ইরান-সৌদি বৈরিতার অবসান শিগগিরই !
হাসান শরীফ: মিসরীয় সাংবাদিক ড. মোস্তফা আল ল্যাবাদ কায়রোতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ‘আল শারক সেন্টার ফর রিজিওন্যাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ’ এর পরিচালক। । ইরান, তুরস্ক ও মধ্য এশিয়া হলো এই সেন্টারের প্রধান গবেষণার বিষয়। মোস্তফা ল্যাবাদ একসময় মিসরের সরকারি বার্তা সংস্থা মেনা’র সাথে যুক্ত থেকে সাংবাদিকতা শুরু করলেও তার বক্তব্যে নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য রয়েছে বলে মনে করা হয়। তিনি পিএইচডি করেছেন জার্মানিতে। এরপর তিনি সাংবাদিকতার চেয়েও কৌশলগত গবেষণায় বেশি মনোনিবেশ করেন। আল ল্যাবাদের এই লেখায় মধ্যপ্রাচ্যে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির ব্যাপারে নতুন কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে। লেখাটির অনুবাদ করেছেন হাসান শরীফ।
প্রায় এক যুগ ধরে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার বিরোধ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম জটিল সমস্যা হিসেবে বিরাজ করেছে। দেশ দু’টির মধ্যকার তিক্ততা অঞ্চলটির প্রতিটি স্থানে প্রকটভাবে দৃশ্যমান। উত্তরে ইরাক, দেিণ ইয়েমেন, পূর্বে বাহরাইন ও পশ্চিমে লেবানন পর্যন্ত বিস্তৃত তাদের রণাঙ্গন। সৌদি-ইরান কিংবা শিয়া-সুন্নি বিরোধ আঞ্চলিক সঙ্ঘাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
তিন বছর আগে সূচিত আরব বসন্ত এসব বিরোধ ধুয়েমুছে সাফ হওয়ার স্বপ্ন দেখালেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে ব্যর্থ হয়। তবে বর্তমানে স্থানীয় দ্বন্দ্ব চাপা পড়ে গেছে আঞ্চলিক সঙ্ঘাতে। এ প্রসঙ্গে বিশেষ করে ইরাকের পার্লামেন্টারি নির্বাচন, লেবাননের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, ফাতাহ-হামাস সমঝোতা এবং সিরিয়ার ঘটনা উল্লেখ করা যায়। ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যকার বিরোধের কারণ সিরিয়া। রিয়াদ-তেহরান সম্পর্কের মাধ্যমে আঞ্চলিক মতার ভারসাম্য নির্ধারণ হয়। এ কারণে দেশ দু’টির সঙ্ঘাতের মাধ্যমে এ অঞ্চলে কী ঘটতে যাচ্ছে তা আঁচ করা যেতে পারে। বর্তমানে বিভিন্ন ঘটনায় দেশ দু’টির মধ্যে সঙ্ঘাত বাড়লেও উভয় পই যতটা সম্ভব তীব্রতা কমানোর মধ্যেই নিজেদের জন্য কল্যাণ দেখতে পাচ্ছে। আর এ প্রোপটেই সিরিয়ায় একটি রাজনৈতিক সমাধান আঞ্চলিক সমঝোতার পথ দেখাতে পারে।
সৌদি আরবের দৃষ্টিতে ইরান
রিয়াদ মনে করে, পরমাণুবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সমঝোতার ফলে তেহরানের ওপর থেকে পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার হয়ে যাবে এবং এই অঞ্চলের সঙ্ঘাতে দেশটি কোনো পরাশক্তির হস্তেেপর আশঙ্কা ছাড়াই তার ভূমিকা পালন করতে পারবে। এর ফলে ইরানে মতার ভারসাম্যেও পরিবর্তন আসবে, হাশেম রাফসানজানি ও প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির মতো মধ্যপন্থীদের তা সুবিধা করে দেবে। যুক্তরাষ্ট্র-ইরান আলোচনায় অগ্রগতির আরেকটি অর্থ হবে আঞ্চলিক বিষয়ে ইরানি নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষ করে এলিট ফোর্স হিসেবে পরিচিত রেভ্যুলুশনারি গার্ডদের মতামতের গুরুত্ব কমে যাওয়া এবং রুহানি ও রাফসানজানিদের জয়।
মধ্যপন্থী ইরানের সাথে তার মৌলিক সমস্যা হবে না বলেই রিয়াদের ধারণা। বিশেষ করে রাফসানজানির সময় ইরানের সাথে তারা গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা চুক্তি করতে পেরেছিল, মোহাম্মদ খাতামির আমলে রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব হয়েছিল। এটা ঠিক যে, ওই সময়ে আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য ছিল ভিন্ন। কিন্তু তবুও রাফসানজানি ও খাতামি ছিলেন সৌদিদের কাছে গ্রহণযোগ্য।
সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের সময় পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছিল। তবে এখন সেই অবস্থা নেই। আহমাদিনেজাদ মতা থেকে সরে যাওয়ার পর ইরান নতুন পথে অগ্রসর হয়েছে। দেশটি এখন আর বিশ্বে ইরানের ইতিবাচক ভাবমূর্তি থেকে সরে যেতে নারাজ। যুক্তরাষ্ট্র-ইরান আলোচনায় সৌদি স্বার্থ ুণœ হলেও ইরানি রাষ্ট্র কাঠামোতে মধ্যপন্থীদের অবস্থান শক্তিশালী করলে তা রিয়াদের জন্যও ভালো।
সতর্ক দৃষ্টিতে দেখলে বোঝা যাবে যে, যুক্তরাষ্ট্র-ইরান আলোচনায় অগ্রগতি সৌদি আরবের জন্য একটি সুযোগ এনে দেবে। বিশেষ করে অবরোধ প্রত্যাহার করার ফসল ঘরে তুলতে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনায় বেশি বেশি সফলতা পেতে ইরানের সময় লাগবে। কিন্তু এই আলোচনা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আঞ্চলিক ইস্যুতে নেমে পড়তে পারবে না ইরান। তার কিছুটা সময় লাগবে। প্রথমেই আন্তর্জাতিক ইস্যুতে নাক গলানোর আগে ইরানিরা প্রথমে তাদের রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে মতার নতুন ভারসাম্যে এবং আঞ্চলিক নীতিনির্ধারণী ফোরামে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করার চেষ্টা করবে।
এই অন্তর্বর্তী সময়ে সৌদি আরবের সাথে সমঝোতার দিকে ঝোঁকাই ইরানের ল্য হবে। সৌদি আরবের সাথে সাময়িক শান্তি প্রতিষ্ঠা হলে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সম্পর্কের বিষয়টির দিকে নজর নিবদ্ধ হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা চাইবেন ইরানের সাথে আরো দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং তার মধ্যপ্রাচ্যনীতি বাস্তবায়নের আঞ্চলিক সহায়তা কামনা করবেন তিনি।
ইরানের দৃষ্টিতে সৌদি আরব
সৌদি আরবও অভ্যন্তরীণ জটিলতায় রয়েছে। আর সেটা ইরানের চেয়ে কম গুরুতর নয়। সৌদি আরব বর্তমানে যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তা ১৯৩২ সালে দেশটির প্রতিষ্ঠার পর থেকে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক দিকে নিজেদের মধ্যে রূপান্তর ঘটছে, অন্য দিকে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কাঠামোতেও পরিবর্তন আসছে। এ কারণে ঘর পুরোপুরি সামলানো পর্যন্ত তারা আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে সমঝোতা করে বা বিরোধ এড়িয়ে যেতেই আগ্রহী হবে।
বাদশাহ আবদুল্লাহ পরবর্তী বাদশাহ হওয়ার দিক থেকে ক্রাউন প্রিন্স সালমান বিন আবদুল আজিজের পরই মুকরিন বিন আবদুল আজিজকে স্থান দিয়ে রাজকীয় ডিক্রি জারি করেছেন। বন্দর বিন সুলতান, মুতিব বিন আবদুল্লাহ ও মোহাম্মদ বিন নায়েফের সম্ভাব্য উত্তরাধিকার লড়াইয়ে মুকরিনকে এগিয়ে রাখার জন্যই তিনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে না জানিয়েই কাজটি করেছেন। ওয়াহাবি ধর্মীয় ক্রমবর্ধমান প্রভাব ইরানের সাথে সৌদি আঞ্চলিক রাজনীতির সামর্থ্য ুণœ করতে পারে, এমন ধারণা থেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকতে পারে। ফলে সৌদি রাজপরিবার সামাজিক মিডিয়ায় জড়িত তরুণ এবং আরো নাগরিক অধিকারকামী সৌদিদের এবং এই অঞ্চলে সৌদি ভাবমর্যাদা উন্নয়নে বাধা সৃষ্টিকারী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইবে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়েও মারাত্মক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে রিয়াদকে বিবেচনা করা হয় রিপাবলিকানদের দোসর, ডেমোক্র্যাটদের নয়। মধ্যপ্রাচ্যে সম্পর্কের েেত্র ওবামা বৈচিত্র্য আনার যে দৃঢ় ফঙ্কল্প ব্যক্ত করেছেন, তাতে সৌদি আরব নাখোশ হয়েছে। আর এ কারণে ওবামার মধ্যপ্রাচ্যনীতি তিগ্রস্ত করতে সৌদি আরব আমেরিকায় তার লবি ও কংগ্রেসকে ব্যবহার করবে। সৌদি আরব আশা করবে, ওবামা তার মধ্যপ্রাচ্যে যে সাফল্য লাভের চেষ্টা করছেন, তা বাস্তবায়নের আগেই মেয়াদ পূর্ণ হয়ে যাবে।
