মেয়র লুৎফুর রহমানের সঙ্গে দেশি মিডিয়ার বৈরী আরচণ প্রসঙ্গে
কামাল মেহেদী
টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমানকে নিয়ে বিলাতের ডানপন্থী মিডিয়ার নেতিবাচক প্রচারণায় সবাই অভ্যস্ত হলেও অবাক হয়েছেন দেশীয় কিছু সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা দেখে। জনগণের ভোটে মেয়র নির্বাচিত হয়ে পরবাসে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন লুৎফুর রহমান। স্বাভাবিক কারণেই বিদেশি ডানপন্থী মিডিয়া বা রাজনীতিকরা তাকে সহজে মেনে নেবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য বাঙালী মেয়র লুৎফুরের সঙ্গে ডানপন্থী মিডিয়ার মতোই বৈরী আচরণ করেছে দেশীয় কিছু সংবাদমাধ্যম।
টাওয়ার হ্যামলেটস বাংলাদেশি মেয়র …
ইউকের প্রথম বাংলাদেশি অরিজিন নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ১ দশমিক ২ বিলিয়ন পাউন্ডের বাজেট নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। বিলাতের দ্বিতীয় বৃহত্তর রাজনৈতিক দল লেবারপার্টির সঙ্গে টেক্কা দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো জনগণের সরাসরি ভোটে দ্বিতীয়বারের মতো টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন লুৎফুর রহমান। সিলেটের বালাগঞ্জের ছেলে লুৎফুরকে কখনো বাংলাদেশি বা কখনো কট্টর মুসলিম হিসাবে আখ্যায়িত করে কিছু ব্রিটিশ ডানপন্থী মিডিয়ার প্রচারণা এখনো অব্যাহত আছে। বৃটিশ জনগণের ট্যাঙের অর্থে চলা বিবিসির মতো প্রতিষ্ঠানও তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ২২ মে ইংল্যান্ডের অন্যান্য লোকাল বারার মতো টাওয়ার হ্যামলেটসেও নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়। ২৩ মে মধ্যরাতে ভোট গণণা শেষে রিটার্নিং অফিসার জন ইলিয়ামস ফলাফল ঘোষণার পর বিবিসির অনলাইনের সংবাদের প্রথম লাইনে বলা হয় ‘টাওয়ার হ্যামলেটস বাংলাদেশি মেয়র…’।
সমালোচক এবং আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, বিবিসির বলা উচিত ছিলো ‘বাংলাদেশি অরিজিন’ অথবা ‘বৃটিশ বাংলাদেশি’। শুধু বাংলাদেশি শব্দটি উচ্চারণ করে বিবিসি তাদের স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে সরে এসেছে বলে মনে করছেন তারা। কমনওয়েলথভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিক হয়তো বৃটেনের কাউন্সিল নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন কিন্তু মেয়র বা পার্লামেন্টে প্রার্থী হতে হলে তাকে অবশ্যই বৃটিশ নাগরিক হতে হবে। বৃটিশ পার্লামেন্টে একবার এমপি রুশনারা আলীকে অপর এক এমপি ‘বাংলাদেশি এমপি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এমপি রুশনারা আলী সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ করেন। তাকে ‘বৃটিশ বাংলাদেশি’ অথবা ‘বাংলাদেশি অরিজিন’ বলা যেতে পারে বলেও ওই সময় মতপ্রকাশ করেন তিনি। তবে শুধু ‘বাংলাদেশি এমপি’ বলা যাবে না। কিন্তু বিবিসি লুৎফুর রহমানকে তার নির্বাচনের জয়ের নিউজে ‘টাওয়ার হ্যামলেটস বাংলাদেশি মেয়র’ বলে উল্লেখ করেছে। এবার দেখা যাক, লুৎফুর রহমানের প্রতি বিবিসি এতো নাখোশের কারণ কী?
