টার্কিস এয়ারলাইন্সের বিস্ময়কর অগ্রগতি
ইলিয়াস হোসেন: তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েব এরদোগানের নেতৃত্ব এক সময়ের ইউরোপের রুগ্ন দেশটি এখন মুসলিম বিশ্বের ‘সুপারপাওয়ার’। এশিয়া ও ইউরোপের সংযোগস্থলে অবস্থিত দেশটি গত কয়েক বছরে টানা ৮-৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছে।
তুরস্কের বিস্ময়কর উত্থানের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে দেশটির জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থা টার্কিস এয়ারলাইন্স।
কয়েক বছরের অব্যাহত প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের প্রথম চার মাসেই টার্কিস এয়ারলাইন্সের যাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে ১৯.৩ শতাংশ। বিমান সংস্থাটি জানুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে ১ কোটি ৬৬ লাখ যাত্রী বহন করেছে। ২০০৪ সালে বিমান সংস্থাটি যত যাত্রী বহন করেছিল, চলতি বছর প্রথম চার মাসেই বহন করেছে তার চেয়েও ৪৭ লাখ বেশি যাত্রী।
চলতি বছরের প্রথম চার মাসে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে ২৫.৮ শতাংশ এবং আন্তর্জাতিক রুটে ১৫ শতাংশ।
বর্তমানে ৪৩ টি অভ্যন্তরীণ এবং ২০৪টি আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রী পরিবহন করছে টার্কিস এয়ারলাইন্স।
কীভাবে এলো এই সাফল্য?
টার্কিস এয়ারলাইন্সের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী ড. তেমেল কোটিল জানালেন, ‘ভালো সেবা, ভালো খাবার এবং ভালো এয়ারক্রাফট-এটাই আমাদের সাফল্যের মূলমন্ত্র।’
গত ৮ মে ইস্তাম্বুলে টার্কিস এয়ারলাইন্সের সদর দফতরে বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রিত সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ড. কোটিল জানান, ২০৩০ সাল নাগাদ মধ্য এশিয়া এবং চীন সর্ববৃহত্ অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং ভারতীয় উপমহাদেশকে কেন্দ্র করে ব্যবসায় বাণিজ্যের প্রসার হবে অতি দ্রুত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও থাকবে সামনের কাতারে। এই বিষয়টিকে সামনে রেখে টার্কিশ এয়ারলাইন্স বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
আন্তর্জাতিক গণসংযোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের কয়েকটি সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের ইস্তাম্বুল সফরের আমন্ত্রণ জানায় টার্কিস এয়ারলাইন্স। সাংবাদিকদের সঙ্গে পরিচিত করানো হয় সংস্থাটির সদর দফতর, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, খাদ্য ও পানীয় প্রস্তুত কেন্দ্রসহ তাদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কর্মকাণ্ডের সঙ্বেগ। এর প্রতিটি বিভাগ দেখেই মুগ্ধ হন সাংবাদিকরা।
অ্যাভিয়েশন জগতে সেলিব্রেটি খ্যাত তেমেল কোটিল জানান, বাংলাদেশে দৈনিক দুটি করে ফাইট চালুর পরিকল্পনা আছে তাদের। খুব শিগগিরই সপ্তাহে ১০টি ফ্লাইট চলবে ঢাকা-ইস্তাম্বুল রুটে। এখন দৈনিক একটি করে ফাইট ঢাকা থেকে ইস্তাম্বুল সরাসরি যাতায়াত করে।
