নির্বাচনকে সামনে রেখে হোম অফিসের দু’সপ্তাহের অপারেশন
সৈয়দ শাহ সেলিম আহমেদ: ব্রিটেনের স্থানীয় সংস্থার নির্বাচনের পর পরই এবং আগামী বছরের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে হঠাত করে নির্দিষ্ট টার্গেট পয়েন্ট সামনে নিয়ে ব্রিটেনের হোম অফিস অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের পাকড়াও করে দেশে ফেরত পাঠাতে অপারেশন সেঞ্চুরিয়ান নামের দু সপ্তাহের এক ব্যাপক গ্রেপ্তারি অভিযান শুরু করেছে। হোম অফিসের আকস্মিক এই ধরপাকড়ে এন্টি নেট ওয়ার্ক নামক প্রতিবাদী এক সংগঠন সহ রাজনৈতিক দল এবং লিবারেল গ্রুপ থেকে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।
ব্রিটেনের ডেইলি মেইল গত দুদিন আগে এ ব্যাপারে এক সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা ইতিমধ্যে মেইনষ্ট্রীম ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া চ্যানেল ফোর-এও এর কিছুটা প্রকাশিত হয়েছে।
ডেইলি মেইল লিখেছে, গত কাল এসেক্সের হ্যান্ড ইন ক্যাশে কাজে যোগদানের জন্য অপেক্ষমাণ এক ব্যক্তিকে হোম অফিসের রেইড দল তুলে নিয়ে যায়- এ নিয়ে নেট ওয়ার্ক বলছে হোম অফিস বর্ণবাদী আচরণ করছে।
হোয়াইট হলের তথ্যে জানা গেছে নেট ওয়ার্ক নামক প্রতিবাদী এই সংগঠনের হাতে আগেই হোম অফিসের এই সাড়াশি অভিযানের নামের তথ্যাদি সম্বলিত লিস্ট ফাঁস হয়ে যাওয়াতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবৈধ ইমিগ্র্যান্টদের ঐ নেট ওয়ার্ক আগে ভাগে সতর্ক দেয়। ফাস হুয়া লিষ্টে নেট ওয়ার্ক দেখতে পায় শুধু মাত্র একটি নির্দিষ্ট কমিউনিটির ইমিগ্র্যান্টদের গ্রেপ্তারের তথ্য বা নামগুলো এতে রয়েছে। আর এই পর্যন্ত চলমান অভিযান অপারেশন সেঞ্চুরিয়ানে দেখা যাচ্ছে শুধু মাত্র এশিয়ান এবং নাইজেরিয়ান কমিউনিটির লোকদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।নেট ওয়ার্ক এখানে এসে বলছে এটা সুনির্দিষ্টভাবেই বর্ণবাদী এবং অধুনা নির্বাচনে বাজিমাত করা ইউকিপের ভোটারদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ জনমতকে চেঞ্জ বা পরিবর্তনের কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এমন ধরপাকড়।
কেননা, ব্রিটেনের বর্তমান ইউকিপ সহ ভোটের রাজনীতিতে ব্যাপক বাজীমাত করার ক্ষেত্রে ইমিগ্র্যান্টদের রয়েছে ব্যাপক ভূমিকা। আর সরকার এই অবস্থানে এসে নাটকীয় পরিবর্তন আনার জন্যই এমন ধরপাকড়ের নামে সেঞ্চুরিয়ান শুরু করেছে বলে অনেকেই অভিযোগ তুলেছেন।
এ পর্যন্ত অপারেশন সেঞ্চুরিয়ান হোটেল, কনষ্ট্রাকশন সাইট, রিক্রুটম্যান্ট এজেন্সি, রেস্টুরেন্ট এমনকি কেয়ার হোমস কোন কিছুই বাদ যাচ্ছেনা। হোয়াইট হলের অজানা তথ্যে জানা গেছে আগে থেকেই নিজেদের কেউ এই তথ্যাবলী হোম অফিসকে সরবরাহ করেছে- তালিকা ও রেইড দেখেই সেটাই অনুভূত হচ্ছে।