নির্বাচনে প্রায় এক মাস ২১দিন বাকি থাকতে বিবিসি ‘দ্যা মেয়র এন্ড আওর মানি’ শিরোনামে একটি প্যানোরামা প্রচার করে। প্যানোরামাটি নির্মাণ করেন বিবিসির সাংবাদিক জন ওয়ার। প্রচার হয় ৩১ মার্চ। প্যানোরামায় লুৎফুর প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়- আর্থিক বরাদ্দের অনিময় এবং বিল্ডিং ট্রান্সফার নিয়ে। প্যানোরামায় অভিযোগকারীদের মধ্যে প্রায় শতভাগ লুৎফুরের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মতামত ছিলো। আধাঘন্টার প্যানোরামায় লুৎফুর প্রশাসনের বিরুদ্ধে বারার কোনো সাধারণ পাবলিকের কোনো অভিযোগ ছিলো না। প্যানোরামা প্রকাশের পর বিবিসিকে দুই কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে।
এক. প্যানোরামার গবেষণা করার জন্য একজন বাঙালী মহিলা সাংবাদিককে খন্ডকালীন নিয়োগ দিয়েছিলো বিবিসি। ওই সাংবাদিক যখন দেখলেন যে, প্যানোরামার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে- একজন বাংলাদেশি অরিজিন রাজনীতিকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করা, তিনি যখন দেখলেন যে, বিবিসির মতো প্রতিষ্ঠান একজন ব্যক্তির রাজনীতিকে ধ্বংস করতে কাজ করছে; তখন তিনি এক সপ্তাহের মাথায় কাজ ফেলে চলে আসেন। আর আসার সময় ব্যক্তি লুৎফুর এবং তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের দেয়া সকল তথ্যের কপি সঙ্গে নিয়ে আসেন। মেয়র লুৎফুর রহমানের পক্ষে বৃটিশ মূলধারার অনেকগুলো মিডিয়াও আছে। এরা লুৎফুর রহমানের পক্ষে বললে ভুল হবে। এরা ন্যায় ও বস্তুনিষ্ঠতার পক্ষে। বর্ণবাদের উর্ধ্বে উঠে এরা স্বচ্ছ রাজনীতি এবং স্বচ্ছ ও বস্তনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় বিশ্বাস করে। ওইসব মিডিয়ার কাছে সকল তথ্য ফাঁস করে দেন ওই মহিলা সাংবাদিক। এ কারণে বিবিসিকে পাবলিক তথ্য নিরাপদে গচ্ছিত রাখতে ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছে। যা বিবিসির গ্রহণযোগ্যতাকে মারাত্মকভাবে হেয় করে।
দুই. প্যানোরামায় উত্থাপিত অভিযোগের ফাইলগুলো কমিউনিটি সেক্রেটারি এরিক পিকলের কাছে হস্তান্তরের পর ৪ এপ্রিল পুলিশ ও প্রাইস ওয়াটার-হাউস কোপার্স সংক্ষেপে পিডাব্লিউসি নামে একটি বেসরকারি ফাইনান্স অডিট কোম্পানীকে তদন্তের ভার দেওয়া হয়। তার আগে লোকাল অথোরিটিতে হস্থক্ষেপ করার জন্য একটি আইন সংশোধন করা হয়। যেদিন আইনটি সংশোধন করা হয় সেদিনই টাওয়ার হ্যামলেটসের তদন্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তার প্রয়োগ করেন টোরি পার্টির কমিউনিটি সেক্রেটারি এরিক পিকল। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড এবং পিডাব্লিউসি ৪ এপ্রিল সকালে এসে টাওয়ার হ্যামলেটসে মেয়র লুৎফুর রহমানের অফিস থেকে যাবতীয় ফাইলপত্র জব্দ করে নিয়ে যায়।