গন্তব্য স্থান বিবেচনায় বিশ্বের চতুর্থ সর্ববৃহত্ এয়ারলাইন্স মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে ২০১০ সালের বিজয় দিবসে তাদের কার্যক্রম শুরু করে বাংলাদেশে। ঢাকা থেকে করাচি হয়ে সপ্তাহে চারটি ফাইট ইস্তাম্বুল যেত। এই অল্প সময়ের মধ্যে এখন তাদের দৈনিক ফ্লাইট ঢাকা থেকে সরাসরি ইস্তাম্বুল যাতায়াত করছে।
প্রতিটি ফ্লাইটই থাকে যাত্রীতে ভরা। শুধু তাই নয়, বহু যাত্রীকে তারা ফেরত দিতে বাধ্য হচ্ছেন, আসন না থাকায়।
টার্কিস এয়ারলাইন্সের সাম্প্রতিক অগ্রগতি বিস্ময়কর। ১৯৩৩ সালে পাঁচটি এয়ারক্রাফট নিয়ে যে বিমান সংস্থার যাত্রা শুরু, তার বহরে আজ যুক্ত আছে ২৩০টি সর্বাধুনিক এয়ারক্রাফট। ২০২১ সাল নাগাদ উড়োজাহাজের সংখ্যা ৪৩৫টি করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে টার্কিস এয়ারলাইন্স।
সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১১, ’১২ ও ’১৩ সালে ইউরোপের সেরা বিমান সংস্থার মর্যাদা পেয়েছে টার্কিস এয়ারলাইন্স। ‘স্কাই ট্র্যাক্স’ টার্কিস এয়ারলাইন্সকে চার তারকা এয়ারলাইন্সে ভূষিত করেছে।
কর্মকর্তারা জানালেন, স্টার অ্যালায়েন্স নেটওয়ার্কের সদস্য টার্কিস এয়ারলাইন্স বাংলাদেশে তার ব্যবসায় ও সেবা দিয়ে একই সঙ্গে উজ্জীবিত এবং সন্তুষ্ট।
টার্কিস এয়ারলাইন্স তার গন্তব্য সম্প্রসারণে ঝুঁকিকে নয়, সেবাকেই প্রাধান্য দেয়- এ কথা জানিয়ে ড. তেমেল বাংলাদেশী সাংবাদিকদের বলেন, ‘সোমালিয়ার মতো দেশে আমরাই প্রথম আকাশ সেবা দেয়া শুরু করেছি। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এ রকম অনেক স্পর্শকাতর জায়গায় আমরা সেবা সম্প্রসারণ করেছি। তাতে কোনো সমস্যা হয়নি।’
কর্মকর্তারা জানান, ইস্তাম্বুলের দুটি বিমানবন্দরে বর্তমানে ২৪ ঘণ্টায় ১,২০০ বিমান ওঠানামা করে। কিন্তু এখন তাদের প্রয়োজন আরও বড় বিমানবন্দর। তাই নতুন একটি বিমানবন্দর তৈরির কাজ চলছে। এটি সম্পন্ন হলে ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ২,৬০০ বিমান ওঠানামা করবে এবং এটি হবে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম বিমানবন্দর।
টার্কিস এয়ারলাইন্স ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বার্ষিক ১৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, যা প্রতিযোগী বহু এয়ারলাইন্স থেকে অনেক বেশি। এ সময় বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বহু এয়ারলাইন্সই আর্থিক সংকটে পর্যুদস্ত হয়েছে। কেউ কেউ হয়েছে দেউলিয়া। তবে টার্কিস এয়ারলাইন্সের অগগ্রতিতে কোনো ছন্দপতন হয়নি।
বিমান সংস্থাটি ২০০৪ সালে যেখানে ১ কোটি ১৯ লাখ যাত্রী পরিবহন করে, সেখানে ২০১৩-তে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ কোটি ৮১ লাখে। ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ৫ কোটি ৯০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা কর্মকর্তাদের।
১০৫টি দেশে টার্কিস এয়ারলাইন্সের সেবা বিস্তৃত, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। ১০৫টি দেশের ২০৫টি আন্তর্জাতিক গন্তব্যের মধ্যে রয়েছে ইউরোপের ৪১টি দেশের ৯৬টি, দূরপ্রাচ্যের ২০টি দেশের ৩১টি, মধ্যপ্রাচ্যের ১৪টি দেশের ৩৪টি, আফ্রিকার ২৫টি দেশের ২৬টি, উত্তর আমেরিকার দুটি দেশে ছয়টি এবং দক্ষিণ আমেরিকার দুটি দেশের দুটি গন্তব্য।
পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও টার্কিস এয়ারলাইন্সের প্রবৃদ্ধি ঈর্ষণীয়। ২০০৫ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত এই প্রবৃদ্ধি ২২ শতাংশ। ইউরোপে এর অবস্থান ষষ্ঠ। ২০১৩ সালে পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার টন পণ্য পরিবহন করে সংস্থাটি। ইস্তাম্বুল স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত সংস্থাটির রাজস্ব আয় ও মুনাফা ঈর্ষণীয়।
২০১২ সালে সেন্টার ফর অ্যাভিয়েশনের তালিকায় দেখা যায়, সে বছর সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে টার্কিস এয়ারলাইন্স। বিশ্বের সেরা ৫০ এয়ালাইন্সের তালিকায় শুধু টার্কিস এয়ারলাইন্সই এক বছরেই ৭ ধাপ অগ্রগতি লাভ করে।
২০০৩ সালে সংস্থাটির কর্মীসংখ্যা ছিল ১০ হাজার ২৩৯ জন। ২০১৩ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ১৬০ জনে।
সংস্থাটি শুধু আকাশপথ সম্প্রসারণের মাধ্যমেই তাদের সেবা সীমাবদ্ধ রাখেনি। নিরাপত্তা এবং খাদ্য ও পানীয়ের মান উন্নয়নেও সদা সচেষ্ট।
তাদের নিজস্ব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের পর সেখানে মাত্র ১০ বছরে টার্কিস এয়ারলাইন্সসহ ১৬৫টি বিমান কোম্পানির পাইলট ও ক্রুরা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে বিদেশি পাইলটের সংখ্যা ৪৫০।
পাইলটদের হাতে-কলমে শিক্ষার জন্য যেমন রয়েছে ফ্লাইট সিমুলেশন, তেমনি ক্রুদের প্রশিক্ষণের জন্য সর্বাধুনিক ব্যবস্থা। দেশি-বিদেশি প্রশিণার্থীরা এখানে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকেন।
টার্কিস এয়ারলাইন্সের সহযোগী সংস্থা ডু অ্যান্ড কো খাদ্য প্রস্তুত এবং পরিবেশনের ক্ষেত্রে এরই মধ্যে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের যাত্রীদের রুচিকে প্রাধান্য দিয়ে তারা খাদ্য এবং পানীয় তৈরি করছে সর্বোচ্চ মান বজায় রেখে।
ইস্তাম্বুল ছাড়াও কয়েকটি স্থানে তাদের কেন্দ্র রয়েছে। শতভাগ তাজা এবং অকৃত্রিম উপকরণ দিয়ে তৈরি খাবার স্বল্পতম সময়ের মধ্যে বিভিন্ন বিমান সংস্থায় সরবরাহ করার জন্য তাদের রয়েছে বিশাল আয়োজন।
ডু অ্যান্ড কোর সেবা এয়ারলাইন্সের বাইরেও হোটেল এবং পর্যটন খাতেও সম্প্রসারিত হয়েছে। টার্কিস এয়ারলাইন্সের জনপ্রিয়তা বাড়াতে এটিও বড় ভূমিকা পালন করছে বলে জানালেন কর্মকর্তারা।
এই প্রতিষ্ঠানটির ৩ হাজার কর্মী দৈনিক প্রায় ৯ লাখ ৫০ হাজার লোকের খাবার তৈরি করে, যার একটা বড় অংশই বিমানযাত্রীদের জন্য।
টার্কিস এয়ারলাইন্সের পাশাপাশি অন্য এয়ারলাইন্সেও খাদ্য সরবরাহ করে থাকে ডু অ্যান্ড কো।
২০৩০ সাল নাগাদ সংস্থাটির ব্যাপ্তি বহুগুণ বাড়ানোর লক্ষ্য স্থির করেছে টার্কিস এয়ারলাইন্স।
ফ্লাইট সেফটির কমপ্লায়েন্স রক্ষায় আপসহীন, নির্ভরযোগ্যতায় অনন্য, পণ্যের বহর, সেবা ও প্রতিযোগিতায় নেতৃত্বের আসনে থেকেই ইউরোপসহ বাকি বিশ্বের আকাশপথে সেরার স্থানটা দখল করতে চায় টার্কিস এয়ারলাইন্স।