ব্রাজিলকে কাঁদিয়ে ফাইনালে জার্মানি
ব্রাজিল বিশ্বকাপে ব্রাজিলই নেই। সেমিফাইনালেই থেমে গেছে ব্রাজিলের যাত্রাপথ। আর ব্রাজিলের করুণ বিদায়ে বিশ্বকাপটাই যেন রং হারালো। ব্রাজিলের এমন বিদায়টা মেনে নিতে পারছে না ভক্তরা। ম্যাচে হারলেও একটা অবস্থান থাকে। কিন্তু পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের এমন পারাজয়ের কোন ব্যাখ্যাই নেই। আর কোটি কোটি ব্রাজিলিয়ান সমর্থককে কাঁদিয়ে ফাইনালে পৌঁছে গেছে তিনবারের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি। গতকাল প্রথম সেমিফাইনালে জার্মানি ৭-১ গোলে হারিয়েছে ব্রাজিলকে। আর নিজেদের মাঠে নেইমার-সিলভাবিহীন ব্রাজিলকে বিধ্বস্ত করে ফাইনাল নিশ্চিত করেছে জার্মানরা। বিশ্ব ফুটবলের সুপার পাওয়ারদের ফুটবলীয় ইতিহাসে এটাই সবচেয়ে বড় ব্যবধানে পরাজয়ের রেকর্ড। এছাড়া বিশ্বকাপের সেমিফাইনালেও এতবড় ব্যবধানে কোন দল কখনই পরাজিত হয়নি। ব্রাজিল ৭ গোল হজম করে মাত্র একটি গোল পরিশোধ করে।
গতকাল প্রথম সেমিফাইনাল ম্যাচে যা হয়েছে তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। কোন ধরনের প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে ব্রাজিল এতবড় ব্যবধানে কোন সময়ই পরাজিত হয়নি। ম্যাচ শেষে তাই বিপর্যস্ত পুরো দলকে কোচ লুইজ ফিলিপ স্কলারির সান্ত¦না দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। স্কলারি নিজেও এই পারফরমেন্সে হতবাক। এটা কোনমতেই পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের পারফরমেন্স হতে পারে না। মাত্র ১৮ মিনিটের মধ্যে চার গোল হজম করার পরে ব্রাজিলের রক্ষণভাগ সমর্থকদের বাকরুদ্ধ করে দিয়েছিল। এর মধ্যে তিনটি গোল হয়েছে মাত্র ১৭৯ সেকেন্ডে। মাঠে উপস্থিত প্রায় ৫৫ হাজার স্বাগতিক সমর্থকরা যেন কাঁদতেও ভুলে গিয়েছিল। প্রথমার্ধে ৫-০ গোলে পিছিয়ে থাকার পরে অনেককেই স্টেডিয়াম ত্যাগ করতে দেখা গেছে। গতকাল ম্যাচের মাত্র ১১ মিনিটেই থমাস মুলার গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। ২৩ মিনিটে মিরোস্লাভ ক্লোসা দুই ব্রাজিল গোলকিপার সিজারকে পরাস্ত করে দলের ব্যবধান দ্বিগুণ করেন। এই গোলের সাথে সাথে তিনি বিশ্বকাপে ১৬টি গোল করে আরেক ব্রাজিলিয়ান রোনালাদোর ১৫ গোলের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছেন। ২৪ ও ২৬ মিনিটে টনি ক্রুসের দুই গোলের পরে ২৯ মিনিটে সামি খেদিরা পঞ্চম গোলটি করেন। দ্বিতীয়ার্ধে ৬৯ ও ৭৯ মিনিটে দুটি গোলই এসেছে ক্লোসার বদলী হিসেবে মাঠে নামা আন্দ্রে শুরেলের পা থেকে। ৯০ মিনিটে স্বাগতিকদের পক্ষে একমাত্র গোলটি করেছেন অস্কার। ১৯৫০ সালের ফাইনালে ব্রাজিলের মাটিতে উরুগুয়ের বিপক্ষে হতাশাজনক পরাজয়ের দুঃসহ স্মৃতি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি লাতিন এই ফুটবল পাগল দেশের জনগণ। এবারের এই পরাজয় ‘মারাকানজো’কেও ছাড়িয়ে যাবে বলে সবার ধারণা।
