দেশ এখন আতংকের জনপদ : খালেদা
দেশের মানুষের জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন উল্লেখ করে বিএনপির চেয়ারপারসন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, প্রিয় স্বদেশ আজ মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত। বাংলাদেশ এখন এক আতংকের জনপদ। যেন কোনো শাসন নেই, সরকার নেই, প্রশাসন নেই। আছে কেবল ত্রাস। আছে নিরাপত্তাহীনতা। ঘরে, রাস্তাঘাটে, অফিসে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কোথাও কেউ নিরাপদ নয়। যে-কোনো মুহূর্তে যে-কেউ খুন, অপহরণ, নিখোঁজ হবার ভয়।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক তাৎক্ষণিক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি একথা বলেন। বেগম জিয়া বলেন, নাগরিকদের রক্ষা করার, নিরাপত্তা দেয়ার যেন কোথাও কেউ নেই। খালে-বিলে, নদী-নালায়, যেখানে-সেখানে পাওয়া যাচ্ছে লাশ আর লাশ। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তরুণেরা খুন হচ্ছে। নির্যাতন চালিয়ে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে। এসময় গত কয়েক মাসে ঢাকা মহানগরিতে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা উপস্থিত ছিলেন।
বেগম জিয়া বলেন, পাঁচ বছরে সারা দেশে শত শত নাগরিককে বলপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়ে উধাও করে দেয়া হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জোর করে তুলে নিয়ে যাবার ঘটনা ঘটেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী, বিশেষ করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন বা র্যাব পরিচয়ে। তারা আর ফিরে আসেনি। স্বজনেরা প্রতীক্ষার প্রহর গুণছে আজো। ঘরে ঘরে উঠেছে কান্নার রোল। এদের বাবা-মা, সন্তান ও ভাই-বোনেরা জানেনা তারা বেঁচে আছে, নাকি তাদেরকে মেরে ফেলা হয়েছে। কেননা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের গ্রেফতারের কথা স্বীকার করেনি।
সারাদেশে এক পৈশাচিক তা-ব চলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ক’দিন আগে নারায়ণগঞ্জে সিটি কর্পোরেশনের একজন কাউন্সিলার ও একজন আইনজীবীসহ সাতজনকে অপহরণ করে হত্যা এবং দেখে ফেলায় আরো চারজনকে খুন করার নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। পেট কেটে ইট ভরে শীতলক্ষ্যায় ডুবিয়ে দেয়া তাদের লাশ ভেসে ওঠা এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সৈয়দ রিজওয়ানা হাসানের স্বামীকে অপহরণ ও রহস্যজনক মুক্তির ঘটনায় সৃষ্ট আতংকের রেশ মানুষের মন থেকে এখনো দূর হয়নি। কিন্তু এই পৈশাচিকতার অবসান ঘটছে না।
বেগম জিয়া বলেন,এই র্যাব আমরাই গঠন করেছিলাম। পবিত্র ধর্ম ইসলামের নাম ব্যবহার করে যে জঙ্গিবাদী সন্ত্রাস মাথাচাড়া দিয়েছিল তা দমন, ভয়ংকর সামাজিক অপরাধীদের নির্মূল করা এবং অস্ত্র ও মাদক চোরাচালান রোধে এই বাহিনী ব্যাপক সাফল্য ও সুনাম অর্জন করেছিল। জঙ্গিবাদের হোতাদের শনাক্ত করে গ্রেফতার ও বিচারের মাধ্যমে শাস্তিবিধান, র্যাবের কারণেই দ্রুত সম্ভব হয়েছিল। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের উৎখাত করার ব্যাপারেও র্যাব অসামান্য সাফল্যের পরিচয় দিয়েছিল। এসব কারণে জনজীবনে স্বস্তি, নিরাপত্তা ও শাস্তি ফিরে এসেছিল। র্যাব জনগণের বিপুল আশীর্বাদ ও সমর্থনপুষ্ট হয়েছিল। তাদের দিয়ে সম্পূর্ণ অনৈতিক ও বেআইনী পন্থায় বিরোধী দলের আন্দোলনকে দমনের উদ্দেশ্যে সারা দেশে গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীদের বিচার বহির্ভূত হত্যা করানো হয়েছে। অপহরণ করানো হয়েছে।