ওই দিন অবশ্য লেবারপার্টি থেকে প্রচারণা চালানো হয় যে, লুৎফুরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমাকেও সকালে লেবারপার্টির মিডিয়া এডভাইজার টেলিফোন করে একই বার্তা দেন। যা ছিলো সম্পূর্ণ উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং ভুল। অর্থনৈতিক লেনদেনে কোনো অসংলগ্নতা আছে কী না তা তদন্ত করবে পিডাব্লিউসি। তারা রিপোর্ট দেবে আগামী ৩০শে জুন। আর পুলিশের কাজ হলো অর্থনৈতিক অসংলগ্ন লেনদেনের সঙ্গে কোনো অপরাধ বিষয়ক কিছু আছে কী না, তা খতিয়ে দেখা। ৬দিন তদন্ত শেষে পুলিশ জানিয়ে দিয়েছে যে, প্যানোরামায় উত্থাপিত কোনো অভিযোগের সঙ্গে অপরাধ বিষয়ক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি লুৎফুর রহমান কিংবা তার প্রশাসনের বিপক্ষে। এটা ক্রিস্টাল ক্লিয়ার।
আর অর্থনৈতিক অডিট কোম্পানীর রিপোর্ট আসবে ৩০শে জুন। অর্থাৎ এর আগে লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগের আইনত কোনো প্রমাণ নেই। প্রমাণ থাকলে লুৎফুর নির্বাচনেই দাড়াতে পারতেন না। লুৎফুরকে আটকাতে না পারার জ্বালায় জ্বলছে এখন বিবিসি। পাবলিক ট্যাঙের অর্থে চলে বিবিসি। সে হিসাবে বিবিসির কাছ থেকে সবাই সমান এবং সম্মানজনক অবস্থান আশা করলেও বিবিসি এখন নির্লজ্জের মতোই লুৎফুর বিরোাধতায় মেতেছে। তাকে শুধু ‘বাংলাদেশি মেয়র’ বলে আখ্যায়িত করে পুরো কমিউনিটির বিপক্ষে শুধু নয় সাধারণ ভোটারদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে বিবিসি!
এন্ড্রু গিলিগ্যান এবং টেলিগ্রাফের ব্লগ :
এতে গেলো বিবিসির কথা। এবার আসা যাক টেলিগ্রাফের সাংবাদিক এন্ড্রু গিলিগ্যানের কথায়। ডানপন্থী সাংবাদিক এন্ড্রু গিলিগ্যান টোরি লন্ডন মেয়র বরিস জনসনের একজন উপদেষ্টা হিসাবেও কাজ করছেন। নির্বাচনের আগের দিন অর্থাৎ ২১ মে তিনি টেলিগ্রাফের ব্লগে লুৎফুরকে ভোট দেওয়ার আগে ৩০টি বিষয় জানিয়ে একটি লেখা লিখেন। ব্লগে যা ইচ্ছা লেখা যায়। তবে একে সংবাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। ব্লগে তিনি ইচ্ছে মতো লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে অনেকগুলো অভিযোগের কথা উল্লেখ করেছেন।
এতোসব অভিযোগের একটি যদি প্রমাণিত হয় তাহলে লুৎফুরকে হয়তো জেলও খাটতে হতে পারে কিন্তু একটি অভিযোগেরওতো প্রমাণ নেই। শুধু শুধু তার ভোট নস্ট করার জন্যই এন্ড্রু গিলিগ্যান এটা করেছেন। কমিউনিটি তথা লুৎফুর রহমানের সমর্থক ও শুভাকাঙ্খীদের কাছে তা পরিস্কার। ডানপন্থি এবং বাঙালী তথা মুসলিম কমিউনিটি বিরোধী এন্ড্রু গিলিগ্যানের ভূমিকার ব্যাপারে এখানকার কমিউনিটির সবাই ওয়াকিবহাল রয়েছেন। এ কারণেই নির্বাচনের আগের দিন লুৎফুর বিরোধী ৩০ পয়েন্ট রচনা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি। এন্ড্রুর কাজ এন্ড্রু করেছে তাতে কার কী আসে যায়, কমিউনিটির মানুষের এমনই ভাবনা এন্ড্রু গিলিগানকে নিয়ে। ২৩ মে ভোট গণনার সময়ও ট্রঙি হলে এসেছিলেন মিস্টার এন্ড্রু। কিন্তু যখন দেখলেন যে, তার বর্ণবাদী মতবাদ ভোটাররা গিলেনি, বরং ভোটের হিসেবে লুৎফুরের পাল্লাই ভারী তখন তিনি নিরবে কেটে পড়েন। এন্ড্র গিলিগ্যান এখনো একই ধাচের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিবিসি, টেলিগ্রাফ, এন্ড্রু গিলিগ্যান ও জন ওয়ার এদের কথা শেষ করে এবার আসি বাংলাদেশের বিডি নিউজ ২৪ এবং দৈনিক জনকন্ঠের কথায়!
