যুক্তরাজ্য বিএনপির সভায় তারেক রহমান
শেখ হাসিনা দেশকে গুম-খুনের রাজত্বে পরিণত করেছেন
বর্তমান সরকারকে অবৈধ মন্তব্য করে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘদিন রাজনীতি করার পরও মাত্র ১১ মিনিটের মাথায় দেশে বাকশাল কায়েম করেছিলেন। দেশে গণতন্ত্রের অধিকার হরণ করেছিলেন। তারি ধারাবাহিকতায় তার কন্যা শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ অবৈধভাবে দেশ ও বিশ্বের জনমত উপেক্ষা করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি দেশকে এখন গুম-খুনের রাজত্বে পরিণত করেছেন।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ৩৩তম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষ্যে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বুধবার বিকালে পূর্ব লন্ডনস্থ ইলফোর্ডের প্রভা ব্যাংকুয়েটিং হলে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
পুরো অনুষ্ঠান দর্শকসারিতে বসে ছিলেন তারেক রহমান। পরে নেতাকর্মীদের অনুরোধে বক্তব্য রাখেন তিনি।
জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমানসহ দেশের রাজনীতিবিদরা স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান জনগণের ভাষা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি সামরিক অফিসার হয়েও দেশের মুক্তির জন্য স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। নিজে প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জন করেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিব জনগণের লড়াই সংগ্রাম এবং কঠিন আত্মত্যাগ দেখেননি, অথচ স্বাধীনতার পর পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে তিনিই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এসে ক্ষমতায় বসেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে মা ভাই কিংবা আত্মীয় স্বজন হারানো যেইসব মানুষ ৭২ সালের ১০ জানুয়ারী স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবকে স্বাগত জানাতে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলেন তাদের সামনে শেখ মুজিব আসেন পকেটে পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়ে। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের নাগরিকদের সাথে এর চেয়ে বড় প্রতারণা আর কি হতে পারে?
তারেক রহমান বলেন, শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালে মাত্র কয়েক মিনিটে গণতন্ত্রকে হত্যা করেন, নিজ দল আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত করেন। জনগনকে ১৯৭৪ এর দূর্ভিক্ষ উপহার দেন। তার শাসনামলে ঘরে বাইরে জনগনকে অনিরাপদ করে তোলা হয়েছিলো।
আওয়ামী লীগের কথায় কাজে মিল নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব তার ৩০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন সেখানে মাত্র পাঁচ বছরের রাজনৈতিক জীবনে সবখানেই সফল হয়েছেন বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। দেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ধারায় ফিরিয়ে এনেছেন। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তন করেছেন। আজকে রেমিটেন্স এবং গার্মেন্টস সেক্টরের যে বিকাশ তাও শুরু হয়েছিলো জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের শ্রমবাজারও উন্মুক্ত হয়েছিলো জিয়াউর রহমানের সময়।
তারেক রহমান ১৯৭৩ সালের ৬ জুলাই জাতীয় সংসদে দেওয়া তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বিবৃতি তুলে ধরে বলেন, ‘১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের জুন পর্যন্ত এই সময়কালে দেশে ২ হাজার ৩৫টি গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটেছিল এবং দুষ্কৃতিকারীদের হাতে প্রাণ হারান ৪ হাজার ৯শ’ ২৫ জন।
দেশে গুম খুনের সঙ্গে খোদ শেখ হাসিনা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষাভাবে জড়িত রয়েছেন উল্লেখ করে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, দেশে এখন আর কারো জীবনই নিরাপদ নয়। আওয়ামী দুঃশাসনে জনগনের অবস্থা এতটাই ভয়ংকর অবস্থায় পৌছেছে যে, জনগণ বলতে শুরু করেছে, “ওরা মানুষ নয়, আওয়ামী লীগ’’। এমন কোন অপকর্ম নেই যা আওয়ামী লীগ করতে পারেনা। যেই আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবকে নেতা বানিয়েছে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারী সেই আওয়ামী লীগকে গলাটিপে হত্যা করতেও তিনি দ্বিধাবোধ করেননি।
তারেক রহমান বলেন, নারায়নগঞ্জে সাত জনকে গুম করার পাঁচ মিনিটের মধ্যে জানলেও নিজ দলের নেতাকর্মীদের বাঁচাতে শেখ হাসিনা কোন পদক্ষেপ নেননি । তিনটি ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর প্রতিটি ঘটনা প্রমাণ করে দেশে চলমান গুম খুনের সঙ্গে খোদ শেখ হাসিনা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষাভাবে জড়িয়ে পড়েছেন।
বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনীর নির্মম হত্যাকান্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই হত্যাকারীরা ধরা পড়বে। এরপর হাজার ঘন্টা পার হলেও এই ঘটনার রহস্য বের হয়নি। সেই সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, সাগর রুনী হত্যা মামলার তদন্ত সরাসরি তত্ত্বাবধান করছেন শেখ হাসিনা। প্রশ্ন্ন হলো শেখ হাসিনা নিজে একটি হত্যাকান্ডের তত্তা্ববধান করার পরও মামলার রহস্য বের না হওয়ায় প্রমাণ করে “ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’’।
