আসছে আড়াই লাখ কোটি টাকার বাজেট
হেলাল উদ্দিন: বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বিশাল আকার আগামী বাজেটের সব হিসাব ওলটপালট করে দিয়েছে। সার্বিকভাবে উন্নয়ন কর্মসূচির আকার বেড়ে যাওয়ায় বাজেটের আকারও বাড়ছে। এবারের বাজেটে আয়ের চেয়ে ব্যয়ের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যাওয়ায় বাজেট ব্যবস্থাপনায় সামঞ্জস্য রাখা যাচ্ছে না। ফলে অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাচ্ছে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ। মাত্রাতিরিক্ত ঘাটতির কারণে এবারও সরকার বাজেটে ঋণনির্ভরতা বাড়াচ্ছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার আড়াই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাজেটে সব মিলে আয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। ঘাটতি রাখা হয়েছে ৬৭ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা। এই ঘাটতি ব্যাংক ঋণ, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানের অর্থে মেটানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
শেষ মুহূর্তে এসে এডিপির আকার বড় করায় মন্ত্রণালয়ওয়ারি বরাদ্দ এখন আর আগেরটি ঠিক নেই। ফলে এখন নতুন করে আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকরা শেষ মুহূর্তে মন্ত্রণালয় অনুযায়ী বরাদ্দ সাজাচ্ছেন। এক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক কর্মসূচি, মন্ত্রীদের দাবিকেও প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। এছাড়া জনতুষ্টির দিকগুলোও বিশেষ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
বাজেটকে সামনে রেখে অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মকর্তারা এখন দিন-রাত কাজ করছেন। শেষ মুহূর্তে তারা হিসাব কষছেন প্রাপ্তি আর ব্যয়ের বিশাল ফারাক কিভাবে মেলানো যায়। এই ফারাক মেলাতে গিয়ে যাতে জনগণের ওপর বাড়তি চাপ না পড়ে সেদিকেও দৃষ্টি রাখছেন।
বুধবার দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, শেষ পর্যন্ত ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ৫০ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত এই বাজেট ইতিমধ্যে অনুমোদন করেছেন। এডিপির আকার, রাজস্ব আয়, ব্যাংক ও বিদেশী ঋণের হিসাব ধরে বুধবার বিকালে এই হিসাব চূড়ান্ত হয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর এই অংক সামান্য হেরফের হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। হলেও তা কয়েকটি সুনির্দিষ্ট খাতে কমানো বা বাড়ানো হবে। এই অংক ৫ থেকে ১০ কোটি টাকা বাড়তে বা কমতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। তবে সেটি হবে কেবল প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার ভিত্তিতেই। এর চেয়ে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হবে না বলে একাধিক সূত্র দাবি করেছে।
আগামী ৫ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৪-১৫ অর্থবছরের এই বাজেট উপস্থাপন করবেন। গত ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর এটাই সরকারের প্রথম বাজেট। এদিকে এই মেয়াদে এটাই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রথম বাজেট। এর আগে আগের সরকারের সময়েও তিনি টানা ৫টি বাজেট উপস্থাপন করেছেন।
এবারের বাজেটে সরকার জনতুষ্টির বিষয়গুলোকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে- অবকাঠামো নির্মাণ, পদ্মা সেতু নির্মাণ, কর্মসংস্থান প্রকল্পের মতো জনস্বার্থ বিষয়ক কর্মকাণ্ড। সরকারি চাকরিজীবীদের সন্তুষ্ট করার জন্যও থাকছে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়ানো হচ্ছে। যদিও ভর্তুকির পরিমাণ কমানো হচ্ছে। আর্থিক খাতে শৃংখলা রাখতে এবারও সরকারি ব্যাংকগুলোর জন্য বিশেষ বরাদ্দ থাকছে। কৃষি ঋণের আওতা আরও বাড়ানো হচ্ছে।
প্রতি বছরের বাজেটেই দাতাদের একটি ভূমিকা থাকে। তাদের চাপে সরকার অনেক রাজনৈতিক ও সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড সংকুচিত কলেবরে নিয়ে থাকে। এবারের বাজেটেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) বাজেটকে সামনে রেখে অনেক প্রস্তাব করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে। তাদের ঋণ নেয়ার কারণে সেগুলোর ওপরও গুরুত্ব দিতে হচ্ছে।
জানা গেছে, বাজেট নিয়ে সংখ্যার পরিবর্তন ঘন ঘন হচ্ছে। শেষ মুহূর্তে এসে এই পরিবর্তনও কমে যাচ্ছে। এখন শুধু সামান্য পরিবর্তন হচ্ছে। যদিও এর আগে প্রাক্কলিত বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৪৯ হাজার ১৮ কোটি টাকা। বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানোর কারণে এর আকার বেড়েছে।