বিডি নিউজ ২৪ :
টেলিগ্রাফের ব্লগে এন্ড্রু গিলিগ্যান নির্বাচনের আগের দিন অর্থাৎ ২১ মে যে লেখাটি প্রকাশ করেন। ২৫ মে বাংলাদেশের বিডিনিউজ ২৪ তা সংবাদ আকারে প্রকাশ করে! টেলিগ্রাফের ব্লগে প্রকাশিত অভিযোগগুলো, যার কোনো প্রমাণ বা ভিত্তি নেই বিডি নিউজ ২৪ তা সংবাদ আঁকারে প্রকাশ করায় অবাক হন প্রবাসীরা। আরেকটি বিষয় হলো, লুৎফুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে লেবারপ্রার্থীকে পরাজিত করে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। যেখানে এড মিলিব্যান্ড এসে লেবার প্রার্থীর পক্ষে ক্যাম্পেইন করেছেন। সেখানে বাঙালী প্রার্থী লুৎফুর রহমান কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে না থেকেও প্রায় ৩ হাজার ভোট বেশি পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। সেই নিউজটা বাংলাদেশের বিডি নিউজের কাছে প্রাধান্য পায়নি। ২৪ মে ফলাফল ঘোষণা হয়েছে। আর ২৫ মে টেলিগ্রাফের ব্লগে লেখা এন্ড্রু গিলিগ্যানের হুবুহু কপি ছাপায় বিডি নিউজ ২৪।
এখানো যতো অভিযোগ উত্থাপন করা হয় তার একটির প্রমাণ নেই। বিডি নিউজ সম্পাদকও ভালো করে জানেন সবকিছু। এগুলো সব প্রপাকান্ডা। ডানপন্থি এন্ড্রু গিলিগ্যান যা করেন বাংলাদেশের বিডি নিউজ একই কান্ড কেনো করবে? এ প্রশ্নটাই এখন ঘুরছে কমিউনিটিতে। এন্ড্রু গিলিগ্যান নির্বাচনের আগে ব্লগে লিখেছেন আর বিবিসি বাংলা বিভাগের সাবেক সাংবাদিক বর্তমানে বিডি নিউজের কর্ণধার নির্বাচনের পরদিন ব্লগে প্রকাশিত ভিত্তিহীন অভিযোগ নিউজ আকারে প্রচার করে বারার ভোটারদের অপমান করেছেন। এখানেই শেষ নয়। বিডি নিউজ টেলিগ্রাফ আর এন্ড্রুর মতোই লুৎফুর রহমানের পেছনে লেগেছে মনে হচ্ছে। ব্রিটিশ মিডিয়ায় লুৎফুর বিরোধী কিছু পেলেই লোফে নিচ্ছে বিডি নিউজ। ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ও লিবডেম লিডার লুৎফুর রহমান এবং টাওয়ার হ্যামলেটস সম্পর্কে যা বলেছেন, তাও ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড থেকে তর্জমা করে ছেপেছে বিডি নিউজ।
টাওয়ার হ্যামলেটসে লিবডেমের কোনো অস্থিত্বই নেই বর্তমানে। গতটার্মে ছিলেন একজন কাউন্সিলর। এবার সেই একজনও নেই। আর নেতৃত্ব নিয়ে দলের ভেতরে নিজেই কঠিন সময় পার করছেন লিবডেম লিডার নিক ক্ল্যাগ। লিবডেমকে ধরা হতো লেবারপার্টির বিটিম। অর্থাৎ শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের দল লেবারপার্টির মতোই লিবডেমকে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু ক্ষমতালোভী নিক ক্ল্যাগ ২০১০ সালের মে মাসের নির্বাচনের পর লেবারপার্টির সঙ্গে কোয়ালিশন না করে চলে যান কনজারভেটিভ পার্টির সঙ্গে। তার খেসাড়ত এবার স্থানীয় ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট নির্বাচনে দিয়েছে লিবডেম।