২০০২ সালে বিশ্বকাপে সৌদি আরবকে ৮-০ গোলে পরাজিত করেছিল জার্মান। এরপর এতবড় ব্যবধানে আর কোন দল পরাজিত হয়নি। মেরুদ-ের হাড়ে চিড় ধরায় ব্রাজিলিয়ান সুপার স্টার নেইমার ও সাসপেনশনের কারণে কাল মাঠে ছিলেন না দলীয় অধিনায়ক থিয়াগো সিলভা। ম্যাচের প্রতিটা মুহূর্তে এই দু’জনের অনুপস্থিতি প্রকট হয়ে উঠেছিল। কিক অফের আগে গতকালের ম্যাচের অধিনায়ক ডেভিড লুইজ ও গোলরক্ষক জুলিও সিজার নেইমারের জার্সি হাতে ধরে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার সময় সেই বেদনা যেন সবার মাঝে ছড়িয়ে যায়। দলের মূল দুই কান্ডারিকে হারিয়ে ম্যাচের শুরুতেই অনেকটাই মানসিক বিপর্যস্ত ছিল ব্রাজিলিয়ানরা। আর সেই সুযোগটাই পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছে জার্মান। ক্রুসের কর্নার থেকে ১১ মিনিটেই জার্মানকে এগিয়ে দেবার মধ্য দিয়ে মুলার প্রাথমিক কাজটা সেরেছেন। এরপরের ঘটনাতো ইতিহাস। ক্লোসা, ক্রুস, খেদিরা, শুরেলরা মিলে ব্রাজিলিয়ান রক্ষণভাগকে নিয়ে যেভাবে ছেলেখেলা খেলেছে তাতে গোলবারের নীচে জুলিও সিজারের মূলত কিছুই করার ছিল না। তারপরেও জার্মানদের বেশ কয়েকটি নিশ্চিত গোলের সুযোগ আটকে দিয়ে ব্রাজিলকে আরো বড় লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করেছেন সিজার। নেইমারের পরিবর্তে গতকাল মাঠে নেমেছিলেন বার্নার্ড। আর জার্মান আক্রমণ ঠেকাতে বিরতির সময় স্কলারি হাল্ক ও ফার্নানদিনহোর পরিবর্তে পলিনহো ও রামিরেসকে নামিয়েও কোন কাজ হয়নি। বরং ক্লোসার পরিবর্তে ৫৮ মিনিটে মাঠে নামা আন্দ্রে শুরেল শেষ দুটি গোল করে জার্মানির জয়ের ব্যবধান বাড়িয়েছেন। ম্যাচ শেষে অনেকটাই কিংকতর্ব্যবিমূঢ় ব্রাজিল অধিনায়ক স্কলারি ক্ষমা চাওয়া ছাড়া মূলত তেমন কিছুই বলতে পারেননি। তিনি বলেছেন, ‘পুরো বিষয়টির জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। মাঠে গতকাল পুরো দল যা করেছে তার পুরো দায়িত্ব আমি নিচ্ছি-এই ফলাফলের জন্য আমিই দায়ী। তারা আমাদের তুলনায় অনেক ভাল ছিল, তাদের প্রস্তুতিও ভাল হয়েছে। তারা ভাল ফুটবল খেলেছে। এটা খুবই বাজে একটি দিন ছিল, তবে একইসাথে এই দিনটি থেকে শিক্ষাও নেবারও অনেক কিছু আছে।’ জার্মান দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা মুলারতো খুশিতে কোন কথাই বলতে পারেননি। তিনি বলেছেন, আমি এটা বিশ্বাসই করতে পারছি না। পুরো বিষয়টাই যেন কিভাবে হয়ে গেল। এখন আমাদের সামনে আর একটিমাত্র বাধা। আমাদের সেটার জন্য অবশ্যই লড়াই করতে হবে।’