সূত্র জানায়, নতুন হিসাবে এখন পর্যন্ত বাজেট ঘাটতি দাঁড়াচ্ছে ৬৭ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এই ঘাটতি ছিল ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের তুলনায় ঘাটতি বেড়ে যাবে ১২ হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। এর আগে যেমন এত বড় অংকের বাজেট হয়নি, তেমনি এত বড় ঘাটতি বাজেটও হয়নি। এই ঘাটতি জিডিপির হিসাবে দাঁড়াবে ৫ দশমিক ০৫ শতাংশে। আগামী অর্থবছরের জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৩ লাখ ৩৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
জানা গেছে, বাজেটে ঘাটতি অর্থায়ন মেটাতে বৈদেশিক সূত্র থেকে ২৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে ৪০ হাজার ৭৩ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সংগৃহীত হবে ৩১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ৮ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা। যদিও চলতি অর্থবছরে সরকার নির্ধারিত অংকের চেয়েও কম পরিমাণে ঋণ দিয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী বুধবার পর্যন্ত যে হিসাব চূড়ান্ত হয়েছে তা হচ্ছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাজেটে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে মোট ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, যা দেশের মোট জিডিপির ১৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ। বাজেটে অনুন্নয়নসহ অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ রাখা হচ্ছে ১ লাখ ৬৯ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। এটি দেশের জিডিপির ১২ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এই ব্যয়ের একটি বড় অংশ খরচ হবে বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য খাতে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা, যা মোট জিডিপির ৫ দশমিক ৯৯ শতাংশ। সামাজিক অবকাঠামো, ভৌত অবকাঠামো ও সাধারণ সেবা খাত এই ৩টি শ্রেণীকে বিভাজন করেই বাজেটের সামগ্রিক ব্যয় কাঠামো ঠিক করা হয়েছে।
অপরদিকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। জিডিপির হিসাবে ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) খাত থেকে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৭২০ কোটি টাকার কর রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে। এনবিআরবহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ হাজার ১৪০ কোটি টাকার। করবহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ২৭ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের বড় অংশই আসবে এনবিআর খাত থেকে।
সূত্র মতে, আগামী বাজেটে ৬৭ হাজার ৭৭৩ কোটি টাকার বিশাল ঘাটতি অর্থায়নের জোগাড় হবে কোথা থেকে? এ নিয়েও হিমশিম খাচ্ছেন বাজেট প্রণেতারা। যদিও বৈদেশিক সাহায্য এবং ব্যাংক ঋণ থেকে অর্থায়ন ধরে নজিরবিহীন এই ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। কিন্তু বৈদেশিক সহায়তা অপ্রতুল হওয়ায় ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেই প্রায় ৩১ হাজার ৫শ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি ঋণজনিত কারণে মূল্যস্ফীতির হার কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ায়, বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কেমন থাকবে এসব নিয়েও ভাবতে হচ্ছে নীতিনির্ধারকদের। কেননা গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নেয়ার কারণে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে গিয়েছিল। চলতি অর্থবছরে ঋণ প্রবাহ কমার কারণে মূল্যস্ফীতির হারও কমেছে। চলতি অর্থবছর এই ঋণ বরাদ্দের পরিমাণ ২৫ হাজার ৯৯৩ কোটি টাকা। প্রাথমিক হিসাবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল ৩০ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। কিন্তু এখন তা বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৩১ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়াচ্ছে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা। আগামী এডিপিতে অতিরিক্ত বরাদ্দ ১ হাজার ২৮৪ কোটি টাকার পুরোটাই ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় ৭৯ হাজার ৩১ কোটি টাকার এডিপি প্রস্তাব করেছিল পরিকল্পনা কমিশন। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৫১ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব ছিল। আর বিদেশী উৎস থেকে সংগ্রহ করার প্রস্তাব ছিল ২৭ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী আরও ১ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা যোগ করায় এডিপির আকার দাঁড়ায় ৮০ হাজার ৩১৫ কোটি টাকায়। সংশোধিত এডিপির চেয়ে নতুন এডিপির আকার বেড়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নের প্রকল্প যোগ করায় এডিপির মোট আকার দাঁড়িয়েছে ৮৬ হাজার কোটি টাকায়।