভ্রান্তি ক্রমে প্রবল হচ্ছে। আর্থিক সংকট মোকাবিলায় ইইউ’র ব্যর্থতাও ইউরোপীয় জনমনে দাগ কেটেছে। ইইউ’র প্রতি তাদের অনাস্থা প্রবল হয়েছে ইইউ-এ উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে ক্রমে বেড়ে চলা ব্যবধানে। ইইউ কর্তৃপক্ষ সম্মুখীন বিভিন্ন সংকট নিরসনে একের পর এক পদক্ষেপ নিলেও পদক্ষেপগুলোর সুফল ইইউ-জনগণ তাদের প্রাত্যহিক জীবনে টের পেয়েছেন খুব কমই।
ইইউভুক্ত বিভিন্ন দেশে লাগাতার আর্থিক প্রবৃদ্ধি ইইউ নিশ্চিত করবে কোন্্ উপায়ে এর জবাব পেতে উদগ্রীব এবার জনগণ ইইউপন্থী ও ইইউবিরোধীদের পরস্পর বিরোধী প্রচারণার মধ্যে। ইইউ-র ঐক্য বিনাশে তৎপর তত্ত্বের মোকাবিলার জন্য বেশি প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি, চাহিদার মোকাবিলা ও রোজগার বৃদ্ধির মতো প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে জনগণ দেখতে পাচ্ছেন, ইইউ সমর্থকরা তাদের প্রচারণায় জোর দিচ্ছেন ইইউ’র অস্তিত্ব বিরোধীদের শুধুমাত্র মোকাবিলা করার বিষয়টির ওপর।
ইউরোপ জুড়ে গৃহীত ব্যয় সংকোচন নীতির সাফল্য ও ব্যর্থতা যাচাইয়ের কষ্টিপাথর সাব্যস্ত হবে এবারের ইইউ-এর পার্লামেন্টারি নির্বাচন। শুধু এটিই নয়, নির্বাচনের মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হবে-বিশ্বে শীর্ষ আর্থিক শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান ইউরোপ ধরে রাখতে পারবে কিনা। একটি জনমত জরিপ সংস্থার পক্ষ থেকে ইউরোপের বাইরের কয়েকটি দেশে অবস্থানকারী ইউরোপীয় বিদ্যার্থীদের প্রশ্ন করা হয়- নতুন করে জন্ম নেয়ার সুযোগ পেলে তাদের পছন্দনীয় জন্মস্থান হিসেবে কোন্্ এলাকার তারা নাম বলবে। প্রতিটি বিদ্যার্থীর জবাব ছিল-ইউরোপ।
বস্তুত ইউরোপের যাদুকরী আকর্ষণ শক্তিটির প্রভাব ইউরোপীয় জনমনে আজও অত্যন্ত প্রবলভাবে সক্রিয় রয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি উল্লেখ্য, এককভাবে ইউরোপের দেশগুলো আকার-আয়তনে এতোই ছোট যে, আন্তর্জাতিক স্তরে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চালিয়ে যাওয়ার তাদের সামর্থ্য নেই।
ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের প্রয়োজনীয়তা সেখানকার বিভিন্ন দেশের জনগণ খুব বেশি উপলব্ধি করেন এই কারণেই। ইউক্রেন সংকটের ক্ষেত্রে এই কারণেই আত্মমগ্ন ও উদাসীন থাকতে পারেনি ইউরোপের দেশগুলো। নিজেদের মধ্যকার ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ইউরোপের দেশগুলো ইদানীং উপলব্ধি করছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। বিশেষত জ্বালানি প্রশ্নে। অনাকাঙ্খিত জলবায়ু পরিবর্তন প্রক্রিয়া রোধের জন্যও ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ এবং জ্বালানি ব্যবহার প্রশ্নে অবস্থান নিতেও ঐক্যবদ্ধ বর্তমান ইউরোপ। ইউরোপীয় জনজীবনে ইইউ গঠনের ফলপ্রসূ প্রভাব ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়োজনেই আটলান্টিকের দুই দিকের মধ্যে অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা ইই কে ইদানিং উপলব্ধি করতে হচ্ছে আগের তুলনায় আরও বেশি। এই জন্য যে, এর ফলে ইইউ’র বিভিন্ন দেশে নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং এই প্রক্রিয়ায় ইইউ বিরোধীদের ইউরোপীয় ঐক্যবিনাশী প্রচারণার যুব জনমনে প্রভাব হারাবে।
ইউরোপ-আমেরিকার পারস্পরিক সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রও উপকৃত হবে নিঃসন্দেহে। যে আর্থিক সমস্যা ও অভ্যন্তরীণ আস্থার সংকটে ইইউ বর্তমানে আক্রান্ত, পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আরও ব্যাপক আর্থিক রাজনৈতিক গণতন্ত্র চর্চা ইউরোপ জুড়ে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে তার সমাধানে পৌঁছানোর সামর্থ্য ও সম্ভাবনা ইইউ-এর রয়েছে। ইইউ-বিনাশী মনোভাবের প্রতিফলন স্বরূপ দেখা যাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে অবাধ যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে এবং পারস্পরিক জাতি বিদ্বেষে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ জর্জরিত হচ্ছে যা আধুনিক ইউরোপের কোনোভাবেই কাম্য নয়।