টাওয়ার হ্যামলেটসে নির্বাচনী লড়াই তুঙ্গে

Towerবৃটেনে জাতীয় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় নির্বাচনের আগেও রাস্তাঘাটে নির্বাচনী হুল্লোড় চোখে পড়ে খুবই কম। কিন্তু টাওয়ার হ্যামলেটস যেন তার ব্যতিক্রম। বিশেষ করে বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায় গেলেই টের পাওয়া যাবে নির্বাচনের উত্তাপ।
ব্রিকলেনে ফাস্ট ফুডের দোকানে বসেই একজন মোবাইল ফোনে তার পরিচিতজনদের কল করে যাচ্ছেন পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে।
‘নির্বাচনের ব্যাপারে বাংলাদেশিদের এই উৎসাহ একেবারে মজ্জাগত, কিন্তু অন্যান্য কিছু কারণে টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাচন যেন আরও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে’, বলছিলেন লন্ডনের বাংলা সংবাদপত্র ‘সাপ্তাহিক পত্রিকা’র সম্পাদক এমদাদুল হক চৌধুরি।
টাওয়ার হ্যামলেটস এখন লন্ডনের একটা দ্রুত বিকাশমান এলাকা। লন্ডন সিটি অর্থাৎ অর্থ-বাণিজ্যের কেন্দ্র ক্রমশ টাওয়ার হ্যামলেটসের দিকে সম্প্রসারিত হচ্ছে। ক্যানারি হোয়ার্ফে এখনই কয়েক লক্ষ মানুষ কাজ করেন। লন্ডনের পূর্ব-পশ্চিমকে সংযুক্ত করে যে ক্রস রেল তৈরি হচ্ছে, তা বদলে দেবে এই এলাকা। সব মিলিয়ে টাওয়ার হ্যামলেটস খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গা হয়ে উঠছে। তাই সব দলই আগ্রহী এটার নিয়ন্ত্রণ পেতে।
টাওয়ার হ্যামলেটস বরাবরই লেবার পার্টির শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। কিন্ত গতবার তারা এখানে লজ্জাজনকভাবে হেরেছিল তাদের দলেরই এক বিদ্রোহী প্রার্থী লুৎফর রহমানের কাছে। লেবার পার্টি তাঁকে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়েও আবার তা প্রত্যাহার করে নেয়। তখন তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে মেয়র নির্বাচিত হন।
এমদাদুল হক চৌধুরি বলেন, গতবারের ঐ ঘটনায় লেবার পার্টি একটা বড় ধাক্কা খেয়েছিল। এবার তারা হাতছাড়া হয়ে যাওয়া এই কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণের জন্য মরিয়া। নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী জন বিগসের সঙ্গেই বর্তমান মেয়র লুৎফর রহমানের মূল লড়াই হবে বলে মনে করেন তিনি।
পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের মেয়র লুৎফর রহমান বৃটেনের রাজনীতিতে সবচেয়ে ক্ষমতাবান এবং প্রভাবশালী ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের একজন।
মেয়র লুৎফর রহমানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল ক্যানারি হোয়ার্ফের কাছে তার বিশাল অফিসে। গত কয়েক বছরে তার প্রশাসনের বিভিন্ন সাফল্যের কথা তুলে ধরছিলেন তিনি।
‘আমরা গত সাড়ে তিন বছরে চার হাজার নতুন বাড়ি তৈরি করেছি, আগামী চার বছরে আমরা আরও সাড়ে পাঁচ হাজার নতুন বাড়ি করব। আমরা স্কুল-কলেজের ছেলে মেয়েদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছি, শিক্ষা ভাতার ব্যবস্থা করেছি। কেন্দ্রীয় সরকার যখন সব খাতে খরচ কাট-ছাঁট করছে, তখন আমরা বরং মানুষের কল্যাণে খরচ আরও বাড়াচ্ছি’, বলছিলেন তিনি।
কিন্তু মেয়র লুৎফর রহমান গত সাড়ে তিন বছর ধরে যেভাবে তার প্রশাসন পরিচালনা করেছেন, যেভাবে তিনি তার নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন, সেটা নিয়ে নানান অভিযোগ তুলেছেন তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এবং সমালোচকরা। কয়েক সপ্তাহ আগে বিবিসির প্যানোরামা অনুষ্ঠানের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নিয়ে হৈ-চৈ শুরু হয়েছিল বৃটেনের জাতীয় রাজনীতিতে।
মেয়র লুৎফর রহমান তার নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে তার নিজের সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন –এটাই প্যানোরামার এই প্রতিবেদনের মূল অভিযোগ।
মেয়র নির্বাচনে লুৎফর রহমানের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী লেবার পার্টির জন বিগস, তিনিও নির্বাচনী প্রচারের সময় এই একই অভিযোগ তুলছেন তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে।
জন বিগস মনে করেন, বর্তমান মেয়র যেভাবে প্রশাসন চালাচ্ছেন, তা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছে।
