ইরাকে পশ্চিমা আগ্রাসন আবারও কি আসন্ন
ইরাক আবার পড়েছে নৈরাজ্য, সহিংসতা ও ধ্বংসের কবলে। অনেকেই বলছেন, ইরাকের বর্তমান দুর্দশা হচ্ছে দেশটিতে ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধের প্রত্যক্ষ পরিণাম। কিন্তু নব্য রক্ষণশীল ও ব্লেয়ার-সমর্থক বৃটিশরা বলতে চান, বর্তমান ইরাকের দুর্দশা-মুক্তির জন্য মার্কিন নেতৃত্বে দেশটিতে আবার যুদ্ধযাত্রা প্রয়োজন। তাদের মতে, মার্কিন নেতৃত্বে বোমাবর্ষণ শুরু হলেই ইরাকে আবার শান্তি ফিরে আসবে।
আইএসআইএল (ইসলামিক স্টেট অব ইরাক এন্ড দি লেভান্ট) ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুল শুধু দখল করেনি। শহরের বিভিন্ন ব্যাংকের চারশ’ মিলিয়ন ডলার আমানত তারা লুট করেছে। ইসলামপন্থী যোদ্ধাদের অভিযানে ভীতচকিত সরকারি সৈন্যরা তাদের অস্ত্র ও ইউনিফর্ম ফেলে পালিয়ে যাওয়ার পর শহরে মজুদ ইরাককে সরবরাহ করা মার্কিন অস্ত্রশস্ত্রের বিশাল ভান্ডারটিও ইসলামপন্থী যোদ্ধারা দখল করে নিয়েছে। ৫ লাখ লোক মসুল ছেড়ে পালিয়েছে। বলা হচ্ছে, তারা পালিয়েছে আইএসআইএল যোদ্ধাদের ভয়েই শুধু নয়, বরং এই আশঙ্কায় যে, এরপর শহরে শুরু হবে ইরাক সরকারের নৃশংস পাল্টা হামলা।
ইরাক থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের জন্য প্রেসিডেন্ট ওবামার ইতোমধ্যে কূট সমালোচনা করেছেন সিনেটর ম্যাক-কেইন। অভিন্ন সুর শুনিয়েছেন আরও বহু রিপাবলিকান। তাদের দাবি, মার্কিন বিমান ও স্থলবাহিনী আবার ইরাকে ফিরে যাক। সিনেটর লিনসে গ্রাহামের ভাষায়- মার্কিন বিমান হামলা ছাড়া ইরাকী রক্তক্ষরণ বন্ধ করা সম্ভব নয়।
স্থলে ও আকাশে আরও বড় আকারে ইরাকে হামলা চালাতে হবে মার্কিনীদের-ইরাকে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেন্স জেফরির বক্তব্য হচ্ছে এটি।
ইরাকে নতুন মার্কিন হামলার সাফাই গাইতে এগিয়ে এসেছেন সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারও। তিনি বলেন, ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র হামলা ইরাকী দুর্দশা, হতাশা ও মৃত্যুর কারণ নয়। তার মতে, তখন ঐ হামলা চালিত না হলে ইরাকীরা আরও দুরবস্থায় পড়ত। আইএসআইএল আক্রান্ত বর্তমান ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বে আরও বড় পরিসরে যুদ্ধাভিযান চালানোর ব্লেয়ার দাবি করেছেন। ২০০৩-পরবর্তী ইরাক পরিস্থিতির নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের অবলোকন হচ্ছে- সর্ব অর্থে একটি কার্যকর দেশ ছিল ইরাক। অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয় মার্কিন নেতৃত্বে ২০০৩ সালে দেশটিতে আগ্রাসন চালিত হওয়ার পর।
ইরাকে পশ্চিমা ফৌজী উপস্থিতি ইরাকী সরকার ও জনগণ বরাবর প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। মার্কিন ও বৃটিশ জনগণও ইরাক থেকে তাদের সেনাবাহিনীর বরাবর প্রত্যাহার দাবি করে এসেছে।