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক প্রোপটে ইরান ছাড়াও আরো নানা দিক থেকে চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে সৌদি আরব। বিশেষ করে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদে (জিসিসি) রিয়াদ তার প্রাধান্য বজায় রাখতে এবং কাতারকে সংযত রাখতে চাইবে। সৌদি আরবের আরেকটি সমস্যার নাম মুসলিম ব্রাদারহুড। পুরো অঞ্চলে বিস্তৃত ব্রাদারহুডকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। তা ছাড়া ইরাক ও লেবাননে আঞ্চলিক মিত্র এবং সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিয়োজিত জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণ করতেও তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এসব সমস্যার কারণে ইরানের সাথে নমনীয় হতে বাধ্য করবে সৌদি আরবকে।
শান্তির আসন্ন সম্ভাবনা
তবে বিভিন্ন দল, গ্র“পের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে যে বিরোধ চলে আসছে, সেটা হঠাৎ করেই সম্প্রীতি ও ভালোবাসায় রূপ নেবে, এমনটা মনে করা ঠিক হবে না। কেউ তা মনেও করে না। অবশ্য উভয় প ভিন্ন ভিন্ন কারণে হলেও যেহেতু উত্তেজনার প্রশমন চায়, ফলে শান্তির বিষয়টিই প্রাধান্য পাবে। এ প্রোপটেই সৌদি-ইরান সমঝোতায় সিরিয়া সঙ্কট গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে আবির্ভূত হবে। সিরিয়ার ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ অঞ্চলের মতার ভারসাম্য অনেকটাই এই দেশটির ওপর নির্ভর করে। সিরিয়া সঙ্কট উভয় পরে সামর্থ্যই য় করেছে। পরিস্থিতি যে অবস্থায় পৌঁছেছে, তাতে করে এই সঙ্কটে কোনো এক প রাজনৈতিকভাবে নিরঙ্কুশ জয়ী হবে, এমনটা মনে করার কোনোই কারণ নেই।
সিরিয়া সঙ্কট সিরিয়া ও এর আশপাশের এলাকায় সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাতের অবনতি করেছে। ফলে সিরিয়া নিয়ে সমঝোতা হলে তা দেশটিতে রক্তপাত বন্ধ করবে, দেশটির সামর্থ্য যতটুকু রয়েছে, তা বহাল থাকবে এবং রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যকার দূরত্ব হ্রাসে আরো সহায়ক হবে।
ইরান ও সৌদি আরব উভয় দেশেই এবং এই অঞ্চলের কিছু কিছু শক্তিও এই সমঝোতার ফলে তিগ্রস্ত হবে। সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার সঙ্ঘাতের ফলে যেসব প লাভবান হচ্ছিল, তাদের অবস্থান নাজুক হয়ে পড়বে। বিপরীতে ইরান ও সৌদি আরব এবং এ অঞ্চলের মানুষ এই সমঝোতার ফলে লাভবান হবে।
অতীতের মতো ভবিষ্যতেও রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প হিসেবে বিরাজ করবে। মতাদর্শ দিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ কখনো নির্ধারিত হয়নি। সৌদি ও ইরানি নীতিনির্ধারকেরা সম্ভবত চার্চিলের সেই বিখ্যাত উক্তিটি শুনে থাকবেন: ‘আমাদের কোনো স্থায়ী বন্ধু নেই, স্থায়ী শত্র“ও নেই। আছে কেবল স্থায়ী স্বার্থ।’ আমরা নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, বর্তমানে চিত্র যতই ফ্যাকাশে মনে হোক না কেন, সৌদি-ইরান সঙ্ঘাতের অবসান ঘটতে যাচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে তারা শান্তির দিকেই পা বাড়াবে।