অন্যদিকে টাওয়ার হ্যামলেটসে ভোট গণণার বিলম্বের কারণেও লুৎফুর বিদ্বেষী কিছু মিডিয়ায় নানান অপপ্রচার চালিয়েছে। কিন্তু অতি নিকট থেকে আমরা যা দেখেছি তা হলো, এক নাগারে মেয়র নির্বাচনের ভোট গণণা শেষ হবার পর শুরু কাউন্সিল ভোট গণণা। তবে প্রার্থীদের দাবীর প্রেক্ষিতে কাউন্টিং পাল্টা কাউন্টিংয়ের কারণে দেরি হয়ে যায়। কিন্তু অনড় রিটার্নিং অফিসার স্বচ্ছতা বজায় রাখতেই প্রার্থীদের দাবীর প্রেক্ষিতে তা করেছেন।
অন্যদিকে, ভোটের দিন কেন্দ্রের সামনে লেবার, টোরিসহ সকল দলের ক্যাম্পেইনারই উপস্থিত ছিলো। আইন অনুযায়ী বিলাতে ভোট কেন্দ্রে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত লিফলেট বিলি করা যায়, ক্যাম্পেইন করা যায়। এখন এসব নিয়ে যে অভিযোগ উঠছে এগুলোর ভিত্তি বেশি শক্ত হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা নিশ্চয় ইলেক্টরাল কমিশন তদন্তে বেরিয়ে আসবে। এখানেও ওই টাউন হলের মতো প্রচারণা চালানো হচ্ছে যে, মেয়র টাউন হলে যেতে পারছেন না। ভোট জ্বালিয়াতির কারণে। এটা সম্পূর্ণ প্রপাগান্ডা। ভোটের দিনতো সেন্টারে সেন্টারে পুলিশও ছিলো। সারাদিন ঘুরেতো আমরা সেই চিত্রই দেখেছি। অথচ বিডি নিউজ সেই টেলিগ্রাফের ব্লগ আর বিবিসিকেই ফলো করে টুইস্ট করে লুৎফুরের দিকে অভিযোগের আঙ্গুল তুলে নিউজ ছেপে যাচ্ছে। এখানে একটি বিষয় যোগ করা ভালো যে, বিডি নিউজের লন্ডন প্রতিনিধির সঙ্গে মেয়র লুৎফুরের কোনো বিরোধ নেই বলেই আমি জানি। তবে ২০১০ সালের ২২শে অক্টোবর টাওয়ার হ্যামলেটসের প্রথম মেয়র নির্বাচনে লেবারপার্টির পক্ষে একটি নতুন সাপ্তাহিক প্রকাশ করা হয়েছিলো। ওই প্রকাশনার সঙ্গে বিডি নিউজের লন্ডন প্রতিনিধি যুক্ত ছিলেন এবং তিনি সব সময়েই লেবার ঘেষা বলে জনবল রয়েছে।
এবার আসি দৈনিক জনকণ্ঠের একটি লেখা প্রসঙ্গে।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর জামায়াতি বানানোর তরিকা :
গত ১৬ই এপ্রিল, দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদকীয় পাতায় ইউকে প্রবাসী আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘জামায়াতীদের বিলাত অভিযান’ শিরোনামে একটি লেখা ছাপা হয়। সেই লেখায় গাফফার চৌধুরী যারা লুৎফুর রহমানকে ভোট দিয়েছেন তাদেরকে জামায়াতী বানানোর চেষ্টা করেছেন! একই সঙ্গে তিনি অসত্য ও ভ্রান্ত কিছু তথ্যও উপস্থাপন করেছেন লেখার মাধ্যমে। লুৎফুরকে নিয়ে ভিন্নমত যে কারো থাকতেই পারে। কিন্তু গাফফার চৌধুরীর মতো নামিদামি কলামিস্টের কলাম বলে ভিন্ন কথা। এর প্রধান কারণ হলো তিনি সচরারচ এসব নিয়ে লিখেন না। এখন লিখলেন তো লিখলেন তাও আবার লুৎফুরকে নিয়ে নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে। সুতরাং বলতে দ্বিধা নেই এ লেখা হয়েছে টাকার বিনিময়ে! লুৎফুরকে আমিও ভোট দিয়েছি। আমাকে জামায়াত বানানোর অধিকার কী কারো আছে। কারণ লুৎফুরতো জামায়াতের প্রার্থী ছিলেন না। তাহলে গাফফার চৌধুরী সেটা পেলেন কোথা থেকে?