কিন্তু আক্রান্ত ও আগ্রাসী উভয় পক্ষের জনগণের দাবি বাস্তবায়নের আগেই দখলদাররা ইরাকের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন কাঠামোটিকে তছনছ করেছে। রাজনৈতিক ও সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করেছে। সেনাবাহিনী, পুলিশসহ পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থাটিকে বরবাদ করে দিয়েছে। এ কথাগুলো উল্লেখ করে পর্যবেক্ষকরা বলতে চান, পশ্চিমাদের এই দূর প্রসারী চক্রান্ত কর্মের কারণেই আজ মহাদুর্বিপাকে পড়তে হয়েছে ইরাককে-আইএসআইএলের সাম্প্রতিক হামলার মুখে। তাদের সশস্ত্র হামলার কল্যাণে ইরাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পশ্চিমাদের এই মিথ্যা প্রচারের জবাবে এক পশ্চিমা পর্যবেক্ষক বলেছেন, গণতন্ত্র নয়, ইরাকে শিয়া-সুন্নি সাম্প্রদায়িক বিভাজন, হানাহানি ও দেশজুড়ে অস্থিতিশীলতা এগুলো হচ্ছে পশ্চিমাদেরই অবদান। ইরাককে বরবাদীর পথে ঠেলে দেয়া হয়েছে নূরী আল-মালিকীর মতো পশ্চিমের আজ্ঞাবহ সঙ্কীর্ণচিত্ত ব্যক্তিকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বানানোর মধ্য দিয়ে। দুর্নীতিবাজ, ক্ষমতালোভী ও বিভেদপন্থী এই মানুষটি নিজ সম্প্রদায়ের লোকদেরই তার দেশশাসনে একমাত্র সম্বল বানিয়েছেন এবং অন্যসব সম্প্রদায়কে ভীত-তটস্থ রাখতে গিয়ে ক্ষমতায় বসার পর থেকেই দেশের অখন্ডতা ও ঐক্যের পিঠে ছুরি বসিয়ে চলেছেন। বিশেষ চিন্তার সঙ্গে লক্ষণীয় নূরী আল-মালিকীর এই সরকারকেই লাগাতার সমর্থন দিয়ে চলেছে মার্কিন প্রশাসন। বেসুমার অর্থ ও অস্ত্রও তুলে দেয়া হয়েছে এই সরকারের হাতে। আইএসআইএলের ত্বরিত সাফল্যে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নূরী আল-মালিকীর প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনা দেশজুড়া দুর্নীতি ও দুরবস্থা, সাম্প্রদায়িক, হত্যা-হানাহানি দেশের জনগণের মধ্যে যে হতাশা ও উচ্ছন্নতার মনোভাব জন্ম দিয়েছে এবং প্রায় ধ্বংসের দোরগোড়ায় ইরাককে এনে দাঁড় করেছে- সে অবস্থা দেখেশুনে বহু আগে থেকেই বহুজনে এমন আকস্মিক অঘটন বা ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বা সম্ভাবনা গুনে আসছিলেন।
২০০৩ সালের ইরাকের পুনরাবৃত্তি দেখার দাবি তুলেছেন পশ্চিমাদের অনেকে আবারও। ২০০৩-এর পশ্চিমা আগ্রাসনের ফলশ্রুতিতে ইরাকের পরিপূর্ণ বিনাশ দেখার অভিলাষ যাদের অপূর্ণ রয়ে গেছে, তারাই সম্ভবত আবার সোচ্চার হয়েছেন ইরাকে পশ্চিমা হামলার দাবিতে। কিন্তু এছাড়া অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক অন্য যে প্রশ্নটি ইদানীং বহু ব্যক্তির মনমানসিকতায় আলোড়ন তুলছে সেটি হচ্ছে- ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে স্বদেশ ধ্বংসের অপরিণামদর্শিতায় মেতে ওঠার মতো দৃঢ় নির্লজ্জ নেতৃত্বের অভাব মুসলিম বিশ্বে কোনোকালেই কী ঘটবে না?