হত্যা, অপহরণ, সম্পদ দখলের কাজে র্যাবের এক শ্রেণীর সদস্যের নাম জড়িয়ে গেছে। র্যাব কলংকিত হওয়ার কারণে আমাদের দেশপ্রেমিক সশস্ত্রবাহিনীর সুনামও ক্ষুণœ হওয়ার আশংকা সৃষ্টি হয়েছে। এটা আমরা মেনে নিতে পারি না। এর সব কিছুর জন্যই সরকার দায়ী হচ্ছে। তাদের পরিকল্পনা ও নির্দেশেই আজ এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সেই দায়ভার মাথায় নিয়ে সরকারকেই র্যাব বিলুপ্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে আমি মনে করি, যে উদ্দেশ্যে র্যাব গঠিত হয়েছিল সেই কাজগুলো অব্যাহত রাখতে আইনি ব্যবস্থার আওতায় শৃঙ্খলাবোধ ও নৈতিকমানসম্পন্ন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিপূর্ণ একটি দায়িত্বশীল, দক্ষ, প্রশিক্ষিত কাঠামো আমাদের গড়ে তুলতে হবে। আমরা আর একটি হত্যাকা-ও দেখতে চাই না। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বেআইনী কার্যকলাপও যেন আর না ঘটে।
দিক নির্দেশনা দিয়ে বেগম জিয়া বলেন, অপহরণের মতো করে কিংবা রাতের অন্ধকারে কোনো গ্রেফতার করা আর চলবে না। কাউকে গ্রেফতার করতে হলে সাক্ষী রেখে, পুলিশ ও প্রয়োজনে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে অভিযোগ উল্লেখ করে তারপর গ্রেফতার করতে হবে। রিমান্ডের নামে নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। আটক অবস্থায় কোনো বন্দী নিহত বা আহত হলে তা বিচারের আওতায় আনতে হবে।
বেআইনীভাবে বন্ধ করে রাখা ভিন্নমতের সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো অনতিবিলম্বে খুলে দেয়ার দাবি জানিয়ে বলেন, আটক সম্পাদক ও সাংবাদিকদের মুক্তি দিতে হবে। একই সাথে অবৈধ সরকারকে পদত্যাগ করে একটি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ব্যবস্থার অধীনে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান।
অপহৃত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- ইফতেখার আহমেদ দিনার, মো. জহির, সেলিম রেজা, আসাদুজ্জামান, সম্রাট মোল্লা, মাজহারুল ইসলাম রাসেল, পারভেজ হোসেন, চঞ্চল, আল-আমিন, খালেদ হোসেন সেলিম, সাজেদুল ইসলাম সুমন, আবদুল কাদের ভূঁইয়া মাসুম (তানভির), এ এম আদনান চৌধুরী, নিজাম উদ্দিন মুন্না, কাউসার, মো. তরিকুল ইসলাম, মাহবুব হোসেন সুজন, কাজী ফরহাদ, তরিকুল ইসলাম তারা, মফিজুল ইসলাম রাশেদ প্রমুখ।
এ ছাড়া বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অপহৃত এম ইলিয়াস আলী ও বিএনপি নেতা চৌধুরী আলম পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত রয়েছেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গণি, এম তরিকুল ইসলাম, মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, সেলিমা রহমান, উপদেষ্টা পরিষদের এম এ মান্নান, যুগ্ম মহাসচিব আমান উল্লাহ আমান, বরকত উল্লাহ বুলু, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, খোন্দকার গোলাম আকবর, অর্থনৈতিক বিষয়ক সম্পাদক আব্দুস সালাম, মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন আহমেদ অসীম, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক নাজিম উদ্দিন আলম, প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবেদীন ফারুক, সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক আবুল খায়ের ভূঁইয়া, শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক খায়রুল কবীর খোকন, ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, সহ-ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু, ছাত্র দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল বিজেপির চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ, শিক্ষাবিদ ড. পিয়াস করিম প্রমুখ উপস্থিত রয়েছেন।