‘আমি বলছি না যে বর্তমান মেয়র সবার জন্য কাজ করছেন না। কিন্তু টাওয়ার হ্যামলেটসের একটি নির্দিষ্ট চক্রকেই তিনি সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন, এরকম একটি ধারণা কিন্তু তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে। তিনি যেভাবে কাজ করছেন তার মধ্যে কোনো স্বচ্ছতা নেই।’
লুৎফর রহমান অবশ্য তার বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগকে শুরু থেকেই জোর গলায় অস্বীকার করেছেন, তিনি মনে করেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে তার ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই প্রচারণা চালানো হয়েছে।
ভোটের অঙ্ক
টাওয়ার হ্যামলেটসের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ বাংলাদেশি। নির্বাচনে হার-জিৎ নির্ধারণে তারা বড় ভূমিকা রাখেন। স্বাভাবিকভাবেই তাদের সমর্থনের ওপরই অনেকখানি নির্ভর করছেন লুৎফর রহমান।
এবার টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দশজন প্রার্থী।
‘সন্দেহ নেই যে এই বাংলাদেশিদের ভোট যদি কোন একক প্রার্থীর পক্ষে পড়ে, তাহলে নির্বাচনী লড়াইয়ে তিনি অনেক এগিয়ে থাকবেন। কিন্তু তারপরও চূড়ান্ত ফল কিন্তু নির্ভর করবে এলাকার অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ কিভাবে ভোট দিচ্ছেন তার ওপর’, বলছিলেন এমদাদুল হক চৌধুরি।
গতবারের নির্বাচনে প্রধান সব প্রার্থীই ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত। ফলে নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশিদের মধ্যে যত উৎসাহ ছিল, অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ সেভাবে ভোট দিতে আসেননি। এবার ভোট দানের হার কেমন হয়, সেটা নির্বাচনী ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
আবাসন সংকটের পর টাওয়ার হ্যামলেটসে সম্প্রতি বড় হয়ে উঠেছে মাদকের সমস্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে অপরাধ। এর সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশি ছেলে-মেয়েরাও। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেকে।
‘এখানে ড্রাগ ফাইট, গ্যাং ফাইট বাড়ছে। অনেক তরুণ এসবে জড়িয়ে মারা গেছে গত কয়েক বছরে। আমি চাইবো এসব বন্ধে পদক্ষেপ নেয়া হোক’, বলছিলেন একজন বাংলাদেশি ভোটার।
উচ্ছেদের আতংক
ভোটারদের উদ্বেগ শুধু আবাসন, অপরাধ আর শিক্ষা নিয়ে নয়, যেভাবে সচ্ছল মধ্যবিত্তরা এসে টাওয়ার হ্যামলেটস থেকে গরীবদের হটিয়ে দিচ্ছে সেটা নিয়েও।
এক সময়ের দরিদ্র এলাকা টাওয়ার হ্যামলেটস এখন দ্রুত বদলে যাচ্ছে। সিটি বা লন্ডনের বাণিজ্যিক এলাকা এখন সম্প্রসারিত হচ্ছে টাওয়ার হ্যামলেটসের দিকে। হোয়াইট চ্যাপেলের রাস্তার মার্কেট তুলে দেয়ার পরিকল্পনা চলছে।
এ নিয়ে উদ্বিগ্ন মার্কেটের একটি স্টলের মালিক জাকির হোসেন।
তিনি বলেন, ‘যিনিই মেয়র হয়ে আসুন, আমি চাইবো, আমাদের যেন এখান থেকে উচ্ছেদ করা না হয়। এই মার্কেট যেন বড় কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দেয়া না হয়।’
নির্বাচনে দুই প্রধান প্রার্থীই অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, টাওয়ার হ্যামলেটসের যে রিজেনারেশন বা পুরোনা জায়গা ভেঙ্গে নতুন উন্নয়ন কাজ চলছে, তাতে গরীবরা যাতে ক্ষতিগ্রস্থ না হন, সেটা তারা দেখবেন।
নির্বাচনী প্রচারে প্রার্থীদের এসব অঙ্গীকারে অবশ্য পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারছেন না ভোটাররা।
টাওয়ার হ্যামলেটসের মানুষের সামনে এখন একদিক সমৃদ্ধির হাতছানি, আরেকদিকে এখানকার গরীব মানুষ আছেন উচ্ছেদের আশংকায়। সামনের সপ্তাহের নির্বাচনে যে নতুন মেয়র ক্ষমতাসীন হবেন, তার হাতেই নির্ধারিত হবে তাদের ভাগ্য।
প্রার্থী যারা
টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দশজন প্রার্থী। এরা হচ্ছেন:
রীতেন্দ্র ব্যানার্জী, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি
জন বিগস, লেবার পার্টি
রেজা চৌধুরি, স্বতন্ত্র প্রার্থী
হাফিজ কাদির, স্বতন্ত্র প্রার্থী
মোহাম্মদ খান, স্বতন্ত্র প্রার্থী
নিকোলাস ম্যাককুইন, ইউকে ইন্ডিপেনডেন্স পার্টি
হিউগো পিয়ের, ট্রেড ইউনিয়নিস্ট এন্ড সোশ্যালিস্ট কোয়ালিশন
লুৎফর রহমান, টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট
ক্রিস স্মিথ, গ্রীন পার্টি
ক্রিস্টোফার উইলফোর্ড, কনজারভেটিভ পার্টি
সূত্র: বিবিসি

আরও পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button