তিনি বলেন, ২৭শে এপ্রিল নারায়নগঞ্জে সাতজনকে দিনে দুপুরে অপহরণ করে হত্যা করে লাশ ফেলে দেয়া হয় নদীতে। ওই এলাকার আওয়ামী লীগেরই একজন অনির্বাচিত এমপি জানিয়েছেন, পাঁচ মিনিটের মধ্যে তিনি শেখ হাসিনাকে অপহরনের ঘটনা জানিয়েছেন। শেখ হাসিনাকে জানানোর পরও অপহৃতদের উদ্ধার করতে ব্যর্থ হওয়ায় এইসব হত্যাকান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার দায় শেখ হাসিনা কোনভাবেই এড়াতে পারেন না।
ফেনীর উপজেলা চেয়ারম্যান হত্যাকান্ড প্রসঙ্গে তারেক রহমান বলেন, ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার নির্বাচিত চেয়ারম্যান একরামকে প্রকাশ্যে দিনে দুপুরে গুলী করে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। বিকালেই শেখ হাসিনার অফিস থেকে হত্যাকান্ড সম্পর্কে বিরোধী দলকে জড়িয়ে বিবৃতি দিয়ে আইন শৃংখলাবাহিনীকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা করা হয়। অথচ ওই ঘটনায় যারাই গ্রেফতার হয়েছেন তারা সবাই আওয়ামী লীগেরই নেতাকর্মী। তাই শেখ হাসিনার এই অপতৎপরতা সম্পর্কে জনমনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
গুম-খুনের ঘটনায় র্যাবের ভূমিকার সমালোচনা করে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, র্যাবকে সরকার পেটুয়া বাহিনীতে পরিণত করেছে। র্যাবে যোগ্য অফিসারদের বদলে সরকার মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনদের ঢুকিয়ে দেশ ব্যাপী গুম-খুন করাচ্ছে। তিনি বলেন, সারা দেশে জনগণ র্যাব বিলুপ্তির দাবি জানিয়েছে। এ পেটুয়া বাহিনীর দ্বারা দেশের আইনশৃঙ্খলার আর কোন উন্নতি হবে না। জনগণ র্যাব বন্ধের দাবি জানিয়েছে, এ দাবি তাদের সাথে আমারও।
তিনি বলেন, সন্ত্রাস দমনে বিএনপির শাসনামলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো এলিট ফোর্স র্যাব। র্যাব প্রতিষ্ঠার পর দেশের সাধারণ মানুষ স্বস্তির নিংশ্বাস ফেলেছিলো আর সন্ত্রাসীরা ছিলো আতংকে। অথচ আওয়ামী লীগের অবৈধ শাসনামলে র্যাবের ভয়ে সাধারণ মানুষ আতংকে আর সন্ত্রাসীরা নিরাপদে। এখন আওয়ামী সন্ত্রাসীদের পক্ষ হয়ে র্যাব টাকার বিনিময়ে মানুষ খুন করে, গুম অপহরণ করে, এই অভিযোগ সাধারণ মানুষের। জনগণের কাছে আওয়ামী রক্ষীবাহিনীর বিকল্প হিসেবে পরিচিতি পাওয়া এই র্যাবের প্রতি জনগণের আর বিন্দুমাত্র আস্থা নেই।
সরকার বিরোধী আন্দোলনে সবাইকে এক হবার আহবান জানিয়ে তারেক রহমান বলেন, আমি দেশে বিদেশে অবস্থানরত সব জাতীয়তাবাদী আদশের্র মানুষের কাছে আহবান জানাবো, আপনারা সরকারের খুন, গুম, হত্যা-নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হন। এর প্রতিবাদে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে আন্দোলনের ডাক দিবেন তাতে স্ব-স্ব অবস্থান থেকে আপনারা ঈমানদারীর সাখে এগিয়ে আসুন। নিজে বাঁচতে, পরিবারকে বাঁচাতে, দেশ ও জনগনকে বাঁচাতে কঠোর গণআন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার অবৈধ। এটা বাকশাল সরকারের এপিট-ওপিট। শেখ হাসিনা সরকার দেশে বাকশাল কায়েম করতে চাচ্ছে।
অনুষ্ঠান শেষে র্যাবের বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও নির্মম নির্যাতন নিয়ে “ক্রসফায়ার“ নামে ১৪ মিনিটের একটি তথ্য চিত্র প্রদর্শিত হয়। একইসঙ্গে প্রথম স্বাক্ষর দিয়ে “ডিজব্যান্ড র্যাব’’ নামে দেশেবিদেশে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান কর্মসূচী শুরু করা হয়।
যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি শাইস্তা চৌধুরী কুদ্দুসের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক কয়সর আহমদের পরিচালনায় আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন ও উপস্থিত ছিলেন, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মাহিদুর রহমান, প্রফেসর ড. কে এম এ মালিক, যুক্তরাজ্য বিএনপির সাবেক আহবায়ক এম এ মালেক, সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মিয়া মনিরুল আলম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার এম এ সালাম, যুক্তরাজ্য বিএনপির সিনিয়র সহসভাপতি আব্দুল হামিদ চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ ও তৈমুছ আলী, যুগ্ম সম্পাদক নাসিম আহমদ চৌধুরী, বগুড়া জেলা বিএনপি সভাপতি সাইফুল ইসলাম, যুক্তরাজ্য বিএনপি সহ সভাপতি তাজুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন খোকন, উপদেষ্টা নসরুল্লাহ খান জুনায়েদ, যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল ইসলাম মামুন, সহকারি যুগ্ম সম্পাদক সাদিক মিয়া, ফেরদৌস আলম, হেলাল নাসিম উজ্জামান, তাজ উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক আজমল হোসাইন জাবেদ, যুক্তরাজ্য জাসাস সভাপতি এম এ সালাম, স্বেচ্ছাসেবক দল যুগ্ম আহবায়ক মিসবাহুজ্জামান সুহেল, সদস্য সচিব আবুল হোসাইন, তরুণ দলের আহবায়ক আব্দুল বাসির খান প্রমুখ।
সভার শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন যুক্তরাজ্য বিএনপির সহসভাপতি গোলাম রব্বানী এবং মোনাজাত পরিচালনা করেন মাওলানা বাকিবিল্লাহ।
আলোচনাসভায় যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন প্রান্থ থেকে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীবৃন্দ এসে যোগ দেন।