আবদুল গাফফার চৌধুরী লন্ডনে বাঙালী কমিউনিটি থেকে সুবিধা নিলেও তিনি কোনো দিন কমিউনিটির সুখ-দুঃখ নিয়ে একটি শব্দও লিখেননি। ঢাকা এয়ারপোর্ট কাস্টম অফিসের ভেতরে প্রবাসী সুরত মিয়া হত্যার বিচার চেয়ে কমিউনিটির পক্ষ থেকে গাফফার চৌধুরীকে অনুরোধ করা হয়েছিলো দু’কলম লিখার জন্য তিনি লিখেননি। হঠাৎ লুৎফুর ভাবনায় তাকে কেনো পেয়ে বসলো এ নিয়েও নানান গুঞ্জন চলছে।
লেবারপার্টি থেকে লুৎফুরের বিদ্রোহ করার পেছনের প্রকৃত কারণটি উল্লেখ্য করতেও ব্যর্থ হয়েছেন গাফফার চৌধুরী। টাওয়ার হ্যামলেটসে মেয়রাল সিস্টেম আসবে কী না, এ নিয়ে বারার জনগণ গণস্বাক্ষর করে রেফারেন্ডামের দাবী জানায়। এর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন তৎকালিন বেথনালগ্রীণ এন্ড বোর এমপি জর্জ গ্যালওয়ে। জনগণের দাবীর প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের মে মাসের সাধারণ নির্বাচনের সঙ্গে টাওয়ার হ্যামলেটসের জনগণ হ্যা এবং না ভোট দেন রেফারেন্ডামের জন্য। তাতে হ্যা ভোট জয়ী হয়। পরবর্তীতে একই বছরের ২২শে অক্টোবর হয় মেয়রাল ইলেকশন। এর মধ্যে লেবারপার্টির ভেতরে অনেক দেনদরবার হয়েছে মেয়রাল সিস্টেমের পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে। মেয়র লুৎফুর রহমান মেয়রাল সিস্টেমের পক্ষে ছিলেন বলেই দাবী দলের ভেতরে থাকা তার রাজনৈতিক বন্ধুদের। অন্যদিকে লেবারপার্টির দলীয় অবস্থান ছিলো মেয়রাল সিস্টেমের বিপক্ষে।
আর তিনি তখন ছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটস লেবারের লিডার। রেফারেন্ডামের পর যখন নির্বাচনের দিন তারিখ ঘোষণা করা হলো তখন শুরু লেবারের প্রার্থী বাচাই নাটক। তৎকালীন লিডার লুৎফুর রহমানকে বাদ দিয়েই প্রার্থীর শর্ট লিস্ট করা হলো। তারপর আবার তাকে শর্টলিস্টে রাখা হলো। আবার বাদ দেওয়া হলো। এভাবে পঞ্চম ধাপে সম্পন্ন হয় প্রার্থী মনোনয়নের শর্ট লিস্টের তালিকা। এর মধ্যে কেনো তাকে শর্ট লিস্টে রেখে আবার বাদ দেওয়া হবে, এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে পার্টির বিরুদ্ধে কোর্টে চলে যান লুৎফুর। কোর্টের বাইরে অর্থ দিয়ে আপোষ করে ফাইনাললি তাকে শর্ট লিষ্ট তালিকায় রাখতে বাধ্য হয় লেবার। তারপর শর্ট লিষ্ট থেকে চুড়ান্ত প্রার্থী নির্বাচন করেন বারার ভেতরে থাকা পার্টির পেইড মেম্বাররা। সেখানে লুৎফুর রহমান দলের পেইড সদস্যদের ভোটে লেবারার্টির মেয়র প্রার্থী নির্বাচিত হন। তিনি যখন চুড়ান্তভাবে দলের পক্ষ থেকে মেয়র প্রার্থী হিসাবে নমিনেশন সাবমিট করতে যাবেন, তার টিক আগে আবার তাকে বাদ দেওয়া হয়। দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী করা হয় হেলাল আব্বাসকে।