ওয়ালসেল স্যান্ডউইচ শপ থেকে ৮ জন গ্রেপ্তার-
ওয়ালসেলের ব্রিজম্যান ষ্ট্রীটের স্যান্ড উইচ শপ থেকে কর্মরত অবস্থায় আট জনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে হোম অফিসের এই ক্র্যাক ডাউন দল। হোম অফিস বলছে তারা আগে থেকেই গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে স্থান সমূহে অপারেশন চালাচ্ছে। তাদের অভিযানে কোন পক্ষপাতিত্ব বা বর্ণবাদী স্থান নেই।
স্যান্ড উইচ এর শপের মালিককে এখন প্রত্যেক ইলিগ্যাল ওয়ার্কারের জন্য ২০,০০০ পাউন্ড করে ফাইন গুনতে হবে, যদি না তিনি রাইট টু ওয়ার্ক এর বৈধ কাগজ পত্র সরবরাহে ব্যর্থ হন।
স্যান্ড উইচের মালিক এক্সপ্রেস এবং স্টারকে জানিয়েছেন কাগজ পত্র প্রসেসিং এর পথে।
২২ থেকে ৫৩ বছর বয়সের মধ্যকার গ্রেপ্তারকৃত আটজনের মধ্যে একজন মহিলাও রয়েছেন। এর মধ্যে তাৎক্ষনিক চেকে একজন ওয়ার্কারের ভিসার মেয়াদ অতিবাহিত হয়ে যাওয়াতে তাকে ব্রিটেন থেকে রিমুভালের জন্য ডিটেনশন সেন্টারে নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
হোম অফিসের মুখপাত্র ক্যাথরিন এলিস বলেছেন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই হোম অফিস দল স্যান্ড উইচ শপে অভিযান চালিয়ে তাদের এরেস্ট করেছে।
প্রত্যেকের ২০,০০০ হাজার পাউন্ড করে স্যান্ড উইচ শপের মালিককে এখন ১৬০,০০০ পাউন্ড প্যানাল্টি দিতে হবে।
কীথ ভাজ এমপির প্রতিক্রিয়া-
চ্যানেল ফোরে সাংবাদিকদের সাথে সাক্ষাতকারে কীথ ভাজ এমপি অনেকটাই প্রতিবাদী নেট ওয়ার্কের সাথে সুর মিলিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কোন বিশেষ জাতি গোষ্ঠীর নাম এসেছে কিনা।
তবে রাজনীতিবিদেরা ইমিগ্র্যান্টদের ব্যাপারে পজিটিভ-
ইমিগ্র্যান্টদের বিশাল এক অংশ ভোটার কিনা জানিনা- কেননা এ নিয়ে এখনো কোন পেপার বা গবেষণা প্রকাশিত হয়নি। সাধারণভাবে যা বলা হচ্ছে, ইমিগ্র্যান্টদের ভোটের পাল্লা ভারী হওয়ার কারণে নির্বাচনী ফলাফলে ব্যাপক ভূমিকা রাখার কারণেই রোষানলে পড়েছে।কিন্তু তা নিয়েও রয়েছে অনেক প্রশ্ন।
তবে ব্রিটিশ পলিটিশিয়ানদের মধ্যে লেবার দল, কনজারভেটিভ মূল বড় দুই দলের রাজনীতিবিদেরা সকলেই বলতে গেলে একবাক্যে এখন আগের অবস্থান থেকে সরে এসে ইমিগ্র্যান্টদের ব্যাপারে বেশ পজিটিভ মনোভাব পোষণ করছেন।
এ ব্যাপারে কনজারভেটিভ দলের এমপি অ্যান ম্যান মনে করেন, ব্রিটেনের যারা ইমিগ্র্যান্ট আছেন, তারা সবাইতো আর ইলিগ্যাল বা অবৈধ পথে আসছেননা। তাদের অনেকেই অনুমতি নিয়েই ব্রিটেনে প্রবেশ করেন। ইমিগ্র্যান্টদের ব্যাপারে অনেকেরই সঠিক ধারণা নেই। তারা ব্রিটেনের অর্থনীতি ছাড়াও ব্রিটিশ সমাজের উন্নয়নে ব্যাপক ভুমিকা রেখে চলেছেন। এমপি আরো বলেন, আমার এলাকা নটিং হাম শায়ারে কেউ ইমিগ্র্যান্টদের ব্যাপারে নালিশ করতে এলে আমি তাদেরকে বলে দেই আমার এলাকাতেতো ইমিগ্র্যান্টদের কোন সমস্যা নেই।
