ইহুদি লেখকের কলামে ইসরাইলি বর্বরতার চিত্র
গিডিয়ন লেভি ইসরাইলের একজন লেখক ও সাংবাদিক। কিন্তু সত্য প্রকাশের জন্য তিনি জ্ঞাতি ভাইদের কাছ থেকে শুধুই ঘৃণাই কুড়িয়েছেন। তিনিই সম্ভবত ইসরাইলে সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি। ঘৃণার কারণ তিনি ফিলিস্তিনের ইসরাইল অধিকৃত এলাকায় ইসরাইলিদের অত্যাচার নির্যাতনের কাহিনী পত্রিকায় প্রকাশ করেন।
এই সাংবাদিক গত তিন দশক ধরে প্রতি সপ্তাহে একবার ফিলিস্তিনের ইসরাইল অধিকৃত এলাকায় যান। আর যা দেখেন তা নিরপেক্ষভাবে ও কোনোরূপ প্রচার প্রপাগাণ্ডা ছাড়াই বর্ণনা করেন।
কোনো কোনো ইসরাইলির কাছে তিনি সত্য ঘটনার একজন সাহসী প্রচারক। কিন্তু বেশিরভাগ ইসরাইলিই তাকে হামাসের প্রপাগান্ডা বাস্তবায়নকারী বলে নিন্দা করে।
তেল আবিব ভিত্তিক পত্রিকা হারেৎজে প্রকাশিত কলামের কারণেই তিনি সম্ভবত ইসরাইলের সবচেয়ে ঘৃনিত মানুষদের একজন।
লেভি বলেন, হারেজ পত্রিকায় যোগ দেওয়ার পর আমি দখলকৃত এলাকায় যেতে শুরু করি। খুব শীঘ্রই আমি উপলব্ধি করলাম এটাই সেই কাজ যেটা আমি করতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম ইসরাইলি দখলদারদের বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা এবং অমানবিকতার চিত্র তুলে ধরতে।
তিনটা জিনিস আমি দেখতে পেলাম। প্রথমত, ইসরাইলি নিষ্ঠুরতা হচ্ছে ইসরাইল রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নাটক। দ্বিতীয়ত, এই ঘটনাগুলো কখনোই ইসরাইলের গণমাধ্যমে প্রচার করা হয় না এবং তৃতীয়ত, আমার জীবনের একমাত্র মিশন হচ্ছে ইসরাইলি দখলদার বাহিনীর নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতা ইসরাইলি পাঠকদের কাছে তুলে ধরা, যারা জানে না সেখানে মূলত কি ঘটছে।
বহু বছর ধরে লেভির গল্পগুলো দখলকৃত এলাকার ফিলিস্তিনীদের করুণ বাস্তবতার উপর আলোকপাত করে আসছে।
১৯৯৬ সালে তার লেখা ‘একটি বাচ্চা শিশুর করুণ মৃত্যু’ শিরোনামের প্রতিবেদনে তিনি আবু দাহোক পরিবারকে ঘিরে একটা ঘটনার বর্ণনা দেন।
হাসপাতালে যাওয়ার পথে এক চেকপয়েন্টে তাদের গাড়ি থামিয়ে দেওয়া হয়। গাড়িতে করে ফায়জাহ আবু দাহোক নামে একজন গর্ভবতী নারীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু ইসরাইলি সৈন্যরা এই পরিবারটিকে গাড়িতে করে হাসপাতালে যেতে দেয়নি । ফলে গাড়ির মধ্যেই তার বাচ্চা প্রসব হয়ে যায়। যে বাচ্চার নাম তিনি ইউসুফ রাখবেন বলে ঠিক করেছিলেন সেই বাচ্চাটি কয়েকদিন পর মারা যায়।
লেভি তখন লিখেছিলেন, এরা কারা? এই সৈন্যগুলো কারা যারা দেখল যে ফায়জাহ আবু দাহোক ব্যথায় কাতরাচ্ছেন? গাড়ির মধ্যেই তার বাচ্চা প্রসব হয়ে গেছে। এই সৈন্যগুলো কারা যারা তাকে এমন অবস্থায়ও হাসপাতালে পৌছাতে দেয়নি? কারা এই সৈন্যগুলো যারা ফায়জাহ আবু দাহোককে তার সদ্যজাত শিশুকে আচলে জড়িয়ে দুই কিমি হেটে হাসপাতালে যেতে বাধ্য করেছে?
লেভি বলেন, ঘটনাস্থলে যা দেখি তার কোনো কিছুই আমি পরিবর্তন করি না। সত্য যদি র্যাযডিক্যাল হয়, আমার লেখাও র্যা ডিক্যাল হবে।
লেভির আরেকটা মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন একজন তরুণ ফিলিস্তিনিকে নিয়ে। এই তরুনকে ইসরাইলি সৈন্যরা পাথর ছোড়[র অভিযোগে গুলি করে হত্যা করে। যে সৈন্যরা এই তরুণকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছিল তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
তিনি প্রতিবেদন করেছেন, ফিলিস্তিনের সেসব কৃষকদের নিয়ে যারা জলপাই গাছ লাগিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। বারে বারে ইসরাইলি সৈন্যরা তাদের ক্ষেত খামার ও ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আর জোরপূর্বক ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে ইসরাইলি বসতি স্থাপন করেছে।
বেশিরভাগ ইসরাইলিই তার প্রতিবেদনের সমালোচনা করে। তারা বলেন যে লেভি এবং তার সহকর্মীরা সারা বিশ্বে ইহুদি বিরোধী প্রচারণা জোরদার করার জন্য দায়ী।
কিন্তু কিছু লোক লেভিকে এমন একজন ব্যাক্তি হিসেবে জানেন যিনি তার সমাজের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, ইতিহাস ইসরাইলি দখলদারদের চেয়েও নিকৃষ্ট ও নিষ্ঠুর দখলদার দেখেছে। কিন্তু আমি কখনো এমন দখলদারদের কথা শুনিনি যে যারা নিজেরাই নিজেদেরকে নিপীড়নের শিকার বলে বিশ্বাস করে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশের পক্ষ থেকে যা করা হচ্ছে তার জন্য মাঝে মাঝে আমার লজ্জা লাগে।
ফিলিস্তিনিদের অবস্থা দেখে নিজেকে আমার অপরাধী বলে মনে হয়। আমি মনে করি আমরা তাদের প্রতি ভয়ানক নির্যাতন করছি।
(আলজাজিরায় প্রকাশিত Going against the grain শিরোনামের নিবন্ধের ভাষান্তর করেছেন জামির হোসেন)