এখান থেকেই বিদ্রোহ করে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন লুৎফুর রহমান। লেবারপার্টি তার উপর অবিচার করেছে, এটা ভেবে কমিউনিটির সর্বস্তরের মানুষও লুৎফুরকেই সাপোর্ট করেন। এই হলো কাহিনী। কিন্তু গাফফার চৌধুরী ঢালাওভাবে মুখস্ত কিছু কথা লিখে গেলেন। যেহেতু তিনি কমিউনিটির কোনো ইস্যু নিয়ে সচরাচর লিখেন না। আর লুৎফুর রহমান নিয়ে হঠাৎ লিখলেন সেহেতু মনে করা হচ্ছে তিনি টাকা খেয়ে এ লেখাটি লিখেছেন। আর আইএফই অর্থাৎ ইসলামি ফোরাম অব ইউরোপের ব্যাপারটি আরো মজার। বৃটেনে একটি স্বেচ্ছাসেবক দল হিসেবে আইএফই’র ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এ সংগঠনটির বিপক্ষে বৃটিশ সরকারের খাতায় আইন বিরুদ্ধ কোনো অভিযোগ আছে বলে আমার জানা নেই। আমি যতোদূর জানি, আইএফই করেন আবার লেবার, টোরি বা লিবডেম পার্টি শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছেন এমন অসংখ্য মুসলিম রয়েছেন। বাংলাদেশের কট্টর আওয়ামী লীগবাদীদের কাছে আইএফই নিয়ে একটা চুলকানী রয়েছে। বাস্তবতা হলো বিলাতেতো জামায়াত নামে বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামির কোনো কার্যক্রমও নেই। কিন্তু আবদুল গাফফার চৌধুরী কার স্বার্থে এবং কেনো ঢালাওভাবে বারার সব ভোটারদের জামায়াতি বানোর চেষ্টায় লিপ্ত আছেন এটা তিনি নিজেই ভালো বলতে পারবেন।
টাওয়ার হ্যামলেটসে প্রায় ৩২ শতাংশ বাঙালী আর ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ ইংলিশ বসবাস করেন। এবার নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১লাখ ৭১ হাজার ৮শ ৭১ জন। আর ভোট প্রয়োগ করেছেন ৮৬ হাজার ৫শ ৪০ জন ভোটার। আর লুৎফুর রহমান পেয়েছেন ৩৭ হাজার ৩শ ৯৫ ভোট। ইউকে এবং ইউরোপের মধ্য প্রথম কোনো বাংলাদেশী সরাসরি ভোটে নির্বাচিত নির্বাহী মেয়র হলেন লুৎফুর রহমান। বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামেরও ভালো ধারণা রয়েছে লুৎফুর রহমানকে নিয়ে। তাকে নিয়ে যেখানে প্রবাসীরা গর্ববোধ করেন।
সেখানে আবদুল গাফফার চৌধুরীর সমস্যাটা কোথায় তা কেউ বুঝতে পারছেন না। তবে গাফফার চৌধুরীর অভ্যাস বাংলাদেশের শফিক রেহমানের ভালো জানা। তিনি হয়তো ভালো বলতে পারবেন। স্বজাতির এমন গৌরবান্বিত অর্জনে খুশি নাইবা হলেন। নিরব থাকেন। সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে তাকে রাজনৈতিক রং দেবার কি কোনো প্রয়োজন আছে। আর এতোবড় জ্ঞানী হয়ে সাধারণ ভোটারদেরও রং লাগিয়ে দেবার অধিকারওতো গাফফার চৌধুরীর নেই। বিডি নিউজ ২৪! ডানপন্থি টেলিগ্রাফ, এন্ড্রু গিলিগ্যান, বিবিসির কাছে প্রবাসী বাঙালীদের কি দাবীইবা থাকতে পারে? যদি স্বজাতি এবং ঘরের মিডিয়াই ভিত্তিহীন, প্রমাণহীন অভিযোগের উপর ভর করে বৈরী আচরণ করে তখন প্রবাসী বাঙালীরা আর কোথায়ই বা যেতে পারে?
লেখক: বার্তা সম্পাদক। চ্যানেল এস টেলিভিশন, লন্ডন।
এখানে প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব, দা সানরাইজ টুডে ডটকম’র সম্পাদকীয় বিভাগের আওতাভূক্ত নয়।