ব্রিটেনের ইমিগ্রেশন নীতি ক্রমশ বর্ণবাদী রূপ পাচ্ছে
বর্তমান কোয়ালিশন সরকারের কঠোর ইমিগ্রেশন নীতি ক্রমশ বর্ণবাদী রূপ পাচ্ছে বলে অনেকেই অভিযোগ করছেন। ইমিগ্রেশন আইনের কড়াকড়িতে লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবতাও। ফ্যামিলি ভিসায় আয়ের ধরাবাঁধা, ভিজিটর ভিসায় বন্ড প্রথা, অবৈধ ইমিগ্র্যান্টকে হুশিয়ারি দিয়ে ভ্যান গাড়িতে বিজ্ঞাপন প্রচার, সর্বশেষ অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট ধরতে বিভিন্ন টিউব স্টেশনে হানা দেওয়ার বিষয় যুগিয়েছে ব্যাপক বির্তকের রসদ। ফ্যামিলি ভিসায় আয়ের সীমা নিয়ে এখন আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছে হোম অফিস। অন্যদিকে ভিজিটর ভিসায় বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে বন্ড ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। এই স্কিম নিয়ে ইতিমধ্যেই উল্লেখিত দেশগুলোতে তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। খালেদ মাহমুদ নামে এক ঢাকার এক ট্রাভেল এজেন্সির মালিক এটিকে বর্ণবাদী আচরণ বলে উল্লেখ করেছেন। সৈয়দ শহীদ আলি নামে পাকিস্তানের করাচি শহরের এক কম্পিউটার ব্যবসায়ী বলেন, ‘এটা দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য। তাদের এই নতুন পলিসি ব্রিটিশ ট্যুরিজম ও ব্যবসায়ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ কিভাবে একজন মানুষ ব্যবসা কিংবা অন্য মিটিংয়ের জন্য ৩ হাজার পাউন্ড খরচ করে ব্রিটেন যাবে।’ ভারতের জনগণও এই সিদ্ধান্তে ব্যাপক নাখোশ। ইতিমধ্যেই এই সিদ্ধান্তের বিবুদ্ধে সরব হয়েছে নাইজেরিয়া সরকার। এতে দু’দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ব্যাহত হবে বলে জানানো হয়েছে। খোদ ব্রিটেনেও এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। যারা ভিসার মেয়াদ বাড়িয়ে সেখানে থেকে যেতে চান, সামিল হয়েছেন বিক্ষোভে।
এদিকে সম্প্রতি ‘দেশে ফিরে যাও, নইলে গ্রেপ্তার করে ফেরত পাঠানো হবে’ লেখা ব্যানার ঝোলানো ভ্রাম্যমাণ মোটরযানে লন্ডনে যে এক সপ্তাহের পরীক্ষামূলক প্রচারাভিযান চালায়, তাতে ব্যাপক বিতর্ক দেখা দিয়েছে। এই প্রচারাভিযানে বর্ণবাদী ঘৃণা ছড়াবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে অনেকেই এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। এমনকি ডেপুটি প্রাইম মিনিস্টার নিক ক্লেগ এই অভিযানের সমালোচনা করে বলেছেন, এটি ব্রিটিশ রাজনীতির সভ্য রীতির বিরোধী। তাঁর আরেক সহকর্মী বাণিজ্যমন্ত্রী ভিন্স ক্যাবল একে একটি নোংরা প্রচারণা বলে অভিহিত করেন। কিন্তু নিক ক্লেগের বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনের একজন মুখপাত্র বলেছেন, সরকার লন্ডনে পরিচালিত এই পরীক্ষামূলক প্রচারাভিযানকে দেশের সব জায়গায় সম্প্রসারণের কথা বিবেচনা করছে। অন্যদিকে অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেন্ট ফোরাম অব ইস্ট লন্ডন তাদের ভাষায় এই বিদ্বেষমূলক প্রচারণা বন্ধের জন্য আদালতের শরণাপন্ন হবে বলে জানিয়েছে। এদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট ধরতে টিউব স্টেশনে অভিযানও বির্তকের উর্ধ্বে থাকতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ অভিযানের সমালোচনা করেছেন অনেক প্রত্যক্ষদর্শী। তারা এই অভিযানের ছবি দিয়ে বলছেন, অবৈধ ইমিগ্র্যান্ট বিরোধী অভিযানের সময় একটা ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়। এমনকি অভিযোগ উঠেছে অফিসাদের বর্ণবাদী মনোভাবেরও। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ঐসব কর্মকর্তারা শাদা চামড়াদের বিষয়ে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না। তারা মূলত টার্গেট করেছেন, এশিয়ান এবং আফ্রিকানদের। ব্রিটেনের মূলধারার সংবাদপত্রে এই অভিযান সম্পর্কে তাদের রিপোর্টে জানাচ্ছে, অভিযান চলাকালে ইমিগ্রেশন অফিসারগণ ছিলেন উত্তেজিত এবং তাদের কার্যক্রম ছিলো ভীতিকর। আরো বলা হচ্ছে, তাঁরা শুধু কালো এবং বাদামী চামড়ার মানুষকে লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিচ্ছিলেন।