একই পজিটিভ মনোভাব লেবার দলেরও।তারাও ইমিগ্র্যান্টদের ব্রিটিশ সমাজে ব্যাপক ভূমিকা রাখার কথা স্বীকার করেছেন বিভিন্ন আলোচনা ও বক্তব্যে।হোম অফিস সিলেক্ট কমিটির এডভাইজর কীথ ভাজও ইমিগ্র্যান্টদের নানা পজিটিভ ভুমিকার কথা বিভিন্ন আলোচনায় বলে থাকেন।
তবে কনজারভেটিভ এমপি স্বীকার করেন, ইমিগ্র্যান্টদের সংখ্যা কমিয়ে আনার কনজারভেটিভ সরকারের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকার ব্যর্থ। যে সব এলাকায় ইমিগ্র্যান্ট বেশী সে সব এলাকায় স্কুলগুলোতে স্থান সংকুলানের সংকট নিরসনে ভুমিকা সহ হাসপাতালগুলোতে সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির কথা বলেছেন কনজারভেটিভ এমপি অ্যান ম্যান।
২০১৫ নির্বাচন কি ইমিগ্র্যান্টদের জন্য ট্র্যাম্প কার্ড ?-
আগামী ২০১৫ ব্রিটেনের জাতীয় নির্বাচনে ইমিগ্র্যান্টরা কি ট্র্যাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহ্নত হতে যাচ্ছেন কিনা এনিয়ে বিভিন্ন কমিউনিটিতে ব্যাপক গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ইমিগ্র্যান্ট অধ্যুষিত এলাকার স্থানীয় সংস্থার নির্বাচনে ভোটের হারে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। যেমন টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র নির্বাচনী ফলাফলে ইমিগ্র্যান্ট কমিউনিটি জয় পরাজয়ের নির্ধারনী শক্তিতে আভির্ভুত হয়েছেন।একই ফ্যাক্টর অন্যান্য ইমিগ্র্যান্ট অধ্যুষিত এলাকায়ও।তাই কমিউনিটির অনেকেই মনে করছেন, ২০১৫ নির্বাচন আগ পর্যন্ত এই ইমিগ্র্যাশনের নানা জটিল ইস্যু এবং হোম অফিস কর্তৃক ধরপাকড় অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে ইউকিপ এবং টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট এর মনোভাব পরিবর্তনে বা সোজা বাংলায় বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে এমন সিগন্যাল দেয়া হবে বলে কমিউনিটির অনেক অভিজ্ঞ মহলের ধারণা।
আবার কেউ কেউ বলছেন, কনজারভেটিভের ইমিগ্র্যাশন সংখ্যা ও নীতির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনার নিমিত্তে হোম অফিসের এমন সাঁড়াশি অভিযান স্বাভাবিক হিসেবেই তারা দেখছেন।এক্ষেত্রে তারা অতীতের ও নিকট অতীতের অভিযানের কথাও বলেছেন। কিন্তু এর বিপরীতে লিবারেল গ্রুপের ও প্রতিবাদীরা বলছেন, নির্বাচনী ডামাডোলের পর এমন জোরদার কোড নেম অপারেশন সেঞ্চুরিয়ান- আসলেই নির্বাচনী ফলাফলে ইমিগ্র্যান্টদের ভূমিকা থেকেই শুরু বলেই তাদের অপিনিয়ন।অবশ্য এ ব্যাপারে হোম অফিসের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ইতিপূর্বে হোম অফিস জানিয়েছে তাদের অভিযানে এমন কোন উদ্দেশ্য নেই, বরং তারা নির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই অভিযান পরিচালনা করছেন বলে স্টার কে জানিয়েছেন।