সচরাচর ইউকে বর্ডার এজেন্সি অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের সন্ধানে রেষ্টুরেন্টসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনা করে থাকে। কিন্তু এবার তারা অভিযানের ধরণ পাল্টিয়েছে। বর্ডার এজেন্সির অফিসাররা আকস্মিকভাবে হানা দিচ্ছেন টিউব স্টেশনগুলোতে। এর আগে কোনো রেল বা বাসস্টেশনে এ ধরনের অভিযান চালাতে দেখা যায়নি। নতুন ধরণের এই অভিযানে আন্ডারগ্রাউন্ডের যাত্রীরা ভ্রমণ শেষে কিংবা ভ্রমণের শুরুতেই হঠাৎ মুখোমুখি হচ্ছেন ইমিগ্রেশন অফিসারদের। দেখাতে হচ্ছে ব্রিটেনে বসবাসের পক্ষে উপযুক্ত কাগজপত্রের প্রমাণ। জানা মতে গত তিন দিনে এ ধরণের তিনটি পৃথক অপারেশন চালানো হয়। প্রথম অপারেশন চালানো হয়, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কেনসালগ্রীণ স্টেশনে। বর্ডার এজেন্সির একদল পোশাকধারী কর্মকর্তা আকস্মিক এ অভিযান পরিচালনা করেন। বুধবার সকালে পূর্ব লন্ডনের স্ট্রাটফোর্ড স্টেশনেও একই ধরনের অভিযান পরিচালিত হয়। অন্যদিকে বৃহস্পতিবার ওলথহামস্টো সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে এ ধরণের অভিযান পরিচালনা করে আটক করা হয় ১৪জন অবৈধ ইমিগ্র্যান্টকে।
ব্রিটিশ ভিসায় বন্ড ব্যবস্থা নিশ্চিত : ব্রিটেনের ভিজিটর ভিসায় বন্ড ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে, এমন রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে দেশ বিদেশের বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রে। ব্রিটেনের ভিসা আবেদনের ক্ষেত্রে অফেরতযোগ্য ৩ হাজার পাউন্ডের বন্ড ব্যবস্থা চালুর কথা নিশ্চিত করেছে হোম অফিস। হাইরিস্ক লিস্টে থাকা ৬ দেশ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নাইজেরিয়া ও ঘানার নাগরিকদের জন্য এটি বিশেষভাবে প্রযোজ্য বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ক্রমান্বয়ে এই বিশেষ বন্ড সব দেশের ক্ষেত্রেই চালু করা হবে বলে। বন্ড নীতি নিয়ে বৈষম্যের অভিযোগ ও প্রতিশোধের সতর্কবার্তা সত্ত্বেও তারা এই পাইলট স্কিম নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে ব্রিটেন। তবে ঠিক কবে থেকে এটি কার্যকর হবে তা এখনো নিশ্চিত করা হয়নি। জানা গেছে, আপাতত এই পাইলট স্কিম ভিজিটর ভিসার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। কিন্তু এই প্রোগ্রাম সফল হলে যে কোনো ভিসা রুট ও যে কোনো দেশের ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করা হবে। তবে বর্তমানে তাদের তাদের টার্গেট হলো এশিয়া ও আফ্রিকার ৬ দেশ। কারণ সরকারি তথ্য বলছে, প্রতিবছর এই দেশগুলো থেকে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ ব্রিটেনে ভিসার জন্য আবেদন করে।
ব্রিটিশ হোম অফিসের তথ্যানুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ২২ লাখ লোক ব্রিটেন সফরে আসেন। গত বছর ভারত থেকে দুই লাখ ৯৬ হাজার, নাইজেরিয়া থেকে এক লাখ এক হাজার, পাকিস্তান থেকে ৫৩ হাজার, বাংলাদেশ ও শ্রীলংকার ১৪ হাজার নাগরিক ভিজিট ভিসায় ব্রিটেনে প্রবেশ করেছেন। নতুন পরিকল্পনার আওতায় ২০১৫ সাল নাগাদ ভিজিট ভিসায় প্রবেশকারীর সংখ্যা এক লাখে নামিয়ে আনার চেষ্টা করবে প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সরকার। গত বছর ছয় মাসের ভিজিট ভিসায় প্রবেশকারীদের মধ্যে প্রায় ৭৪ হাজার ব্রিটেন ত্যাগ করেননি, যা সামাজিকভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এ ধরনের অব্যবস্থাপনা কমিয়ে আনতেই এই ক্যাশবন্ড ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।